- 3
- 0
১৯৭১ সালে আমি পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় দেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার যা কিছু আছে তাই নিজে শত্রুকে মোকাবেলার আহবান জানানোর পর পরই সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা সারা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। সেই সময় আমার বাবা-মা আমাকে গ্রামের বাড়ি কানসোনায় পাঠিয়ে দেন। আমাদের গ্রাম থেকে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেললাইনের ঘাটিনা রেল ব্রিজের দূরত্ব মাত্র দেড় মাইল। এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে শত্রুসেনা বোঝাই ট্রেন যখন ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন সিরাজগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক শামসুদ্দিন আহমেদ ও ছাত্র নেতা লতিফ মির্জার নেতৃত্বে একদল প্রতিরোধযোদ্ধা ঘাটিনা ব্রিজের স্লিপার খুলে ফেলে ব্রিজের পূর্ব পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। ব্রিজে স্লিপার খোলা দেখে ট্রেন থামিয়ে হায়েনারা যখন তা পর্যবেক্ষণ করতে আসে তখন প্রতিরোধযোদ্ধারা অতর্কিতে শত্রুদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। হঠাৎ আক্রমণের মুখে শত্রুরা সন্মুখে অগ্রসর না হয়ে ঈশ্বরদীতে ফিরে যায়। এই আক্রমণে ৩ জন পাকসেনা ও ৫ জন বিহারি নিহত হয়। এই ঘটনার পর শাহজাদপুরের গাড়াদহ পাকসেনা ক্যাম্প থেকে ঘাটিনা ও আশে পাশের গ্রামের উপর প্রচুর পরিমান মর্টারের গোলাবর্ষণ করা হয়। তার মাত্র কয় দিন পরেই বগুড়া থেকে পাকিস্তানি সেনারা এসে উল্লাপাড়া থানার চড়িয়াশিখা, পাকধাড়ি ও রানীনগর গ্রামে এক নৃশংস গণহত্যা চালায়। এই দিন হায়েনারা ১৫০ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।
দেশের এই উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যে মে মাসের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমি গ্রাম ছেড়ে কাজিপুর থানার শুকগাছা থেকে নৌকাযোগে ভারতের মানকার চরে গিয়ে পৌছাই। সেখান থেকে আমাদের বাংলাদেশের ভেতরের মুক্ত এলাকা রৌমারীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে দেড় মাস অবস্থানের পর জুলাই মাসে একদিন চিলমারী থেকে পাকসেনারা এসে আমাদের রৌমারী ক্যাম্পের উপর কামানের গোলাবর্ষণ করে। তখন আমরা সাময়িক সময়ের জন্য নয়া বন্দর নামক স্থানে ৪/৫ দিন অবস্থান করার পর আবার রৌমারীতে ফিরে আসি। কিন্তু কোন ভাবেই মুকিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছিলাম না। অবশেষে অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে সিরাজগঞ্জ সদরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সৈয়দ হায়দার আলীর হস্তক্ষেপে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়ে আসামের ধুবড়ি থেকে আমাদের শিলিগুড়ির পানিঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। সেখানে ৩০ দিন প্রশিক্ষণ শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তুফানী ব্যাটেলিয়ন নামে একটা ব্যাটেলিয়ন গঠন করা হয়। আমি এই ব্যাটেলিয়নের চার্লি কোম্পানীতে অন্তভর্ূক্ত হই। আমাদের কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ডিএস ডিলন। ৭ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র প্রদানের পর আমাদের ব্যাটেলিয়নকে পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট সীমান্তের নিকট অযধ্যা গ্রামে ডিফেন্সে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে আমরা মাঝে মাঝে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুসেনাদের অবস্থান রেকি করতে যেতান।
ফার্সিপাড়া অপারেশন ঃ নভেম্বর মাসের শেষের দিকে একদিন রাতের বেলায় আমরা তৎকালীন রাজশাহী জেলার ফার্সিপাড়া পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণে বের হই। নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে কমান্ডারের নির্দেশে আমরা গুলিবর্ষণ শুরু করতেই শত্রুরা মেসিনগানের গুলির সাথে সাথে মটার্রের গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমরাও পাল্টা আক্র্রমণ অব্যহত রাখি। প্রায় ১ ঘন্টা গোলাগুলি চলার পর আমাদের প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রদান করা হলো। কোন রকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আমরা নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে এলাম। ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে নিয়মিত যুদ্ধ শুরু হলে আমরা ফুলবাড়ি রেল স্টেশন, পলাশবাড়ি, গোবিন্দগঞ্জ এবং বগুড়া শহরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ১৬ ডিসেম্বর বগুড়া পতনের সাথে সাথে আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়। সৃষ্টি হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। সে সব বীর যোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, আজকের দিনে আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
0 Comments.