Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কর্ণফুলির গল্প বলায় আনোয়ার রশীদ সাগর

maro news
কর্ণফুলির গল্প বলায় আনোয়ার রশীদ সাগর

একটি পরিবারের গল্প

পৃথিবীজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতঙ্ক যেন প্রকৃতির মাঝেও। ঝড়বৃষ্টি-বন্যা-খরা পাল্লা দিয়ে পাশাপাশি চলছে সমান্তরাল রেখায়। এরই মধ্যে হাজার-হাজার পরিবারের মত এ পরিবারটিও নিঃস্ব হতে থাকে। শাওন ও শ্রাবণ দুই ভাই,সরল-সুন্দর প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা সন্তান। শাওন মাস্টার্স করে চাকুরীর প্রত্যাশায় এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত ঘুরে পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয় করতে শুরু করেছে। শ্রাবণ কেবল অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। হেসে-খেলে চলছিল তাদের সোনালি দিনগুলো। হঠাতই পৃথিবী গিলে খাবার মত হায়েনার থাবা নিয়ে, করোনার থাবা এসে গ্রাস করতে শুরু করেছে মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্খা। বিজ্ঞানী,বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার ও বিশ্বনেতাদের আহ্বান আসে,ঘরে থাকুন-সুস্থ থাকুন-সুরক্ষিত থাকুন। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে,লেখাপড়ার ইতি টেনে শাওন ও শ্রাবণ, অনেকদিন পর যত্নে-আদরে মায়ের হাতের রান্না খায় আর বাড়িতেই থাকে। কিন্তু তাদের বাবা রফিক সাহেব তো বাড়ি থাকতে পারে না,সৎ ও নিষ্ঠাবান লোকটি প্রতিদিন স্থানীয় একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে যায়-আসে। তার ভাগ্যে আর জোটে না কোনো ছুটি,জোটে না একটু জিড়িয়ে নেওয়ার সুখ । মাস তিনেক যেতে না যেতেই দূর্ভাগ্যক্রমে রফিক সাহেবের সর্দি-কাশি-জ্বর হয়। পরীক্ষা করে,করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। কী আর করা?- চিকিৎসাও তেমন নেই। তবুও ভর্তি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। শুরু হয় ব্যাপক শ্বাস কষ্ট। অক্সিজেন না পাওয়ার কষ্টে পেটটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে,একবার ওঠাতে চায় আর একবার নামাতে চায়। কিছুতেই শান্তি পায় না। অনেকবার চেষ্টা করে জোরে-জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। তারপরও অক্সিজেন না পেয়ে,রফিক সাহেব ঘোলা চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। দ্রুত নিয়ে যায় জেলা সদর হাসপাতালে। তারপর প্রাইভেট হাসপাতালে। এপরীক্ষা-সে পরীক্ষা করতে করতেই শাওনের আম্মুর পকেট খালি হয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন সহযোগিতা করার মত তেমন কেউ নেই। মামাটাও এনজিও চাকুরী করে,পাঠিয়েছে তিন হাজার টাকা,তার কোনো ছুটি নেই। থাকলেই বা কী?- করোনা রুগীর কাছে তো কেউ যেতে পারে না। তাই মনে মনে কষ্টের পাথর বুকে বেঁধে সৃষ্টিকর্তার কাছে বারবার প্রার্থণা করতে থাকে রফিক সাহেবকে ভালো করে দাও মহান। নানাও বৃদ্ধ মানুষ, দিয়েছে দু'হাজার টাকা। গ্রামে এক চাচা রয়েছে,তিনি দরিদ্র মানুষ। টাকা-পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। শুধু একদিন টিফিন বাটিতে খাবার এনে, শাওনের হাতে দিয়ে,গামছায় চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে গেছে। করোনা রুগীর সাথে দেখা করতে না পাওয়ার কারণে , তার চোখের দেখাটাও হয়নি। সকল কষ্ট ও দুঃখের অনুভূতি শাওনকে ধীরে ধীরে গ্রাস ধরতে থাকে। এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন কখনো হয়নি সে। শ্রাবণ ও তার মা নাছোড় বান্দা। শ্রাবণ তার বাবার সঙ্গ ছাড়তে চায় না,একই অবস্থা রফিক সাহেবের গৃহিনী রজনীর। সেও স্বামীর সঙ্গ ছাড়তে নারাজ। তাই সকল সময়-সকলখানে রফিক সাহেবের পাশে পাশে রয়েছে দুটি প্রাণ। অপরদিকে কিছুটা পরিপক্ক শাওন টাকা জোগাড় ও ঔষধপত্র সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। তাও কী শেষ রক্ষা হয়? একটি মাত্র ফুফু এসে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বুক থাবড়াতে-থাবড়াতে দেখার চেষ্টা করে,ভাই ভাইগো,একবার তোমার মুখখান দেখবো গো। তার কান্নার শব্দে কেঁদে ওঠে আকাশ-বাতাসও। অঝর ধারায় বৃষ্টি হতে থাকে। এই রোদ-এই বৃষ্টি। মাঝে তীব্র গুমসো-গরমও। রুগী বা রোগের কাছে আবেগের কোনো স্থান থাকে না। তাই তাদের হতভাগী ফুফু কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরে যায়। যাওয়ার আগে শাওনের হাতে নিজের গলার সোনার হারটা দিয়ে বলে,বাপ -গো আমার কিছু নেই।এই হার-ডা বেচি আমার ভাইকে ভালো কইরি তুলবা। ফুফুকে জড়িয়ে ধরে শাওনা হাও-মাও করে কাঁদতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ফুফু বাড়ির পথে রওনা দেয়। নিরুপায় শাওনা হারটাও বিক্রি করে দেয়। তারপর ডাক্তার এসে বলে,আইসিইউতে নিতে হবে। দৈনিক খরচ ত্রিশ হাজার টাকা। দুদিন আইসিইউতে রেখেই টাকা শেষ হয়ে যায়। চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকে শাওন। এমন সময় শাওনের বান্ধবী একটা চার-চাকার গাড়িতে এসে নামে। শাওন থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে চলে যায়। শাওন তাকিয়ে থাকে গাড়িটির দিকে। যে মেয়েটি বিকেল হলে পার্কে যেতো,সঙ্গছাড়া হতে চাইতো না, সেই মেয়েটি দুটি কথা বলেই চলে গেল! এই মেয়েটির জন্য মায়ের কাছে বারবার আবদার করে, বাবার অফিসে যাওয়ার মোটরবাইকটি বিক্রি করে,মায়ের গলার হার বিক্রি করে, দুইলাখ টাকা দিয়ে মোটর বাইকটি কিনেছিল। সেই বাইকে চড়ে সকাল-বিকাল দু'জনে একসাথে কত-কত মাস-দিন একসাথে ঘুরেছি। ব্যথায় বুকটা টনটন করে ওঠে শাওনের। স্মৃতির পাতায় ঝরঝর করে রক্ত ঝরে,মনের কোণে কষ্টের বরফ জমতে থাকে। সীদ্ধান্ত নেই, মোটরবাইকটাও বিক্রি করে দিবে,বাবাই তার সব,চিকিৎসা করতেই হবে। কাঁচের ফাঁক দিয়ে বাবার মুখটা একবার দেখে নেয়। চোখ ছলছল হয়ে আসে। ক্লিনিক থেকে বাইরে এসে তার মোটর বাইকটি আর দেখতে পায় না। খুঁজতে-খুঁজতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,এইমাত্র বারান্দার পাশে রেখে ভিতরে গিয়েছিল,আর গাড়িটি উধাও! কান্না কী করে থামায়?- সব বাঁধা ডিঙিয়ে মায়ের আঁচলকোলে জোর করে, মুখ রেখে হুহু করে কাঁদতে থাকে। শ্রাবণও চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, আব্বা-গো,আব্বা। কোনো চিৎকার বা কান্না শুনতে পায় না সৃষ্টিকর্তা। আইসিইউ থেকে সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশ বেরিয়ে আসে। কোথায় যাবে তারা,কিভাবে বাড়ি পৌঁছাবে লাশ! টাকা-পয়সা সব শেষ। অপেক্ষা আর দূরাশায় চলতে থাকে কয়েক ঘণ্টা। অশ্রুসিক্ত রক্তাক্ত চোখ হঠাতই চকচক করে ওঠে। দুঃখের অথৈই সাগরে ডিঙির দেখা মেলে।- গ্রামের এক কৃষক বিকেলে নসিমনে একটা রুগী নিয়ে এসেছে। সে নসিমন ওয়ালাকে অনুরোধ করে লাশ উঠিয়ে রওনা দেয় বাড়ির পথে।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register