Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গদ্যের পোডিয়ামে ঋতশ্রী মান্না

maro news
গদ্যের পোডিয়ামে ঋতশ্রী মান্না

হৃৎপদ্ম

ঠিক এমুহূর্তে আমি যে পান্ডববিবর্জিত স্থানে দাঁড়িয়ে আছি,তার মূল কারণ হরিদাস। সে আমায় ডেকেছিল বটে তার বাড়ির পুজোয়,তবে সে আশা করেনি আমি সত্যিই পৌঁছে যাব এসে। তার অপ্রস্তুত ভাব অন্তত সে কথারই সাক্ষ্য দেয়। অবশ্য সে কেন,আমিও আশা করিনি,আমি আজ,এমুহূর্তে হরিদাসের উঠোনে এসে উপস্থিত হব। কেন এলাম,এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। হরিদাসের মন্দিরের কালীপ্রতিমা ভারি জাগ্রত,এ সম্বন্ধে নাকি বহু জনশ্রুতিও আছে। যদিও সে জনশ্রুতির গল্প হরিদাস ছাড়া আর কারুর মুখে শুনিনি কখনও। হরিদাসের বাড়ি শহরের এমনই জনবিরল প্রান্তে,সে স্থানে এমন ভরসন্ধেয় আমার মত সংশয়লালিত মানুষ পুজো দিতে হাজির হতে পারে,এমন কল্পনাও হরিদাসের ভাবনার ত্রিসীমানায় ছিলনা। হরিদাসকে আমি দীর্ঘকালযাবৎ চিনি,এমনও নয়। এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে তার সাথে আমার পরিচয়। সে পরিচয়ও তেমন নিবিড় কিছুনা। তবুও কেন আমি এলাম,সে প্রশ্ন আমারও। মনকে বোঝাই,সম্ভবত আমি বাড়িতে বসে বোর হচ্ছিলাম।

তবে আমি আসাতে হরিদাস যে সবিশেষ খুশি,তা তার হাবেভাবে বেশ প্রকাশ পাচ্ছিল। তার বউ একখানা স্টীলের রেকাবিতে দুটি গজাজাতীয় মিষ্টি এনে দিলে,মিষ্টি আমার তেমন পছন্দ নয়,তাছাড়া এমন অসময়ে মিষ্টি খাওয়ার প্রশ্নও নেই। হরিদাস আমায় মন্দির দেখাতে নিয়ে এল,জঙ্গলাকীর্ণ খাসজায়গার ওপর বাড়ি। মাটির,তবে নেহাত ছোটো না।বাড়ি তার দাদুর আমলের। বাড়ির পাশে টানা লম্বাটে উঠোন,উঠোনের শেষপ্রান্তে কুয়ো,তারও থেকে বিশহাত মত দূরে মন্দিরটি। পাকার। হরিদাস বলল," মন্দির হয়েছে বেশিদিন না,বছরতিনেক। এবছর মায়ের কৃপায় রোজগারপাতি মন্দ হয়নি,,তাই দিয়েই টাইলস বসিয়েছি মন্দিরে।" মন্দিরটি বেশ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমায় মন্দিরে বসিয়ে রেখে হরিদাস চলে গেল,পুরোহিতমশাইকে আনতে যেতে হবে তাকে।

মন্দিরের ভেতরে বাল্বের অল্প আলো, মন্দিরের ছোট চাতাল ছাড়িয়ে সে আলো সামান্য কিছুদূর গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। আশেপাশে এক দুটি ভিন্ন আর কোনো ঘরবাড়ি নজরে পড়েনা,চারিপাশ অন্ধকার। আমার পুজো দেওয়ার জন্য সাজিয়ে আনা থালাটি নামিয়ে রাখি প্রতিমার পদপ্রান্তে। শিরশিরে নৈঃশব্দ্য চারদিকে। আয়োজনের আড়ম্বর নেই,ভক্তসমাগম নেই। বাইরে ধূ ধূ চরাচর আর ভেতরে এই একাকিনী প্রতিমা,রক্তজবার ফুলমালায় সজ্জিতা, কী অদ্ভুত রহস্যের মত জেগে আছে একে অপরের মুখে চেয়ে! মধ্যিখানে কেউ নেই,কিছু নেই...পুজোও নেই। কেবল শূন্য,অনন্ত শূন্যের মত মহাকালে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে চতুর্দিক। তাকিয়ে থাকলে ঘোর লেগে যায়। কতক্ষন এভাবে বসেছিলাম জানিনা। মনে হচ্ছিল,মহাকালের সমুদ্রের এই কালখণ্ডটুকু আমার ই জন্য। এই ক্ষণটুকু আমারই জন্য পূর্বনির্ধারিত ছিল। কিছু অনুভব শব্দাতীত। জানিনা,কী সেই যোগসূত্র,যা আমাকে অদৃশ্য টানে টেনে আনল এমন দুর্জ্ঞেয় অন্ধকারে!মন্দিরের মেঝপ

লাল জবার মালা গলা ছাড়িয়ে নেমে এসেছে নীচে। মালার শেষপ্রান্তে পুরোহিত এসে পড়েছেন। ধীরে ধীরে যত পূজার সময় এগিয়ে আসতে লাগল,মন্দিরের চাতালে উপাচারসহ জনাকয় মহিলা একে একে ভিড় জমাতে লাগলেন। এমন কৌলীন্যহীন স্থানে এটুকু উপস্থিতিও আশা করিনি। ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক পেছনের নিস্তব্ধ অন্ধকারকে আরও একঘেয়ে রকমের ঘন করে তুলেছে। গাঢ় অন্ধকারে মন্দিরসংলগ্ন জমির সীমানাও সঠিক বোঝা যায়না। "পদ্মবীজ বুনেছি ওদিকে।"অন্ধকারে দৃষ্টি সয়ে এলে,হরিদাসের স্বর অনুসরণ করে, বেশ কিছুদূরে ভূতভৈরবের ঝোপের গা ঘেঁষে একখানা সিমেন্টের বড় পাত্র চোখে পড়ে। হরিদাস হাসে,"শ্বেতপদ্ম।"

পুজো চলছিল। হরিদাস বলে,"তুমি কার নামে পুজো দেবে?পুজোর থালায় নামগোত্র কিছু লেখোনি তো..." আমি হাসি,"থাকগে। এ সমুদ্রে সব জলবিন্দুই মিলেমিশে এক। নামহীন,গোত্রহীন। আমাদেরই কেবল নামেগোত্রে বেঁধে রাখার চেষ্টা।"

হরিদাসও হাসে,"তা ঠিক। পুজোশেষের দেরি আছে। প্রসাদ খেয়ে যেও। আমি বড়রাস্তা অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসবখন।"

প্রসাদ আনে তার বউ। শালের পাতায় বোনা থালায় চাল-ছোলাভাজা,নারকেলকোরা,একখানি গুড়ের বাতাসা।আহা অমৃতসম। তাদের ছোট্ট মেয়েটি গা ঘেঁষে বসে,যেন কতোকালের চেনা। ছোট্ট দুটি মুঠোয় চালভাজা ভরে,মুখে ফেলতে গিয়ে মুঠো গলে পড়ে যায় সব,হেসে ওঠে খিলখিল্। পা দুটি মিলে বসে, অকারণ নাড়ে বারবার,রূপোর নুপুর বেজে ওঠে ঝমঝম্। এসব দৃশ্যে যেন কতজন্মের চেনা ঘ্রাণ!

ফিরতে হবে এবার,হরিদাসের বউ যত্ন করে বেঁধে দেয় কটি সন্দেশ,চালভাজা,"বাচ্চারা খাবে।" ধূলোপথ,ফাঁকামাঠ। সরু ফালিচাঁদ এসে পড়ে আছে মাঠের ওধারে,কুসুমের ডালে। সে আলোয় অস্পষ্ট দেখি,লাল লাল পাতা। সেজে ওঠা শুরু হল বুঝি তার। বাসনাকুসুম! পথের ধারে গোটাকয় বাড়ি,তাদের নিকানো উঠোনে লতাপাতায় কত আল্পনা! দুধারে শাদা আকন্দের ঝোপ।বাতাসে কী যেন এক ঝিমধরা ঘ্রাণ! ভাঁটফুলের বাঁক পার হয়ে বড়রাস্তায় এসে পড়ি। হরিদাসকে বলি,আর আসতে হবেনা,এরপর চেনা পথ আমার। হরিদাস ফিরে যায়,বলে যায় "পদ্ম ফুটলে কিন্তু এসো আরেকবার। "

আবছা আলোয়, অন্ধকারে হরিদাসের অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে আসে ক্রমে। চেনা শহুরে রাস্তায় অভ্যস্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি,সত্যিই কি কোনো একটি শ্বেতপদ্মের দিনে আবারও ফেরা হবে আমার,হৃৎপদ্মের কাছে?

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register