Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রবীন জাকারিয়া (অন্তিম পর্ব)

maro news
কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রবীন জাকারিয়া (অন্তিম পর্ব)

(এই ধারাবাহিক গল্পের প্রত্যেকটি পর্বই স্বতন্ত্র৷ বলা যায় একেকটি গল্প৷ তাই একটি পর্বের পর অন্য পর্ব না পড়লেও পাঠকদের অসুবিধা হবেনা৷ তবে প্রত্যেকটি পর্ব পাঠ করলে একটা উপন্যাসের স্বাদ পাবেন বলে আশা করি৷)

ভাই

বড়দার মৃত্যুর পর আমাদের পরিবারটা যেন একেবারে ভেঙ্গে পড়লো৷ বিশেষ করে মা আর যেন স্বাভাবিক হতে পারলো না৷ একদিকে বড়দা'র অভাব আর অন্যদিকে আর্থিক সংকট৷ আমার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটা মস্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল৷ নিকটাত্মীয়রা একটু টিটকিরি মারতে শুরু করলো৷ এটাই আমাকে আর মাকে প্রচন্ডভাবে জাগিয়ে তুললো৷ যুদ্ধ করতে হবে নিরন্তর৷ হয় লড়ে যাও নয় মরে যাও৷ সমস্ত প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে আবারো লড়াইয়ে নেমে পড়লাম৷ এ লড়াই আমার একার নয়৷ আমার বাবা আর বড়দা'র আত্মত্যাগ৷ আমার মায়ের অধরা স্বপ্ন৷ যাকে লালন আর পূরণ করার জন্য তার এত সংগ্রাম৷ এ স্বপ্ন আমাকে পূরণ করতেই হবে৷ দেশ মাতৃকার জন্য যদি এত মানুষ নিজের জীবন অকাতরে দিতে পারে৷ সেই স্বাধীন দেশের সন্তান হয়ে কেন আমি মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো না?

আমাদের এই দূর্দিনে সবচেয়ে বেশি আগলে রাখলো জোতদার তারেক চাচা৷ নিয়তির কী অদ্ভূত ঘটনা! বড়দা'র সাথে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা যখন পাকাপাকি৷ বড়দা তখন অন্যলোকে পাড়ি জমালো! জয়িতা৷ আমার ভাবি৷ যদিও বয়সে আমার ছোট৷ কিন্ত সে আমাদের এই ক্রান্তিকালে সবচেয়ে সাহস জুগিয়েছে৷ যে মেয়ে তার হবু স্বামীকে চিরতরে হারালো৷ তাকেতো আমাদেরই সহানুভূতি জানানো প্রয়োজন৷ নতুবা কিছুই হয়নি ভাব দেখিয়ে তার কেটে পড়বার কথা৷ নিজের ভবিষ্যত চিন্তা করেই৷ অথচ সে সারাদিন মাকে সান্তনা দেয়৷ রান্না-বান্না করে৷ সেবা যত্ন করে৷ এখনো সে মাকে মা বলে ডাকে৷ আর মার এককথা ও হলো আমার বৌমা৷ আমার মেয়ে৷ জোতদার চাচা মেয়েকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে৷ লাভ হয়নি৷ ইদানিং মা একটু চলাফেরা করে৷ আশে পাশে হাঁটে৷ গল্প করে৷ ভাল লাগে৷ সময় পাল্টায়৷ পরিবর্তিত সময়ের সাথে মানুষ খাপ খাইয়ে নেয়৷ এটাই জীবন৷ আসলে সব কিছুই এক সময় স্বাভাবিক হয়ে যায়৷ কিংবা হতে হয়৷ কথায় আছে না Time is the best sealer, killer also. সময় সব ক্ষত মুছে দেয়৷ ধীরে ধীরে আমরাও নতুন স্বপ্নের বাতিঘরের দিকে নাও ভাসিয়ে দেই৷ জীবনের আখেরী লক্ষ যে পূরণ করতেই হবে৷ সমস্ত প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে অবশেষে আমি ডাক্তার হলাম৷ বিসিএস কমপ্লিট করে সরকারী চাকরী পেলাম৷ কর্মএলাকাও আমার পাশের জেলার লাগোয়া উপজেলার হাসপাতালে৷ তাই বাড়ি যাতায়াত প্রতিদিনই বলা যায়৷ মা এখন ভীষণ খুশী৷ তার আচরণে বোঝা যায় জীবন যুদ্ধে জয়ী এক জয়িতা৷ নিজের অজান্তে মাকে স্যালুট জানাই৷ এ শুধু আমার মা নয়৷ হার না মানা এক সংগ্রামী৷ এক বীরঙ্গণা৷

চাকরী পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মা আমার বিয়ে ঠিক করলেন৷ পাত্রী তিনি নির্বাচন করেছেন৷ বড়দা'র মত আমিও বললাম "তুমি যাকে ঠিক করবে আমি তাকেই বিয়ে করবো৷" অবশেষে মার পছন্দের মেয়েকেই আমি বিয়ে করলাম৷ সে আর কেউ নয়৷ আমার হবু ভাবি রেবেকা৷

মা যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ সেটা ঘুনাক্ষরে বুঝতে পারিনি৷ একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি৷ একটা অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে৷ কেন যেন মনে হতে থাকলো৷ বড়দা'র সবকিছুই আমরা হাতিয়ে নিচ্ছি৷ জীবদ্দশায় তার উপার্জন, ত্যাগ এমনকি শরীরের একটা অঙ্গ নিয়েও থেমে থাকলাম না৷ বরং মৃত্যুর পর তার হবু স্ত্রীকেও ছিনিয়ে নিচ্ছি৷ কী লজ্জা! বিষয়টা নিয়ে মা'র সাথে কথা বললাম৷ এ পর্যন্ত জীবনে ঐ একরারই মা'র মুখোমুখি দাঁড়ালাম৷ কিন্ত সে যে ব্যাখ্যা দিল৷ তা আমার সমস্ত অনুভূতি নাড়া দিল৷ মা বললো আমাদের সমাজে ঐ মেয়েকে আর কে বিয়ে করতে চাইবে? আমাদের সবচেয়ে বিপদের সময় যে মেয়েটি এত সাহসের সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছে৷ সাহস আর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে৷ দিন রাত আমার সেবা করেছে৷ তাকে কি ফেলে দেয়ার নাম মানবতা বাবা? তোর বড়দা"র সাথে বিয়ের কথা ছিল৷ বিয়েতো হয়নি৷ তাছাড়া ধর্মীয় বা আইনী কোন বাঁধা নেই যে তুই অপরাধবোধে ভুগবি৷

তবুও বিয়ের প্রথম দিকে আমাদের দু'জনের ভেতরে একটা জড়তাবোধ কাজ করতো৷ পরে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়৷ আমাদের দুটি সন্তান৷ দুটিই ছেলে৷ মা দুই নাতিকে নিয়ে এখন সারাদিন ব্যস্ত৷ আমার ধারণা রেবেকার চেয়ে মা-ই ওদের বেশি তদারকি করে৷ আমরা দুজনেও চাই মা ওদেরকে নিয়ে একটু হৈ-হুল্লোর, আনন্দ-স্ফূর্তি করুক৷ জীবনটাকে উপভোগ করুক৷ সারাটা জীবনতো শুধু কষ্টই করলেন৷ এটুকু তো তিনি প্রত্যাশা করতেই পারেন৷

দাদাবাড়িতে অবহেলিত আর অসম্মানে পড়ে থাকা কবর থেকে বাবার কবরটাকে বড়দা'র কবরের পাশে স্হানান্তরিত করেছি৷ কবরের পাশের আতা গাছটা বেশ বড় হয়েছে৷ যেন মমতা ভরা ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে৷ গাছ ভর্তি কাচা-পাকা আতা৷ ডালে অনেক পাখির বসতি৷ মন ভরা দৃশ্য৷ ভাল লাগে৷ মনে হয় এইতো আমাদের মাঝেই আছে সে৷ আমি দেখছি না৷ কিন্ত সে নিশ্চয়ই দেখছে৷ ভাল থাক তোমরা৷ মানুষের জন্য, নীতির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা দুই যোদ্ধার কবর আর অবহেলিত হতে দেবো না৷ এ আমার অঙ্গীকার৷ এরা আগামীর বিপ্লবীর প্রেরণা৷ এদের মৃত্যু নেই৷

আমার শশুর আর আমি দুজনে মিলে একটা ফাউন্ডেশন তৈরি করেছি৷ নাম দিয়েছি "মানব সেবা ফাউন্ডেশন৷" শশুর একটি বড় পুকুরসহ পাঁচ বিঘা জমি দান করেছেন৷ ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ সম্পৃক্ত হয়৷ যা অভাবনীয়৷ এমনকি দরিদ্র ও প্রান্তিকগোষ্ঠির লোকজন মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে সহযোগীতা করে আসছে৷ এছাড়াও বড়দা'র বন্ধু-সহপাঠিরা দেশ-বিদেশ থেকে আর্থিক সহায়তা অব্যহত রেখেছে৷ বিদেশি বেশ কিছু শুভাকাঙ্খি ও দানশীল ব্যক্তি দরিদ্র কিছু শিশুর Sponsorship child এর নামে অর্থ পাঠান৷ আসলে ভাল উদ্যোগ কখনো বিফলে যায় না৷ পৃথিবীতে এখনো ভাল লোক আছে অনেক৷ শুধু আমরা জানি না৷ সকলের সহযোগীতায় নির্মাণ করেছি ইয়াতীমখানা, আধুনিক মাদ্রাসা৷ স্পোর্টস ক্লাব৷ কারিগরি শিক্ষা৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র৷ যেখানে সমাজের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র মানুষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করে নিজের ও দেশের কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে পারে৷ হয়তো ক্ষুদ্র পরিসরে৷ কিন্ত একদিন এটাকে মানুষ আরো এগিয়ে যাবে৷ কেননা সহজাতভাবেই মানুষ ইতিবাচক পরিবর্তন চায়৷

চাকরীর পাশাপাশি আমি গ্রামে ছোট্ট পরিসরে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছি৷ একেবারে দাতব্য বলাটাও ঠিক হবে না৷ কেননা ১০০/- টাকা ভিজিট নেয়া হয়৷ সবটাকাই দেয়া হয় ফাউন্ডেশনে৷ যাদের সামর্থ নেই৷ তাদেরকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা ও ঔষধ দেয়া হয়৷ উদ্দেশ্য একটাই যেন অবহেলিত মানুষগুলো চিকিৎসা সেবাটা পায়৷ এটা মায়ের শুধু স্বপ্ন নয় আদেশও বটে৷ অফিস, ফাউন্ডেশনের কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে স্ত্রী-সন্তান-মা সকলকে নিয়ে ঘুরতে বেড়াই৷ এখন রাস্তা ঘাট আগের মত নেই৷ গ্রামের রাস্তাও পাকা৷ তাই গাড়ি নিয়ে ঘুরতে সমস্যা হয়না৷ আজ সকলে এসেছি আমাদের সেই স্কুলে৷ স্কুলটার একপাশে নতুন তিন তলা বিল্ডিং হয়েছে৷ অন্যপাশে স্মৃতি বিজড়িত সেই স্কুল ঘর এখনো আছে৷ বিরাট খেলার মাঠ৷ মাঠের এক কোণে গাড়িটা দাঁড় করলাম৷ সবাই নামলাম৷ মাঠে নেমেই আমার ছেলে দুটো ছোটাছুটি শুরু করে দিল৷ কে কাকে ধরতে পারে! মা ওদের পেছনে ছুটতে চাচ্ছিল৷ মানা করলাম৷ কেননা তাকে সংযত থাকতে হবে৷ তিনি হচ্ছেন এক কিডনীওয়ালা মানুষ৷ আমাদেরকে বানোয়াট গল্প বানিয়ে যেটি দান করেছে আমার বড়দা৷ যেটা আজো মা জানে না৷ আমি জানাইনি৷ কেননা তাতে মা আহত হবে৷ মাঠে ঘুরতে ঘুরতেই কখন যে মন্ত্রমুগ্ধের মত পুরাতন স্কুল ঘরের সেই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি৷ যেখানে একদিন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিলাম৷ পাশে মমতা আর ভালবাসায় ভরা বড়দা'র অশ্রুসজল মুখ৷ হেল্যুশিনেশন তৈরি হয়ে আমি যেন নিমিষে সেই মূহুর্তকে দেখতে পাচ্ছি৷ বড়দা বলছে চল বাড়ি যাই৷ মা জিজ্ঞেস করলে বলবি পড়ে গিয়ে মাথা ফেটেছে৷ "তোর খুব ক্ষেদে লেগেছেরে ছোট৷ এই নে আতা ফল৷ খেয়ে নে৷ ভাল লাগবে৷" পিছন থেকে কেউ একজন কথাগুলো বললো৷ আরে এটাতো বড়দা'র কথা৷ তবে কি...৷ ঘুড়ে দেখা মা দাঁড়িয়ে৷ হাতে এক জোড়া আতা ফল৷ মার চোখে ভাল করে তাকিয়ে থাকি৷ কিন্ত একি সেখানে দেখতে পাই বড়দা'র প্রতিচ্ছবি৷ আবেগ আপ্লুত হই৷ মা জিজ্ঞেস করে৷ কিরে ছোট কাঁদছিস কেন? কিন্ত কিছুতেই বলতে পারি না যে ইদানিং আমি মায়ের চোখে দুটো মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাই৷ একটি মা স্বয়ং৷ অন্যটি হলো বড়দা৷

আচ্ছা আমি কি "সাইকো" হয়ে যাচ্ছি? ইদানিং আমি সবকিছুতেই বড়দাকে দেখি৷ মায়ের চোখে৷ রেবেকার মাঝে৷ এই যে মাঠে সন্তান দু"টো ছুটোছুটি করছে৷ একজন আরেকজন ধরে ফেলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা৷ আসলে ওরা কারা? আমাদের সন্তান নাকি কুড়ি বছর আগের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া আকাশচুম্বি স্বপ্ন দেখা সেই সাজু-রাজু! আমি এবং বড়দা৷ প্রিয় দুই ভাই?

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register