Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গদ্যের পোডিয়ামে অমিতাভ সরকার

maro news
গদ্যের পোডিয়ামে অমিতাভ সরকার

ওগো বরষা তুমি ঝোরো না গো

ওনাকে নিয়ে লিখতে খুব ইচ্ছে করে কিন্তু কতটাই বা জানি, যা কিছু জানা সব খবরের কাগজ নয়তো কিছু বই তাও তার সত্যতা সম্বন্ধে কিছু কিছু জায়গায় সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়, সেই সব মানুষগুলোকে তো আজকে আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। বিদগ্ধজনের মুখের লেখা কথা, বিশেষ কোনো সংখ্যা প্রভৃতির নির্ভর করে যা এগোনো। আর আজকের দিনে তথ্যপ্রযুক্তির মুঠোফোনের সাহায্যে যতটা জানা সম্ভব এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলেও কিন্তু তাতে আনন্দ হয় না। তবু মনের অন্তস্থল থেকে যতটা শ্রদ্ধার্ঘ্য দেওয়া যায়, যতটা দিতে পারি তা দিয়েই মনকে শান্ত করতে হয়।

লেখা দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছে। যাকে নিয়ে লিখতে বসেছি মানুষটার নাম যে নচিকেতা ঘোষ। কি চিনতে পারলেন? পারলেন না তো! ’কাহারবা নয় দাদরা বাজাও', 'হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’ গানগুলোর কথা, সুর কি শোনা শোনা লাগছে? অথবা ’মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা'। কত গানের কথা আর উল্লেখ করব! বলতে শুরু করলে যে আর সারাদিন লেগে যাবে, তবু শেষ হবে না!

কে কার গানের স্বরলিপি লিখবেন সেটা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জানেন, কিন্তু এই সুরগুলো যে বিনা মেঘে চোখের জল নিয়ে আসে মানুষটাকে নিয়ে কোনদিন ভেবে দেখেছি আমরা! নচিকেতা ঘোষ। মাত্র ৫১ বছরের আয়ুষ্কাল। এর মধ্যেই এত খ্যাতি কিন্তু যখন সম্মানটা পাবার সময় এল সে সময় মানুষটা চলে গেলেন। তারপর যা হয় তাই। সামান্য ক'টা চেনা গানের সুরকার হিসেবে তাকে যতটুকু জানা, ব্যস এইটুকুই। বুঝিনা কেন গানের শরীর, স্বরবিন্যাস, রাগরাগিনীর চলন ছাড়া মানুষের আর কিছু কি জানার থাকতে পারে না। কিভাবে সুর করতে তার ভিতরের ভাবনা এগুলো আলোচনা করার জন্য মানুষের যেন আজ আর সময় নেই। সবার যে যার মতো ছুটছে। ইচ্ছে হলে ফোনে Youtube গানটা নেট সার্চ করে বার করলেই হল। গান তৈরির থিকুচিকুষ্টি কার আর শোনার সময় আছে। পাঠকরা মনে করতে পারছেন, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের 'বনে নয় মনে মোর পাখি আজ' গানটায় রাগ, সরগম, ব্যঞ্জনা কোন উচ্চতায় শ্রোতার মনকে পৌঁছে দিয়েছে। যিনি নিজে খেলাধূলা ভালোবাসতেন তাঁর সুরে নানা ভ্যারিয়েশান থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।

এই মানুষটাকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন সিনেমা চলেনি কিন্তু গানগুলো সুপারহিট হয়েছে এটা যেন নচিকেতা ঘোষের পক্ষেই সম্ভব। 'শেষ দেখা সেই রাতে', 'এক তাজমহল গড়ো'- গানের মরমি শিল্পী পিন্টু ভট্টাচার্য বলেছেন তার কাছে শিল্পী থাকতো প্রধান, কোনো নাম না। তার সুরে এক অনন্য বৈচিত্র‍্য ছিল। আধুনিক বাংলা গান, চলচ্চিত্রের গান এমনকি হিন্দি উড়িয়া প্রভৃতি প্রাদেশিক ভাষার গানেও যথেষ্ট পারদর্শিতার সাথে সুর করেছেন। লিখতে বসে দেখলাম ওনাকে ভারতের সবথেকে প্রশংসনীয় সুরকার হিসাবে উল্লেখ রয়েছে উইকিপিডিয়ায়। একাধারে, গীতিকার সুরকার এবং গায়ক। বড়োদের পাশাপাশি বাচ্চাদের রাক্ষস খোক্ষসের গান, ছড়ার গান, এমনকি যত বিশেষ ধরনের গান খুব সার্থক ভাবে করেছেন এবং প্রায় সবই এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, ললিতা ধর চৌধুরী, জপমালা ঘোষ, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মিন্টু দাশগুপ্ত, আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলা বসু, নীতা সেন, রবীন মজুমদার, মৃণাল চক্রবর্তী, বাণী ঘোষাল, ইলা চক্রবর্তী, শচীন গুপ্ত, গায়ত্রী বসু, মৃণাল চক্রবর্তী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, ভূপেন হাজারিকা এমনকি উত্তমকুমার, বিশ্বজিতকে দিয়েও গান রেকর্ড করিয়েছেন, এবং এখনো তা সমান কৌতূহলের সৃষ্টি করে। মানুষটাকে তৎকালীন শিল্পীরা সবাই সমীহ করে চলতেন, শ্রদ্ধাও করতেন আবার ভালোওবাসতেন।

জন্ম ২৮ শে জানুয়ারি, ১৯২৫। বাবা ডাঃ সনৎকুমার ঘোষ বিশিষ্ট প্রথিতযশা ডাক্তার ছিলেন। একসময় বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসক হিসাবেও উনি কর্মরত ছিলেন। এহেন বাবা চাইতেন ছেলে ডাক্তারি পড়ুক। পড়েওছিলেন। কলকাতা আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করলেও গানই হয়ে দাঁড়াল তাঁর পেশা ও নেশা। শ্যামবাজারের বাড়িতে বিখ্যাত সব শিল্পীদের নিয়ে গানের আসর বসতো।ভালো তবলা বাজাতেন। আর এখান থেকেই এক অমোঘ ভালোবাসার জন্ম। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই অসাধারণ সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে নিজের স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করেন। মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি শিল্পীর আধুনিক গান বা সিনেমার গানে কালজয়ী ইতিহাস সৃষ্টি কিন্তু তাঁদের প্রিয় 'নচিবাবু'-র হাত ধরেই।

লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া 'অসমাপ্ত' সিনেমায় 'রিমিকি ঝিমিকি ছন্দে', আশা ভোঁসলে তাঁর প্রিয় 'ঘোষদা' -র সুরে গেয়েছেন 'ফরিয়াদ', 'মৌচাক', 'স্বয়ংসিদ্ধা', মান্না দে-র তো 'সন্ন্যাসী রাজা', 'স্ত্রী' 'হোটেল স্নো ফক্স', 'নিশিপদ্ম'-'না না আজ রাতে আর যাত্রা','যা খুশি ওরা বলে বলুক', 'আনন্দমেলা'-প্রভৃতি সিনেমায় তাঁর ধরনের গানগুলোয় জমিয়ে দিয়েছেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় 'ইন্দ্রাণী', 'পৃথিবী আমারে চায়', 'হাত বাড়ালেই বন্ধু' প্রভৃতি সিনেমায় অসাধারণ সব গান গেয়েছেন নচিকেতা ঘোষেরই সুরে। গানগুলো আমার নিজেরই খুব প্রিয়। 'বন্ধু' সিনেমায় 'মৌ বনে আজ মৌ জমেছে', 'মালতি ভ্রমরে করে ওই', ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য 'নবজন্ম' সিনেমায় 'আমি আঙুল কাটিয়া', সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় 'চাওয়া পাওয়া' সিনেমায় 'এই যে কাছে থাকা', 'চিরদিনের' সিনেমায় 'আমি অভিসারে যাব', 'বিলম্বিত লয়' সিনেমায় আরতি মুখোপাধ্যায়ের 'এক বৈশাখে দেখা হলো', এমনকি মহম্মদ রফিকে দিয়েও 'ইন্দ্রাণী' সিনেমায় হিন্দি গান গাইয়েছেন, যা সিনেমাটায় একটা অনন্য দৃশ্যায়ণ ঘটিয়েছে। গানের সুরটা এতো ভালো লেগেছিল রফিসাহেব এর জন্য কোনো পারিশ্রমিকই নেননি। নচিকেতা ঘোষ নিজেও চমৎকার গায়ক ছিলেন, গ্রামোফোনে একার কণ্ঠে তাঁর গান বেরিয়েছিল।

ওনার ছেলে সুপর্ণকান্তি ঘোষ নিজেও একজন দারুণ সুরকার। ১৯৮৩ সালে মরমী গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা, সুপর্ণবাবুর সুরে মান্না দে-র গাওয়া 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই' ২০০৬ সালের বিবিসি-র হিসাবে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে।

নচিকেতা ঘোষের স্ত্রীর নাম শিবাণী দত্ত। দুই মেয়ে শ্রাবণী ও সম্পূর্ণা ঘোষ। বিশাল মাপের এই মানুষটা চলে গেছেন সেই ১২ ই অক্টোবর, ১৯৭৬ সালে। ওঁরা তখন হয়তো খুব বড়োও হননি। তবে আজও তাঁদের মহীরুহ বাবার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে স্মরণের বালুকাবেলায় মনের রোদ খুঁজে চলেন।

কিন্তু ভাবলে আশ্চর্য লাগে এই রকম ব্যতিক্রমী সুরস্রষ্ঠাকে কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতি দেওয়ার কথা তখন বা এখন কারো কেন মাথায় এলো না? আজ যখন অনেক বেশি করে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন, বেশি করে পড়াশোনা করা, চেনা উচিৎ তখন আমাদের সেই আগ্রহটা আজ কোথায় হারিয়ে গেল, কেন হারিয়ে গেল!

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register