Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব - ৭)

maro news
কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব - ৭)

হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ

ইতিমধ্য ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তরবঙ্গের সেবাকাজে আচার্যদেব সর্বশক্তি নিয়ে নামেন। এবং সেবাকাজের শেষে নওগাঁ বা উত্তরবঙ্গ সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। আচার্যদেব চাইলেন সেবার সঙ্গে শিক্ষাকে যুক্ত করতে। পরিচয় হয় দিঘাপাতিয়ার দানশীল জমিদার হেমন্ত কুমার রায়ের সঙ্গে। ওনারই সহায়তায় রাজসাহী শহরে গড়ে উঠল ‘রাজসাহী স্টুডেন্ট হোম।’ছাত্রদেরকে এই পবিত্র পরিবেশের মধ্যে রেখে নৈতিক চরিত্র গঠনের শিক্ষা ও প্রেরণাদানই এই ছাত্রাবাসের উদ্দেশ্য ছিল। সঙ্ঘের ইতিহাসে এই ছাত্রাবাস একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। এই ছাত্রাবাসেরই ১৫/১৬ জন ছাত্র পরবর্তীকালে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী রূপে সঙ্ঘে যোগদান করেন। এই কৃতিত্ব অবশ্যই আশ্রম অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দজি ও শ্রীমৎ স্বামী কৃষ্ণানন্দজির প্রাপ্য।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে গয়া সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হল। গয়া সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠার একটি বিস্তৃত ইতিহাস আছে, যা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মাহাত্ম্যকে বর্ধিত করে।  তীর্থ সংস্কার অধ্যায়ে তা সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার পুরী জেলায় এক ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী বন্যা হয়। সেবাকার্যের শেষে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে  স্থাপিত হয় পুরী সেবাশ্রম। প্রথমদিকে অর্থের অভাবে টিনের ঘরে আশ্রমের সমস্ত কাজ চলতে থাকে। পরে অর্থব্যবস্থায় সামান্য স্বচ্ছলতা এলে সেখানে শিব মন্দির, বিশাল যাত্রীনিবাস নির্মিত হয়।

 ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কাশীতীর্থ সেবাশ্রম গড়ে উঠল। অক্টোবর মাসে কাশীর বিখ্যাত অন্নকুট মেলায় কাশী সেবাশ্রমের পক্ষ থেকে বিরাট সেবাকার্যের ব্যবস্থা হল। এই ধারা আজও অব্যাহত।

সেবছর কাশী সেবাশ্রমেই সঙ্ঘের প্রথম দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হল। দুর্গাপূজার মধ্যে দিয়ে আচার্যদেব জাতির মনে ও প্রাণে নব শক্তির সঞ্চার করলেন।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াগধামে এলাহাবাদে গড়ে উঠল এলাহাবাদ (প্রয়াগ)সেবাশ্রম। প্রথম দিকে একটা ভাড়া বাড়িতে আশ্রম চলত। বেশ কয়েক বছর এভাবেই চলে। পরে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ৯৩নং তুলারামবাগে জমি কিনে স্থায়ী আশ্রম গড়ে তোলা হল। বর্তমানে এখানে বিশাল মন্দির এবং  যাত্রীবাস রয়েছে। প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গমে প্রতিবছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী তীর্থকার্য সম্পন্ন করার জন্য এখানে আসেন। এই তীর্থযাত্রীদের বেশিরভাগই ভারত সেবা সঙ্ঘের আশ্রমে ও আশ্রয়ে  থেকে তীর্থকার্য সুসম্পন্ন করেন।

আচার্যদেব স্থূলশরীরে অবস্থানকালে ১১ টি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যথা-বাজিতপুর, মাদারীপুর, খুলনা, আশাশুনি, নওগাঁ,রাজশাহী,কলকাতার প্রধান কার্যালয়, গয়া, কাশী,পুরী ও এলাহাবাদ। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ বর্তমানে বাংলাদেশে আরো দুটো নতুন আশ্রম স্থাপন করেছে। ঢাকা ও শ্রীরামকাঠিতে। হিন্দুধর্মের ভাব ও আদর্শ ছড়িয়ে দিতে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সঙ্ঘের উদ্যোগে ১৬ টি আশ্রম। এই আশ্রমগুলি ত্যাগী ও গৃহী হিন্দুদের তীর্থস্থান।

।।চারণদল ও ধর্মপ্রচার কার্যাবলী।।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বাজিতপুর পুণ্যধামে সঙ্ঘের প্রাণপ্রতিষ্ঠা। ব্রহ্মচর্য আন্দোলন। ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় সেবাশ্রম স্থাপনা। সঙ্ঘের কাজ যেমন অনেক বাড়ল। আশ্রম ও  যাত্রীনিবাসনির্মাণ,ধর্মপ্রচার,সেবার কাজ পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। আচার্যদেব অর্থ সংগ্রহ এবং ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তখন সৃষ্টি করলেন চারণদল। এই চারণদলে থাকত গায়ক বাদক সহ সন্ন্যাসী ও কর্মীবৃন্দ। সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে চারণদল  হারমোনিয়াম খোল করতাল বাজিয়ে দেশাত্মবোধক ও ভক্তিমূলক গান গাইতে গাইতে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটত। আর দুইজন কর্মী একটি চাদরের চারকোণ ধরে থলির মতো করে সঙ্গে সঙ্গে চলত। অন্যান্য সন্ন্যাসী ও সঙ্ঘকর্মীরা সঙ্ঘের প্রচারপত্র বিলি করে গৃহস্থ ও পথিকদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে ঐ থলিতে রাখতেন।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চারণদল যখন গাইতেন -

“কোথায় ধর্ম, কোথায় সত্য, কোথায় পুণ্য, কোথায় দান।

সুপ্ত দেবমহিমা যে আজি, লুপ্ত ভারতে আর্য্য প্রাণ।।”

এই গান শুনবার জন্য রাস্তার ধারে লোকসমাগম হত। চারণদল প্রসঙ্গে স্বামী বেদানন্দ লিখছেন : “ ‘চারণদল’যেন চলমান আশ্রম; ত্যাগী সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, কর্ম্মিগণ আশ্রমে যেমন নিজস্ব একটি পবিত্র ধার্ম্মিক আবহাওয়ার মধ্যে বাস করে; চারণদলেও ঠিক তেমনি পবিত্র ধর্ম্ম ভাবের আবহাওয়া -ত্রিসন্ধ্যা পূজা-আরতি, ভজন কীর্ত্তন, জপধ্যানাদি অনুষ্ঠানের  ধারা বর্ত্তমান। আত্মানুশীলন এবং নিষ্কাম কর্ম্মযোগ দু’য়েরই সমন্বয় এখানে।” আরো লিখলেন : “এই ‘চারণদলে’র-দেশে দেশে সহরে সহরে, গ্রামে গ্রামে প্রচারের ফলে -অত্যল্প সময়ের মধ্যে সঙ্ঘনেতার ও সঙ্ঘের সহিত দেশের সমগ্র জনসাধারণের যোগ স্থাপিত হইয়া গণসংগঠনের ভিত্তিপত্তন হইয়াছে।”১৫

এই চারণ দলের জাতি ও সমাজের প্রতি আরো কিছু অবদানের কথা স্বামী  বেদানন্দ উল্লেখ করেছেন-

#ইহা ধর্মবিস্তারে ও আদর্শ প্রচারের ধারাবাহিক প্রণালীবদ্ধ পদ্ধতি।

#সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী ও কর্মীগণের এই সংহতি জীবন-যাপন পদ্ধতি একক জীবন যাপনের বিপদ,স্খলন ও প্রলোভন হতে ত্যাগের জীবনকে নিরাপদে রাখে।

#যেকোনো শহরে বা গ্রামে জনসাধারণকে নিয়ে অত্যল্প সময়ের মধ্যে কোন বৃহৎ অনুষ্ঠান সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে হলে (জনসেবা, যাগযজ্ঞ, পূজা মহোৎসব ইত্যাদি) এই চারণদলের  সাহায্যে তা সহজেই সম্পাদিত হয়।

#দেশে কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা বা দৈব দুর্বিপাক উপস্থিত হলে অবিলম্বে যদি তার প্রতিকার ব্যবস্থা আবশ্যক হয়, তাহলে এই চারণদলগুলিই সঙ্ঘের স্থায়ী কর্মীদল সর্বদা কার্যের জন্য প্রস্তুত।

#শক্তি যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন-সংহতিবদ্ধ করলে তার দ্বারা কত বৃহৎ কার্য সম্পন্ন হতে পারে। এই চারণদলের কপর্দ্দক ভিক্ষা ও মুষ্টিভিক্ষা দ্বারা এই বিরাট সঙ্ঘের অসংখ্য কার্যাবলীর ব্যয় নির্বাহ-তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।

প্রত্যহ ১৬ ঘণ্টার কঠোর পরিশ্রম ও  অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন দেশের সমুখে কর্মময়জীবনের আদর্শ দেশবাসীর সামনে স্থাপন করলেন চারণদল।(ক্রমশ)

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register