- 68
- 0
বাংলার বারোভূঁইয়াদের গল্প বলতে বলতে আজ আমরা পৌঁছেছি আরও এক সমৃদ্ধ প্রদেশ ভুলুয়ায়৷ বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের নোয়াখালী অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উর্বর জমি নিয়ে এই প্রদেশ গঠিত ছিল। মুঘল যুগে যে সকল প্রতাপশালী ভূঁইয়াদের গল্প আপনাদেরকে পরপর শোনাচ্ছি তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই প্রদেশের বীর নরপতি লক্ষণমাণিক্য। বাংলার বিভিন্ন বীর রাজাদের কথা বলতে গেলে একেবারে প্রথম সারিতে যাঁর নাম উঠে আসে তিনিই হলেন এই লক্ষণমাণিক্য। ভুলুয়া রাজ্যের অস্তিত্ব যে বহু পুরনো তা বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। যেমন একটি উদাহরণ দিয়ে আপনাদের বোঝাবার চেষ্টা করি। আইন ই আকবরী গ্রন্থে বালাজোয়ার নামক একটি স্থানের নাম পাওয়া যায়। ভৌগলিক অবস্থান বিচার করলে সেই জায়গাই যে ভুলুয়ার আদি অবস্থান তা ঐতিহাসিকরা মেনে নিয়েছেন। এই 'বালা' শব্দটি থেকেই ভুলুয়ার উৎপত্তি বলেও অনেকে মনে করেন। মেঘনা নদীর পূর্বদিকের অঞ্চলে এই প্রদেশের ব্যপ্তি ছিল। উর্বর এই রাজ্যে ফসলের অভাব ছিল না। আর তার সঙ্গে ছিল কায়স্থ বংশীয় রাজা লক্ষণমাণিক্যের বীরত্বের সব কাহিনী। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলার যে বারো জন ভৌমিক আকবর বাদশা এবং অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তার মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। বাংলার আরও চারজন কায়স্থ রাজা রামচন্দ্র রায়, প্রতাপাদিত্য, কেদার রায় ও মুকুন্দ রায়ের সাথে তাই একই বাক্যে উচ্চারণ হয় মহারাজা লক্ষণমাণিক্যের নাম। বাংলার আদিশূরবংশীয় বিশ্বম্ভর শূরের উত্তরপুরুষ ছিলেন লক্ষণমাণিক্য। বিশ্বম্ভর শূরের সঙ্গে ভুলুয়ার নামকরণের একটি আদি যোগাযোগ রয়েছে। সেই কাহিনীর উল্লেখ না করলে এই প্রদেশের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়। লোকমুখে শোনা যায় মিথিলানিবাসী বিশ্বম্ভর শূর পরিবার সমেত নৌকাযোগে মেঘনা নদী অতিক্রম করছিলেন। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে সেখানে তাঁদের নৌকা আটকে যায়। বিপদের মধ্যে পড়ে ভগবানের নাম স্মরণ করা ছাড়া তাঁর আর কোন উপায় ছিল না। তখন সেই রাত্রে ইষ্ট দেবী স্বপ্নে আবির্ভূতা হয়ে তাঁকে দেবনির্দেশ প্রদান করেন। তিনি স্বপ্ন পান যে এই নদীর চড়ায় এক বিস্তীর্ণ বালুভূমিতে মাটি খনন করলে পাথরের দেবী মূর্তি আবির্ভূত হবেন। আর তারপর সেই মূর্তি সেই স্থানে প্রতিষ্ঠা করলে তিনি বংশপরম্পরায় সেই জায়গার রাজা হতে পারবেন। পরদিন সকালে যখন তিনি নৌকা নিয়ে অগ্রসর হন তখন আশ্চর্যভাবে সামনে এক বিস্তীর্ণ বালুভূমি ফুটে ওঠে। আর সেখানে সকলে মিলে খনন শুরু করলে দেবীর স্বপ্নাদিষ্ট সেই মূর্তি প্রকট হয়। কিন্তু সেই সকালে খারাপ আবহাওয়ায় দৃশ্যমান্যতা কম থাকার কারণে দেবী মূর্তি ভুলক্রমে পূর্বমুখী করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাধারণত দেবদেবী মূর্তি দক্ষিণ বা পশ্চিমমুখী করে প্রতিষ্ঠা করাই নিয়ম। কিন্তু পরে সেই সম্বন্ধে বিশ্বম্ভর জানতে পারলে 'ভুল হুয়া' বলে চিৎকার করে ওঠেন। আর সেই থেকে সেই জায়গার নাম হয় ভুলুয়া। যদিও এই লোককথা ছাড়া অন্যমতও আছে। কিন্তু এই কাহিনী আজও লোকের মুখে মুখে ঘোরে। বর্তমানে কুমিল্লা জেলাকে কেন্দ্র করে যে বিশাল ভুলুয়া রাজ্য গড়ে উঠেছিল তার নরপতি হিসাবে এই রাজবংশের প্রতিপত্তি ছিল অপরিসীম। দীর্ঘদিন ধরে বংশপরম্পরায় এই রাজবংশের রাজারা ত্রিপুরা শাসন করে এসেছেন। আর তার মধ্যেই বারবার উঠে আসে বীর রাজা লক্ষণমাণিক্যের নাম। আকবরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিরোধীতায় তিনি কখনো ভয় পাননি। যদিও এক সময় বাকলার নরপতি কন্দর্পনারায়ণপুত্র রামচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়। এবং তিনি শেষ জীবনে রামচন্দ্রের হাতে বন্দিও হন, কিন্তু তাও তাঁর বীরত্বের কাহিনী কখনোই ছোট করে দেখা যায় না। মেঘনা নদী থেকে শুরু করে একেবারে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ছিল তাঁর রাজ্যের বিস্তার। আজও আমরা একটি বাংলা প্রবাদ এর সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত পরিচিত। আর তা হলো 'মগের মুলুক'। আরাকান প্রদেশের এই মগদস্যুদের অত্যাচার রাজা লক্ষণমাণিক্যের সময় থেকেই তীব্র হয়ে ওঠে। তারা মূলত বঙ্গোপসাগর উপকূল অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে বাঙালীদের উপর অত্যাচার ও লুঠপাট করতে শুরু করে। সেই সময় এই অঞ্চলের অধিবাসীরা মগেদের অত্যাচারে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আর তার মধ্যে সামাজিকভাবেও এক অদ্ভুত প্রতিকূলতা সৃষ্টি হয়। আরাকান প্রদেশের মগ অধিবাসীরা যাদের বাড়ির উপর দিয়ে চলে যেত তাদেরকেও সেই সময় একঘরে প্রতিপন্ন করা হতো। সমাজে তাদের বলা হত 'মগীয়'। তাই সেই সময় রাজা লক্ষণমাণিক্যের এই মগদের সঙ্গে লড়াইতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। শোনা যায় ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে এক ভয়ানক বন্যা হয়। যার ফলে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি একেবারে ভেসে যায়। আর তার সঙ্গে ছিল এই মগদের অত্যাচার। সব মিলিয়ে সেই সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলগুলি একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ে। লোকজন ভিটেমাটি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে যায়। সুতরাং পরিবেশ পরিস্থিতিও যে খুব একটা অনুকূল ছিল তা কখনোই বলা যায় না। আর এই সবকিছু নিয়েই গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরা রাজ্য, যা সেই সময় ভুলুয়া বলে পরিচিত ছিল। এমনকি মগ দস্যুরা লক্ষণমাণিক্যের রাজ্যও আক্রমণ করেছিল। তবে রাজা লক্ষণমাণিক্য দুই তিনবার আক্রমণকারী মগদের তাড়িয়ে নিজের অঞ্চলকে সুরক্ষিত করেছিলেন অতি বীরত্বের সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আরাকান রাজের আক্রমণে একবার রাজা লক্ষণমাণিক্য পরাস্ত হন। যদিও শোনা যায় তার পিছনে ছিল বিশ্বাসঘাতক তার নিজের ভাই। আর সেই চক্রান্তের শিকার হয়েই রাজাকে নিজের দেশ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। রাজা লক্ষণমাণিক্যের বীরত্বের কথা এখানে শুরু। ধীরে ধীরে তাঁর সম্রাজ্যের পথ ধরে যত এগিয়ে চলব, তত যেন নতুন করে চিনতে পারব আমাদের বাংলার সেই বীরত্বের দিনগুলি। দেখতে পাব কেমন করে আরো এক ভূঁইয়া মুঘলদের মতো শক্তিশালী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। আর তখনই আমরা বুঝতে পারব বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যে সকল শক্তি প্রাণপণ লড়াই করেছিল, তাদের মধ্যে আমাদের বাংলাও কিছু কম নয়। হয়তো মেবারের রানাদের মত বা মারাঠাদের মত প্রচার এই বাঙালি ভূঁইয়ারা পাননি, কিন্তু বীরত্বের মাপকাঠিতে তাঁরা কোন অংশেই কম ছিলেন না।
0 Comments.