Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

ক্যাফে গল্পে ব্রততী

maro news
ক্যাফে গল্পে ব্রততী

সমর্পণ


জামরঙা বিকেল নিভুনিভু প্রায়। অবন্তিকা ডুবে ছিল প্রাত্যহিক বিষাদ যাপনে। এই অস্তমিত গোধূলিতে ওর একাকিত্ব আবৃত করে ঘন হয়ে নেমে আসে নীলোৎপলের অবয়বহীন অস্তিত্ব। চিনচিনে ব্যথাটায় কিছুটা সুখও লেগে থাকে নাকি! ঈষৎ কেঁপে উঠল অবন্তিকা। মনের আয়নায় অবিকল তারই মতো ওই ছায়াটা কি অপরিচিতার!
অবন্তিকা চিরদিন বিশ্বাস করেছে প্রেম মুক্ত আর ভালোবাসাতেই মুক্তি। এই মুক্ত আঙিনায় থাকতে পারে না কোনো দেনা-পাওনার হিসাব। স্বার্থে নয়, ভালোবাসার বসত ত্যাগে। অথচ তবুও বিভিন্ন নারীর প্রতি নীলের মুগ্ধতা, ঘনিষ্ঠতা আর সপ্রশংস উচ্ছ্বাস বিচলিত আর আহত করেনি কি তাকে! বার বার নিজের অজান্তে, নিজের মনেই তাদের প্রতিপক্ষের আসনে বসিয়ে চুলচেরা বিচারে নিজেকে সেরার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে আশ্বস্ত হতে কি চায়নি! তার প্রতি উদাসীন অবহেলা যখন আরো প্রকট হয়ে উঠেছে অন্য নারীর প্রতি অকুণ্ঠ আগ্রহে, মুগ্ধতায়, প্রশংসায় আর প্রশ্রয়ে তখন সেও কি বহন করেনি পরাজয়ের গোপন গ্লানি! তখনও নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছে ভালোবাসা তো কোনো যুদ্ধবিজয় নয়- তবু অব্যক্ত এক যন্ত্রণা বিক্ষত করেছে অবন্তিকার একাগ্র অধিকারবোধকে। আর ঠিক তখনই তার সমগ্র অন্তরাত্মা শব্দহীন চিৎকারে সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়েছে, "নীল শুধুই আমার!" পরক্ষণেই হয়ত ত্যাগের মায়াবী আলো তাকে সংযমের সহবৎ শিখিয়েছে। শান্ত হয়েছে সে। আত্মগত তন্ময় মুখচ্ছবিতে ফুটে উঠেছে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির আলোছায়া আলপনা।
সেদিনও এলোপাথাড়ি ঝড়! তোলপাড় বৃষ্টিধারায় ধুয়ে যাচ্ছে যা কিছু মলিন। ব্যর্থ হয়েছে অপেক্ষা। আর ফিরবে না নীল। সে আর নেই! এই পৃথিবীর কোথাও কোনোখানে সে নেই। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া পৃথিবী আর দুচোখে নিকষ অন্ধকারের মধ্যেই একটুকরো জলবাহী মেঘ কোথাও কি সিঞ্চিত করেছিল স্বস্তির বারিধারায়!
এখন থেকে নীল শুধুই তার। পৃথিবীতে আকাশে জলে স্থলে নেই তার স্থান। তবু তো সে আছে। এবং আছে শুধুই অবন্তিকার গোপন হৃদয়ের একাগ্র বিশ্বাসে, একান্তই তার হয়ে। "নীল শুধুই আমার" -এই অধিকারবোধই হয়ত প্রসব করেছিল নবজাত এই গূঢ় ভাবনা। সময়ের প্রলেপে বাকি পৃথিবীর স্মৃতিপটে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাবে নীলোৎপলের দীপ্ত প্রতিচ্ছবি আর তখন থেকে শুধুই নীল আর অবন্তিকার একান্ত যাপন। অদ্ভুত ভালোলাগা, কনে দেখা আলোর মতো স্নিগ্ধ, কোমল! নিষ্ঠুর স্বার্থপর তবু অস্বীকার করা অসম্ভব তার স্পষ্ট অস্তিত্ব। তবু গুঁড়িয়ে যাচ্ছে অবন্তিকার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অহংকার। নীলকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা, নিজের একান্ত বিশ্বাসের পরাজয় আবার বুকের মধ্যে নীলের নিঃসপত্ন অধিকারপ্রাপ্তির পূর্ণতায় আত্মবিহ্বল অবন্তিকার দুচোখে তখন ধূসর গোধূলি।
পশ্চিমের বারান্দায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অবন্তিকা। তখনি তারই প্রতিমূর্তি অবয়ব মৃদু হেসে তার চোখে গভীর দৃষ্টি পেতে বলেছিল,"নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় বিশ্বাস করো তুমি!? দাবিহীন? এই চাওয়া-পাওয়ার সংসারে কিছুই কি দাবিহীন হয়? আমি ভালোবাসার ভাগাভাগিতে বিশ্বাস করি না! এ আমার দুর্বলতা নয়,আমার অহংকার!" নির্বাক অবন্তিকা কিছু বলার আগেই আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল অবয়ব।
বাইরে বেড়েই চলেছে ঝড়ের দাপট। অঝোরে জল ঝরে আকাশের বুক চিরে আর অবন্তিকার দুচোখ ভাসিয়ে। অবন্তিকা প্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজের ভিতর ও বাইরের সবটুকু আবরণ, মালিন্য উন্মুক্ত করে নীলকে সে সমর্পণ করবে নিজেকে। চোখে শুকনো জলের দাগ। সমস্ত অন্তর গাইছে, "আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার॥"

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register