Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব - ১২

maro news
কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব - ১২

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র

বাংলার আরেক প্রসিদ্ধ অঞ্চলের নাম তাহিরপুর। সেখানকার রাজ পরিবার বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কুলের বংশজাত। এই পরিবারের আদি পুরুষ হিসাবে মনুসংহিতার টীকাকারক কল্লুকভট্টের নাম পাওয়া যায়। এই বংশের উদয়নারায়ণ রায় গৌড়বাদশা গণেশের শ্যালক ছিলেন বলেও জানা যায়। তাহেরপুর রাজ্য আগে মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত ছিল। বর্তমানে এটি রাজশাহী পরগনার অধীনে পড়ে। এই রাজবংশের সবথেকে প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন কংসনারায়ন রায়। আজ বলব সেই দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজার গল্প। বাংলার যে বারো ভুঁইয়ার হাঁকডাকে স্বয়ং শাহেনসা আকবর পর্যন্ত দাঁত ফোটাতে পারতেন না বঙ্গের আনাচেকানাচে, জাহাঙ্গীর তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাপতি মানসিংহকে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গ দখলের জন্য, তাদের মধ্যেই একজন হলেন তিনি। রাজশাহী পরগনার তাহিরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ রায়। ধারে ও ভারে তখন তাঁর নামডাক সারা বাংলা জুড়ে। বাংলার মসনদে তখন পাঠান নবাব সুলেমান করনানী। এদিকে তাঁর সেনাপতি কালাপাহাড়ের অত্যাচারে অতিষ্ট সারা বাংলাবাসী। একে একে সে ধ্বংস করে চলেছে সমস্ত হিন্দু মন্দির। ধর্ম নষ্ট করছেন হিন্দু প্রজাদের। সব দেখেশুনে আর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না কংসনারায়ণ। সোজা নালিশ জানালেন নবাবের দরবারে। কিন্তু হিন্দু রাজার আর্জিতে কর্ণপাত করছে কে? যথারীতি সুরাহা হল না কোনোমতেই। ছাড়বার পাত্র নয় রাজা কংসনারায়ণও। গোপন বৈঠকে বসলেন সিন্দুরীর জমিদার কালীদাস রায়, সাঁতোরের গদাধর সান্যাল, দিনাজপুরের গোপীকান্ত রায়ের সাথে। রুদ্ধদ্বার সেই বৈঠকে সেদিন ঠিক হল পাঠান উৎখাতের ব্লু প্রিন্ট। এরপর জমিদার কংসনারায়ণ নিজে উপস্থিত হলেন একেবারে আগ্রায়। সম্রাট আকবরের কাছে পেশ করলেন পাঠান শাসিত বাংলার দুরবস্থার কথা। একে একে তুলে আনলেন হিন্দু-মুসলিম অনৈক্যের পরিবেশ ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনা থেকে করনানী-কালাপাহাড়ের সমস্ত উৎপীড়নের কথা। সেদিন বাদশাকে নিজের বাকচাতুরতা দিয়ে মুগ্ধ করলেন বাঙালী যুবক কংসনারায়ণ। বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ তুলে ধরে বাদশাকে পাঠান অত্যাচারের সমস্ত কাহিনী বর্ণনা করলেন তিনি। সুবক্তা ও ঝকঝকে বাঙালী যুবক কংসনারায়ণের প্রভাবে রীতিমতো আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তামাম ভারত ভূখণ্ডের একছত্র অধিপতি জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর। বাংলার করুণ অবস্থার কথা তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠলো। সেইদিনই রাজশাহীর এক সামান্য জমিদার কংসনারায়ণকে পাঠানমুক্ত এক নতুন বাংলার আশ্বাস দিয়ে বসলেন সম্রাট। বাংলার বিপন্ন মানুষ জানতেও পারল না যে তাদের স্বার্থে জমিদার কংসনারায়ণ কিভাবে এক এক করে সাজিয়ে চলেছেন দাবার ঘুঁটি। আগ্রাতেও রাজদরবারে নিজের বাকচাতুরতা দিয়ে সকলের নজর কেড়ে নিতে এতটুকু সময় লাগেনি কংসনারায়ণের। তিনি বাংলার স্বার্থে সেদিন পাঠান নবাবের সরাসরি বিরোধিতা করে শাহেনসাকে নালিশ জানাতে বিন্দুমাত্র ভাবেন নি। নিজের পরগনাটুকু নয়, তাঁর চোখে লেগেছিল এক স্বাধীন ও সম্প্রীতির বাংলার স্বপ্ন। অত্যাচারী কালাপাহাড়ের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছিল তাঁর অবাধ ছুটে চলা। কালাপাহাড়। ওরফে কালাচাঁদ রায়। আসলে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়েও অবাধে নষ্ট করেছেন বাংলা ও উড়িষ্যার অসংখ্য দেবদেউল। এমনকি হানা দিতে ছাড়েননি পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে কোনার্কের সূর্যমন্দির পর্যন্ত। নবাব সুলেমান করনানীর জামাই এই কালাপাহাড়ের অত্যাচার কাহিনী যতই বলা যায়, ততই যেন কম পড়ে যায়। নবাবের কন্যাকে বিয়ের সূত্রে তার মুসলিম ধর্ম গ্রহণ। আর তারপরেই সরাসরি হিন্দুবিদ্বেষ প্রদর্শন। কোথা থেকে এলো তার হিন্দু সনাতম সমাজের প্রতি এত ক্ষোভ? সে আলোচনা তোলা থাক অন্য কোনো ধারাবাহিকে। এখন ফিরে আসি নবাব সুলেমান, কালাপাহাড় ও কংসনারায়ণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তখন সুলেমানের রাজধানী ছোট্ট সবুজ গ্রাম তন্দা। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যায় মহানন্দা। একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ে প্রাসাদ তৈরি করে ঝকঝকে নগরে পরিণত করেছেন আফগান সুলতান সুলেমান। তারই দরবারে দেওয়ানের পদে আসীন রয়েছেন কংসনারায়ণ। তরুণ কংসনারায়ণের দক্ষ জরিপ বিদ্যা ও দেওয়ানির কাজ চারিদিকে প্রশংসিত। কিন্তু শুধুমাত্র নিজের চাকরি বাঁচানোর জন্য জমিদার কংসনারায়ণ আপোষ করবেন নিজের এস্টেটের সাথে, প্রজাদের সাথে, এমন মানুষ নন তিনি। কালাপাহাড় ও সুলেমানের বিরুদ্ধে বাদশা দরবারে নালিশ জানানোর আগে নির্দ্বিধায় জবাব দিলেন নবাবের চাকরিতে। নবাব সুলেমানও ঠিক আঁচ করতে পারেন নি এক সামান্য জমিদারের ক্ষমতার ব্যাপ্তিটা। যাই হোক, ছাড়বার পাত্র নন তাহিরপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার কংসনারায়ণও। আগ্রার দূর্গে পৌঁছে আকবর বাদশার আশ্বাস আদায় করে তবে ছাড়লেন তিনি। আগেই বলেছি যে বাংলা তখন সম্পূর্ণ মুঘল শাসনাধীন ছিল না। পাঠান সুলতানের শাসনে বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক চেহারা তখন খুব অস্থির। বিচক্ষণ হিন্দু জমিদাররা সকলেই চিন্তা করছেন পাঠান রাজবংশ পতনের। তারমধ্যে বারো ভুঁইয়ার কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বিরের পাঠান বিরোধিতার কথাও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। বাংলার জমিদারদের এই তীব্র বিরোধিতাই যে সুবে বাংলার আফগান পতন ও মুঘল সালতানাতে অন্তর্ভুক্তির কারণ তা সহজেই বলা যায়।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register