Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব - ১৩

maro news
কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব - ১৩

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র

এভাবেই রাজা কংসনারায়ণও সরাসরি বিরোধ বাঁধিয়ে বসলেন সুলতানের সঙ্গে। পতন ঘটাতেই হবে কালাপাহাড়ের। বাংলায় ফেরাতেই হবে শান্তি। এদিকে অবস্থা বুঝে নিজের সৈন্যদের প্রস্তুত থাকতে বললেন আফগান নবাব। কিন্তু তখনই ঘটে গেল এক চরম বিপর্যয়। ১৫৭২ সালের ১১ই অক্টোবর দুই পুত্র বায়েজিদ খান ও দাউদ খানকে রেখে মৃত্যু হল সুলেমান করনানীর। তবে একটি দিনও ফাঁকা থাকেনি বাংলার নবাবের মসনদ। যদিও জীবদ্দশায় সুলেমান কখনও নিজস্ব মুদ্রা চালু করেন নি তাঁর সাম্রাজ্যে এবং সরাসরি সংঘাতেও যান নি মুঘল শাহেনসার সঙ্গে। কিন্তু কংসনারায়ণের মত আরও কিছু হিন্দু জমিদারের মিলিত ইচ্ছাশক্তি তাঁর মৃত্যুর পর বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি তাঁর সাম্রাজ্যকে। তাঁর পুত্র দাউদ খান করনানী মদনদে বসলে সরাসরি যুদ্ধ এসে হাজির হয় বাংলার দোরগোড়ায়। কংসনারায়ণও নিজের এস্টেটের সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন দাউদ খানের বিরুদ্ধে।

কালাপাহাড়ের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে আবার বঙ্গপ্রদেশকে মুঘল আয়ত্তে আনার এই সুযোগ হেলায় ছেড়ে দিতে চাইলেন না সম্রাট আকবরও। আব্বাজান হুমায়ুনকে তাড়িয়ে শেরশাহ যখন দিল্লী অধিকার নেয়, তখনই তাঁর আফগান সেনাপতি সুলেমান করনানী সুযোগ বুঝে বাংলা দখল করেন। তখন থেকেই তন্দায় রাজধানী সাজিয়ে বাংলা-বিহার দাপিয়ে শাসন করছেন তিনি। তাই বাংলা দখল নিতে গেলে যে কালাপাহাড়ের অত্যাচারে অতিষ্ট বাংলাবাসীর সামনে দাঁড়ানো আশু প্রয়োজন, সেই তাগিদ বুঝলেন শাহেনসা স্বয়ং। এদিকে একটার পর একটা দেবমন্দির ধ্বংস করছে কালাপাহাড় ওরফে কালাচাঁদ রায় ভাদুড়ী। বাঁ হাতে আঘাত করে ভেঙে ফেলছেন দেবমূর্তি। সেই আক্রোশ থেকে রক্ষা পান নি স্বয়ং পুরীর নীলমাধব জগন্নাথ, কামরূপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কামাখ্যা অথবা ভুবনেশ্বরের অসংখ্য দেবমন্দিরও। সব দেখেশুনে আর সহ্য হয় না বাংলার হিন্দু জমিদারবর্গের। ধর্মরক্ষা করে এস্টেট বাঁচিয়ে নির্বিঘ্নে জমিদারী করাই যেন দায় হয়ে উঠেছে। কংসনারায়ণ তাঁদের মধ্যেই অগ্রগণ্য। সকলে নেতৃস্থানীয় হতে পারেন না। কিন্তু কংসনারায়ণ পেরেছিলেন। তাঁর আর্জিতেই নড়েচড়ে বসল দিল্লীর মুঘল তখ্ত। এদিকে সুলেমানের মৃত্যুর পর বাংলার মসনদে তাঁর পুত্র দাউদ খান। তাঁর অত্যাচারও সুবিদিত। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে কালাপাহাড়ের মত জল্লাদ সিপাহসালার। হিন্দু সংস্কৃতি ও দেবালয় ধ্বংস করতে তার মত দক্ষ যেন ইতিহাসে বিরল। এরমধ্যেই মুঘল গভর্নর মুনিম খানকে শাহেনসা দায়িত্ব দেন দাউদকে শায়েস্তা করার। মুনিম খান রাজা টোডরমল ও রাজা মানসিংহকে সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দাউদ খানের উপর। নেপথ্যে হেসে ওঠেন কংসনারায়ণ সমেত অসংখ্য হিন্দু জমিদারবর্গ। কিন্তু কম যান না দাউদও। জামানিয়া, পাটনা ও আরও কয়েক জায়গায় তুমুল যুদ্ধের পরে রাজমহলে পর্যুদস্ত হন বাংলা বিহারের আফগান নবাব সুলেমান পুত্র দাউদ খান। কালাপাহাড়ের প্রতিরোধ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে মুঘল দক্ষ অশ্বারোহী বাহিনীর সামনে। দাউদ খানের পরাজয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন রাজশাহীর কংসনারায়ণ। বাংলা আবার ফিরে আসে মুঘল আধিপত্যের মধ্যে। বাংলার মানুষ তখন মনেপ্রাণে চেয়েছিল বাংলার সুবেদার হোক প্রজাহিতৈষী রাজা কংসনারায়ণই। সকলে একরকম ভেবেও রেখেছিলেন তাই। কারণ সম্রাট আকবরের সু'নজর সবসময়ই আদায় করে এসেছিলেন কংসনারায়ণ। কিন্তু ইতিহাস সেই ইচ্ছায় মান্যতা দিল না। দিল্লী থেকে অঢেল উপহার, 'রাজা' উপাধির সাথে কংসনারায়ণের জন্য এলো বাংলার দেওয়ানির ভার। কিন্তু সুবেদারীর দায়িত্ব এলো না তাঁর হাতে। শাহেনসাকে সেলাম জানিয়ে সব উপহার অতি বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়েও দিল কংসনারায়ণ। কিন্তু কখনোই চটালেন না বাদশাকে। রাজা টোডরমলের সঙ্গে থেকে সদ্য মুঘল অধিকারে আসা বাংলা প্রদেশের জরিপের কাজে মন দিলেন তিনি। আর বাংলা রক্ষা পেল কালাপাহাড়ের হাত থেকে। আজ যতটুকু প্রাচীন হিন্দুমন্দির ও স্থাপত্যগুলো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, হয়ত তার উদ্যোগটুকু সেইযুগে মনের কোণে জন্ম নিয়েছিল রাজা কংসনারায়ণেরই।

রাজমহলের প্রান্তরে খান জাহান কুলীর নেতৃত্বে পাঠানদের শায়েস্তা করতে বাদশা আকবর প্রেরণ করলেন বিশাল মুঘল বাহিনী৷ বিপরীতেও প্রস্তুত দাউদ খান, কোতুল খাঁ (যাঁর নাম অনুসারে বাঁকুড়ার কোতুলপুর) ও কালাপাহাড়ের নেতৃত্বাধীন আফগান সৈন্য। কেউ কম যান না কোনোভাবে। এর আগেও বহুবার ইতিহাস দেখেছে পাঠান-মুঘল সংঘর্ষ। এবার লড়াইয়ের কেন্দ্র বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ১৫৭৬ সালের ১২ই জুলাই বেশ কিছুদিনের যুদ্ধের পরে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হতে হল সুলেমানপুত্র আফগান নবাব দাউদ খানকে। সেই যুদ্ধেই তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলায় শেষ হল এক কলঙ্কিত রাজনৈতিক অধ্যায়। কালাপাহাড়ের মৃত্যু ঘিরে প্রচুর মতান্তর আছে। কিন্তু দাউদ খানের মৃত্যুর পর যে পাঠান রাজবংশ বাংলা থেকে একেবারে উৎখাত হয়ে যায়, তার সাক্ষ্য ইতিহাস দেয়। কালাপাহাড়কেও আর পাওয়া যায় নি এরপর। এদিকে যুদ্ধে জিতে বাংলা বিহারের বিশাল এলাকা নিজের এলাকাভুক্ত করলেন বাদশা আকবর। যথারীতি ডাক পড়লো রাজা কংসনারায়ণের। টোডরমলের সঙ্গে বাংলার বিস্তীর্ণ জমি জরিপ ও দেওয়ানির কাজের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হল তাঁর উপর। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে টোডরমলকে সহায়তা করে চলেছেন কংসনারায়ণ। সম্রাট আকবরও অগাধ ভরসা করেন কংসনারায়ণকে। সামান্য এক করদ জমিদার হয়েও রীতিমতো সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তামাম হিন্দুস্থানের আলমপনা আকবরের থেকে। সাধে কি আর মুঘল বাদশা বাবর বাঙালী জমিদারদের দাপটে বিব্রত হয়ে রাগে বলে বসেছিলেন "এই বাঙালীদের আমি দেখে নেব"। যাই হোক, সব হচ্ছিল নির্বিঘ্নেই। কিন্তু হঠাৎ আগ্রার দরবার থেকে জরুরি তলব এলো রাজা টোডরমলের। বাংলা ছেড়ে তাঁকে ফিরে যেতে হবে আগ্রায়। কিন্তু তখনও নির্বিঘ্নে শেষ হয়নি বাংলার জমি মাপজোপ ও জরিপের কাজ। টোডরমলকে আশ্বাস দিলেন কংসনারায়ণ। শাহেনসার ডাকে নিশ্চিন্তে ফিরে যেতে বললেন তাঁকে এবং সমস্ত দেওয়ানির কাজ একাহাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার আশ্বাস দিলেন তিনি। বন্ধুরাজার আশ্বাস পেয়ে নিশ্চিন্তে আগ্রা ফিরে গেলেন টোডরমল। এদিকে কংসনারায়ণের উপর এসে পড়লো পাহাড়প্রমাণ কাজের চাপ। স্বয়ং শাহেনসার আদেশ। তাঁর প্রতিনিধিরূপেই সমস্ত বাংলা-বিহারের জমি জরিপের কাজে নেতৃত্ব দিলেন তিনি। নিজের এস্টেটের কাজ সামলানোর সাথে সাথে বাদশার কথামতো নতুন মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত বাংলার জমি ও সীমানা জরিপ সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র গুছিয়ে আগ্রায় পাঠিয়ে দিলেন কংসনারায়ণ।  জমিদারী সংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতায় ভর করে আগ্রার সরকারী কাজে নিজের মুন্সীয়ানা দেখিয়ে বাদশার একেবারে কাছে চলে এলেন বাংলার তাহিরপুরের বাঙালী জমিদার কংসনারায়ণ।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register