Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ৩৯)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব - ৩৯)

বিন্দু ডট কম

শুভব্রত তখন এরিনায় একা।তার হাতে শেষ ব্যাটনটুকু দিয়ে গেছে মৈনাক।বাকিটা পথ তাকে একাই যেতে হবে।পথের শেষে একদল মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।তারা পাঠক।তাদের কাছে চিঠি পৌছে দেবার কাজ তার।কেন?'কবিতা' পত্রিকার সম্পাদক বলেছিলেন মূল্যবোধের কথা।কিন্তু শুধুই কি মূল্যবোধ!আর কিছুই নয়?দায়বদ্ধতা তো আছে?কিন্তু কার কাছে এই দায়বদ্ধতা!সমাজ সাহিত্য ভ্যবিষ্যৎ!শুভব্রত কার কাছে দায়বদ্ধ?মৈনাকের সঙ্গে বন্ধুত্ব র কাছে?নাকি সে দায়বদ্ধ তোয়ার মতো মানুষের কাছে।ভাবতে ভাবতেই নিজের মোবাইলটা অনেকদিন বাদে খুলল শুভব্রত।আজ তো 'দোয়াব' অনলাইনে বেরিয়ে যাবার কথা।কেমন হলো কে জানে?পুরুলিয়ার সেই ছৌকবির কবিতাগুচ্ছ,চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাস,রাজবংশীদের কবিতাচর্চার কথা।শুভব্রতর পত্রিকায় লেখা ভেসে এসেছে মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত প্রাথমিক স্কুল থেকে কোচবিহারের অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টারের কাছ থেকে।এই পরিশ্রমের ভিতর কোনও শ্রমিকের শক্তি নিহীত নেই তার।বরং শুভব্রত মনে করে সে নিজে একজন শিল্পী।'কবিতা' পত্রিকার সম্পাদকীয় তার আর মৈনাকের খুব প্রিয় ছিল একসময়।দুজনে পালা করে মুখস্থ করত সেইসব।একদিন মৈনাক তাকে প্রশ্ন করেছিল।     -বল তো শুভব্রত। শিল্পী তো দুইপ্রকারের।'দেবতা' বা 'সেইন্ট'।এর বাইরে শিল্পী হতে নেই?শুভব্রত উত্তর খুঁজতে থাকে।'দেবতা' বা 'সেইন্ট',এদের মধ্যে কোনওটাই সে নয়।শুধু সে কেন,তার আশেপাশে এমন অজস্র মানুষ আছেন যাদের সে শিল্পী হিসেবে দেখেছে।অথচ তাদের কারোকে তার দেখে দৈবশক্তির অধিকারী বা ঋষিসূলভ ভাবতন্ময় নিমগ্ন মনে হয়নি।তাহলে কী তারা কেউ শিল্পী নন?কে শিল্পী আর কে শিল্পী নন,এর উত্তর কে দেয়?শিল্পী নিজে?নাকি তার গুণগ্রাহী উপাসক?নাকি মহাকাল!মহাকালের মাপদন্ডে এক একটি পরমাশ্চর্য শিল্পকর্ম কি এক একটি বিন্দু মাত্র নয়?

             ভাবতে ভাবতেই শুভব্রত দেখল তার ফোনে তরুলতা ও বেশ কিছু অজানা নম্বরের অজস্র মিসড কল।কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে তার সমস্ত মন প্রাণ ভরে বসত করছে 'দোয়াব'।সেই দোয়াবের অনলাইন লিঙ্কে ক্লিক করলেই খুলে যাবে 'দোয়াব' পরিবারের অজস্র মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম।সেখানে তার কাজ শুধুই সঙ্গীত পরিচালক কণ্ডাকটরের।লিঙ্ক মানে তো যোগসূত্র।সেও তো আসলে ওই একটি যোগসূত্রই।তার বেশি কিছু কী?কিন্তু বারবার সেই লিঙ্কে স্পর্শ করবার পরেও কেন মোবাইলের পর্দা তাকে 'এরর' দেখাচ্ছে।আবার কী কোনও ভুল করে ফেলল সে?নাকি যান্ত্রিক গোলোযোগ!কারণ যাই হোক,বহুবারের চেষ্টার পরেও কিন্তু 'বিন্দু ডট কম' এর লিঙ্ক খুলল না শুভব্রতর স্পর্শে।এক অজানা উৎকন্ঠা দানা বেঁধে উঠছে তার মনের ভিতর।ওই পত্রিকার লেখাগুলোর কোনও কপি রাখেনি সে।রাখতে গিয়েছিল।রোহিত মানা করেছিল।বলেছিল,"যুগের সঙ্গে চলুন কাকু।ওই সব পুরনো দিনের অভ্যাস।আজকাল আর ওসব কেউ করে না।সবাই ডিজিটালভাবে 'সেভ'।অদ্ভুত ভাষা এই ইংরাজি।সেখানে 'ডিজিট' কখনো 'সংখ্যা',কখনো বা ' আঙুল'।অথচ এই মর্মার্থ অতোপ্রোতভাবে অন্য কোনো ভাষা বুঝতে পারলো না কেন? সত্যিই তো।মানুষের তর্জনীর শক্তি রাষ্ট্রের কাছে,সমাজের কাছে,আরুণির মতো প্রকাশকের কাছে যন্ত্রের মতো শুধুই একটা সংখ্যা।সংখ্যার যোগ আর বিয়োগ।এই ভাষা এতো বড় সত্য হয়তো এই কারণেই বুঝতে পেরেছে কারণ মানুষ হয়ে ম্নুষকে শোষণ আর শাসন করবার স্পর্ধা তাদের মতো আর কেউ কখনো দেখিয়েছে কী?

          একবার পশুপতিনাথ প্রেসে রোহিতের কাছে যাওয়া দরকার।লিঙ্কে 'দোয়াব' আসছে না কেন জানা দরকার।শুভব্রত একবার ভাবে তরুলতাকে ফোন করলে হয়।এতোদিন পর!কিন্তু পরক্ষণেই তার সেই চিন্তা এক উৎকন্ঠা গ্রাস করে নেয়।একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের কাছে তার ঘর,পরিবার,জীবন সবই তো তার পত্রিকা।সেই পত্রিকা  একটি যান্ত্রিক বিন্দুর কাছে সমর্পণ করে এসেছে সে। সে কি তবে ভুল করে ফেলল? যদি অচিন্ত্যবাবুর শরীর আজ ভালো থাকতো তাহলে এমনটা ঘটত না। সেই সংগ্রামের দিন,অস্তিত্বরক্ষার দিন। আত্মমর্যাদার দিন।রোহিত তো পরবর্তী প্রজন্ম।সে কি বুঝতে পারবে?   শুভব্রত পশুপতিনাথ প্রেসের দিকে হাঁটা দেয়।বুকের ভিতর এক অজানা আশঙ্কা কাটিয়ে উঠতে ঘুরপথে ধরে সে।সপসপে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শুমব্রত।ধুলোয় মাখামাখি লালতিখড়া প্রজাপতি ফেলে রেখে সে এগিয়ে চলে।তার আর বুকের ভিতরে দামামা বেজে ওঠে না।মদনপুর রেল কলোনি থেকে একসময় আসা পারিজাতদার স্টল এখন আর নেই।সেখানে পাঠ্যপুস্তক  আর ডায়রি বেচা হয়।পারিজাতদার বুকের যক্ষ্মা এখন কেমন আছে কে জানে!সেইসব পথ পেরিয়ে শুভব্রত হাঁটতেই থাকে।বৈঠকখানা বাজারের চেনা পথে হেঁটে চলে।সেই গলির ছোট ছোট গর্তে শুঁয়োপোকার মতো বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে আর শুঁয়োপোকা মনে হয় না তার।নিস্তব্ধ আলপথে আজ তরুলতা নেই।শুক্রাণুর রিপোর্ট নেই।বুকসমাষ ধান ক্ষেতের আড়ালে গুলির শব্দগুলো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।তাঁর ঠাকুমা বসে পড়ছেন হাঁপাতে হাঁপাতে।আর পারছেন না তিনি।এতোটা পথ এসে শুভব্রতও হাঁপিয়ে ওঠে।তার সামনে পশুপতিনাথ প্রেসের গলি।সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা বড় লাল দমকল গাড়ি।পুরনো অচিন্ত্যবাবুর বাড়িটা থেকে কালো ধোঁয়া উঠে ঢেকে দিচ্ছে চারপাশ।দমকল আর সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা লেলিহান শিখা এক অসম যুদ্ধ করে চলেছে।এরই মধ্যে শুভব্রতকে আসতে দেখে দৌড়ে চলে এল নেপালি  দারোয়ান প্রীতম ছেত্রী।সে তো দেশে গিয়েছিল!সে কি তবে ফিরে এসেছে?তার দু চোখে অঝোরধারা।শুভব্রতর দুটি হাত ধরে সে কেঁদে ফেলল।

-সব যে সর্বনাশ হয়ে গেল দাদাবাবু।গতকাল অচিন্ত্যবাবু মারা গেলেন।আর আজ প্রেস রামরো ঘর সব জ্বলেপুড়ে ছাড়খাড় হয়ে গেল।সব সপনা টুটেকো ছা দাদাবাবু।সব সপনা টুটেকো ছা।

শুভব্রত দেখতে পায় অচিন্ত্যবাবুর সাধের মারাঠী ঘোড়ার মতো কুচকুচে কালো বেবি অস্টিনের সোনালী ইঞ্জিন বাক্সটাও দাউদাউ করে জ্বলছে।তার সোনালী বুকের পাঁজরজুড়ে রক্তক্ষরণের দাগগুলো ধীরে ধীরে কালচে অতীত হয়ে যাচ্ছে।অচিন্ত্য মিত্র আর নেই?আর রোহিত?শুভব্রত দেখলো দমকলকর্মীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সেও আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে।শুভব্রত একটা কথা না বলা পুতুলের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে।রোহিত প্রথমে তাকে লক্ষ্য করে না।অজান্তেই তার কনুই স্পর্শ করে শুভব্রতকে।তার চোখে শুকিয়ে যাওয়া নিজের ধারা।

-সব যে শেষ হয়ে গেল শুভব্রতবাবু।বাবা।আমার প্রেস।আপনার পত্রিকা।কম্পিউটাররুম জ্বলে ছাই হয়ে গেছে।

-ওওও ….

শুভব্রত নিষ্পৃহভাবে তাকিয়ে থাকে।একটা বিন্দুর থাকা আর না থাকার পার্থক্য যেন তার চোখের মণিতে অর্থহীন হয়ে গেছে।রোহিত আবার আগুন নেভানোর কাজে মন দেয়।শুভব্রত ফিরে আসে।কোথায় ফিরবে সে এখন?তার দোয়াব এখন অতীত।একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ কানে ভেসে আসে তার।বেবি অস্টিনটার ফুয়েল ট্যাঙ্কে রাখা সামান্য জ্বালানি এবার ফেটে গেল বুঝি।শুভব্রত রাস্তার মোড়ে একটি লাইটপোস্টের নীচে বসে সেই অগ্নিকাণ্ড দেখতে থাকে।শুভব্রত হাসছে।পশুপতিনাথ প্রেস যেন মৈনাক মণ্ডলের চিতা।আহা।শান্তি পাক ওরা।সবাই শান্তি পাক।শুভব্রত হাসছে।এতো আনন্দ এর আগে কখনও তার হয়নি।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register