Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অনিরুদ্ধ গোস্বামী (পর্ব - ১৮)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অনিরুদ্ধ গোস্বামী (পর্ব - ১৮)

অদৃশ্য প্রজাপতি

বাবা:দেখ সারাজীবন একসাথে থেকেও মনের দিক থেকে অনেকে অনেক দূরে থাকে,একদিন বা দুদিন ম্যাটার করে না যেটা বিবেচ্য সেটা হলো প্রেম বা ভালোবাসা বাকি সব পরে। নীল কোনো কিন্তু নয় তুই যুদ্ধ করতে যাচ্ছিস না ,আর এটা জরুরি ,লুপ ক্লোসার করা অবশই দরকার। তিনদিনের ছুটি নিয়ে পরেরদিন বিকেল ৫ টায় ত্রিভান্দ্রাম গামী ট্রেন ধরলাম এর্নাকুলাম টাউন স্টেশন থেকে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা লাগবে ,AC চেয়ার কার এ। যাবার পথে পুরানো স্মৃতি গুলো ফিরে আসছিলো। প্রায় ৫ মাস এর উপর আথিরার কোনো খোঁজ পাইনি। আথিরা যে কোনো তথ্য চুরির কাজে লিপ্ত থাকতে পারে মন কিছুতেই মানতে চাইছিলো না। রাত দশ টা নাগাদ হোটেল এ চেক ইন করলাম। ডিনার করে বিছানায় শুয়ে এটাই মনে হচ্ছে হয়তো কয়েক কিলোমিটার এর মধ্যে তার বাড়ি ,তার শহরে রয়েছি। কি করছে এখন সে ,ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো শান্তি তে। বাবা কে ফোন করে জানিয়ে দিলাম। বাবা বললো লক্ষ্য -একটাই সত্য কে জানা। রাতে ঠিক ঘুম হলো না। সত্যি যদি হয় যে সে ভালোবাসেনি শুধু ব্যাবহার করে গেছে ,দেখাই হয়তো করলো না ,বা ঠিকানা তে কেউ থাকে না অথবা যা ভাবছি সবটাই ভুল -সি জাস্ট ভ্যানিশড। পরের দিন সকাল ন টা নাগাদ একটা অটো নিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম। ত্রিভান্দ্রাম এর অভিজাত এলাকায় অনেকটা জায়গা জুড়ে এটা একটা অফিস কাম রেসিডেন্স ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি টির। উঁচু পাঁচিল দিয়ে পুরো টা ঘেরা। বাইরে থেকে দেখলাম বাড়ি টি অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রসারিত । সাদা রং তার সাথে টালি রঙের ছাদ। দারোয়ান কে আমার কার্ড দিয়ে বললাম আমি নীল ,আথিরা বালাকৃষ্ণান এর সাথে দেখা করতে চাই। কার্ড টা নিয়ে আমার নাম টা শুনে চমকে উঠলো ,যেন সে আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। বললো "dayavāyi akattu vannāluṁ " ( ভেতরে আসুন অনুগ্রহ করে )। ইন্টারকম এ খবর পেয়ে ভেতর থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক হন্তদন্ত ছুতে এলেন,সাদা ধুতি আর শার্ট কপালে তিলক ,ধব ধবে পরিষ্কার গায়ের রং,পৈতা দেখা যাচ্ছে ,মাথার চুল সিল্কি সাদা ,বললেন প্লিজ কাম ইন ,আই এম আথিরা'স আঙ্কেল। আথিরা যেমনটি বলেছিলো ঠিক তেমনটি আপনি ,নীল। আসুন। মনে একটা চাপা উত্তেজনা আর তার সাথে রাগ হচ্ছে। এক তো কোনো যোগাযোগ নেই তার উপর খবর পেয়ে বাইরে এলোই না ...এ কেমন হেঁয়ালি ...কোনো ফাঁদ নয়তো ... ভদ্রলোক বললেন আথিরা ভেতরে, আসুন কোনো ভয় নেই। পিচ বাঁধানো রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম। পুরো বাড়িটা কয়েকটি অংশে বিভক্ত। থাম বসানো কেরালা ট্রেডিশন এর বাড়ি। হল ঘর এর মতো জায়গায় এসে পৌঁছালাম। বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন ছিলেন অভ্যর্থনার জন্য। নমস্কার আর প্রতিনমস্কার এর পালা সঙ্গে হলে বললাম আথিরা কোথায় ? আমার চোখের উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করে বললেন লেটস গো টু হার পোরশন এন্ড রুম। লম্বা একটা প্যাসেজ এর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলাম। রোদ এসে পড়েছে। এই পোরশন টা তে আধুনিকতার সাথে আদি গঠন শৈলীর মিশ্রণ। যত এগোচ্ছি মনে হচ্ছে সে কি একবার ছুটে এসে দাঁড়াতে পারতো না। লক্ষ্য করলাম আমার হাতের তালু ঘামছে। তাকে কি ভাবে দেখবো ,শেষবার যেমন দেখেছিলাম -বড় টানা টানা কাজল চোখে আমায় দেখবে আর বলবে দু হাত প্রসারিত করে কাছে এস নীল ... সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসলাম। একটা বড় ব্যালকনি। ব্যালকনির প্রান্তে বসার জায়গা ,কাঠের তৈরী। মাঝে একটা দোলনা ঝুলছে। ভদ্রলোক বললেন এর পোরশন পুরো টায় আথিরার। তার প্ল্যান এ তৈরী। সামনে একটি দরজা দেখিয়ে বললেন "মাই সন সি ইস ইনসাইড ,ইউ ক্যান গো ,আই এম কামিং শর্টলি " কি দেখবো ভেতরে ?আশ্চর্য্য ,লক্ষ্য করে দেখলে দরজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব সব উধাও । কি ভাবে দেখবো আথিরা কে ভেতরে ?মুহূর্ত চিন্তা করে একটু গম্ভীর হয়ে নিলাম। খুঁজে খুঁজে এতদূর এসে এতদিন ,ভ্যানিশ হয়ে থাকার জন্য দু চার কথা তো শোনাতেই হবে।তাতে একটা বেশ মজা হবে। নক করলাম দুবার ,দরজার নব হাত দিয়ে ডান দিকে ঘোরাতে হালকা একটা শব্দ হলো লক খোলার। উৎকণ্ঠা নিয়ে হালকা করে ডাকলাম "আথিরা" ,কয়েক মুহূর্ত কাটলো। রসবোধ আছে বলতে হবে ,কে কাকে চমকায় দেখা যাক। আথিরা- বলে আলতো করে দরজাটা খুলে ঢুকলাম। দেখি আথিরা চেয়ে আছে তার কাজল পরা বড় টানা টানা চোখ নিয়ে আমার দিকে ,মুখে অনাবিল হাসি ,ফটো তে , আর তাতে সাদা মালা দেওয়া। আর নিজেকে ধরে রাখা গেল না। ওখানেই বসে পড়লাম। অন্ত :স্থল থেকে উৎসারিত বেদনার ঢেউ এসে যেন গলায় এসে আটকে রইলো, আর তা চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। একটু সামলে নিতে বুঝলাম যে "ছেলেদের ও ব্যাথা লাগে ও সেটা খুব ভেতরে । কেন কিভাবে ?প্রশ্নের ঝড় উঠছে মনে। বয়স্ক ভদ্রলোক সহানুভূতি নিয়ে কাঁধে হাত রাখলেন ,বললেন " সন উই আর রিয়েলি সরি হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইউ ...এন্ড দি কাইন্ড অফ পেন ইউ আর গোয়িং থ্রু। আরো জানালেন "এই ফার্মা বিসনেস আমাদের বহুদিনের পারিবারিক ব্যবসা। বর্তমানে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আর অন্যান্য লোকাল কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থা ভালো যাচ্ছিলো না। আথিরার বাবা আমার বড় ভাই ,আর তার মা অনেকদিন আগে মারা গেছেন। আথিরা ছিল এই কোম্পানির একজন অংশীদার ও ডিসিশন মেকার। যখন আমরা শুনলাম তোমাদের কোম্পানি নতুন এই প্রোডাক্ট টি বাজারে আনবে আর তার ভবিষৎ খুবই ভালো তখন ই সে নিজে উদ্যোগ নিয়ে এর খুঁটিনাটি জোগাড় করতে নেমে পরে। উদ্দেশ্য একটাই ছিল কোম্পানি কে আবার লাভের মুখ দেখাবে। এর্নাকুলাম গিয়ে সে ঠিক করলো সব খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করে আনব। এই করতে গিয়ে বুঝিনি সে এতটা ঝুঁকি নিয়ে নিয়েছে। সেখানেই তোমার সাথে দেখা করে। প্রথমে ভেবেছিলো বেসিক কিছু ইনফরমেশন নিয়ে চলে আসবে ,কিন্তু তোমার সাথে যত পরিচিত হতে থাকে সে আরও তোমার জীবনের সাথে জড়িয়ে পরে। চলে আস্তে পারেনি কারণ সেও যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। " নীল: এটা ঠিক যে এই কর্পোরেট একটিভিটি কোনো ওয়ার এর থেকে কম নয় ,মার্কেট দখলের লড়াই। উনি আরো বললেন "সে হয়তো গিয়েছিলো তোমাকে ফাঁকি দিয়ে ইনফরমেশন নিয়ে চলে আসতে কিন্তু ফিরে এসেছিলো তোমার ভালোবাসাকে জড়িয়ে নিয়ে। আর নিজের সত্তা তোমাকে সম্পূর্ণ রূপে সমর্পন করে দিয়ে । আর আজ দেখলাম সে ভুল করেনি। " নীল : আমি কতবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি।... সে যেন একেবারে এ উবে গেছিলো। আমাকে তো একবার সব বলতে পারতো ... উনি বললেন "সে বুঝতে পারে এ ভাবে বেশি দিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না এবং না পেরে সব হয়তো তোমাকে বলে ফেলবে ,কিন্তু শুনে তাকে তুমি কি চোখে দেখবে ?আথিরা তোমাকে হারানোর খুব ভয় পেতো আর তোমার চোখে ছোট হয়ে যাবার ভয় পেতো ,তাই সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তোমার থেকে। চেরাই থেকে আসার পর থেকে অপরাধ বোধ গ্রাস করতে থাকে। এখানে এসে তার ইনফরমেশন অনুসারে আমরা কাজ ও শুরু করি। আর সে ক্রমাগত নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। আমাকে বলতো সব। আর কথা দিইয়ে নিয়েছিল যে আমিও যেন নিজে থেকে তোমাকে না যোগাযোগ করি। নিজেকে বিশ্বাসঘাতক ভাবতো আর বলতো ভগবান ও ক্ষমা করবে না হয়তো, ক্রনিক ডিপ্রেশন এ ভুগতে থাকলো ডাক্তার অনেক দেখানো হলো কিন্তু ডাক্তার কি করবে যদি রোগী না চায় সেরে উঠতে। দিন কে দিন অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগলো। সারা দিন তোমার আর তার ফটো র দিকে চেয়ে থাকতো আর জল গড়াতো চোখ দিয়ে। বাঁচার ইচ্ছাটাই আর ছিল না তোমাকে ছাড়া ,আবার হারাবার ভয় যদি সব তোমার কাছে স্বীকার করে আর তুমি দূরে সরিয়ে দাও। একদিন তার একটা ওষুধ ওভারডোজ নিয়ে নিয়েছিল সবার অজান্তে। অবস্থা খুবই খারাপ এর দিকে যেতে থাকে ,কিম্স হাসপাতাল এ ভর্তি করেছিলাম,কিন্তু বাঁচানো গেল না। এই নাও তার জার্নাল যা তোমাকেই দিয়ে যেতে বলেছিলো। নীল :আমি কিছুক্ষন কি এই ঘরে একা থাকতে পারি। উনি চলে গেলেন দরজা টা ভেজিয়ে দিয়ে। সকাল সাড়ে দশটা এখন।রোদ আসছে জানলার ওপর সাদা পর্দা ভেদ করে। ৬০০ স্কয়ারে ফিট এর ঘরে মাঝ বরাবর কিং সাইজ এর একটি বেড। সাদা ধবধবে বিছানা র ওপর তার একটা ফটো গ্রাফ এ মালা দেওয়া। ডান দিকে কফি রঙের ওয়ার্ডরোব মেঝেতে সাদা কালো স্কয়ারে এর ডিসাইন করা কার্পেট পাতা। বেড এর পাশে টেবিল ল্যাম্প আর তার নিচে আমাদের এর একটা ফটো,চেরাই এ তোলা। আথিরার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে এই ঘরে। কিছুদিন আগেও এই সব আসবাবপত্র তার স্পর্শ পেত। ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম তাদের। বেড টেবিল এ আলতো করে স্পর্শ করলাম। এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। পাগলের মতো এলোমেলো ভাবে সব কিছু ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম। স্পর্শ, গন্ধের মাধ্যমে তাকে ছুতে চাইলাম মনে হলে এইতো সে আছে কিন্তু যখন ই তার ফটোটা চোখের জল আর বাধা মানলো না। জার্নাল টা খুলে দেখলাম। আথিরা এটা আমাকে দিয়ে গেছে ,এ যে এক অনন্য সম্পদ। তার মনের কথা।ডেট দেওয়া আছে কয়েকটি পাতায়। আমাদের কিছু সুন্দর মুহূর্তের ফটো। পাতা ওল্টাতে শেষ দিকে একটি পাতায় একটা খাম আটকানো দেখলাম। ভেতরে একটা চিঠি ,আথিরার লেখা।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register