Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত - স্বাদকাহন

maro news
কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত - স্বাদকাহন

 জিলিপি

বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ! তারমধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য রথযাত্রা৷ আমাদের পূর্ব মেদিনীপুরের রথ বললে আগেই মহিষাদলের রথের কথা মাথায় আসে৷ নানান জায়গার রথ নানান রকম হয়। তবে রথের মেলার গল্প কিন্তু এক একজায়গায় এক একরকম। ছোট থেকেই রথের দিনে বিকেলে বাবার হাত ধরে নইলে বোনেরা মিলে রথ দেখতে বাজারে গেলেই রথের ওপর বসিয়ে দেওয়া হত, নইলে বাবার দোকানে একটা টুলে বসে থাকতাম। দেখতাম, রথের দালান থেকে এক ব্রাহ্মণ ঠাকুর ধামা ধামা বাতাসার লুট দিচ্ছেন। আর আমার দাদু হাতে ঝুলিয়ে আনছেন জিলিপি আর পাঁপড়ভাজা। সে এক অন্যরকম পাঁপড়। অতো বড় সাইজের সচরাচর বাড়িতে কোনদিনই ভাজা হত না। আর জিলিপি দোকানে তো লাইন পড়ে যেত৷ বাজারে বসে যতটা খাওয়ার খেতাম, তারপর সন্ধের দিকে যেই ফিরতে হাতে করে শালপাতার ঠোঙায় মোড়া জিলিপি আনত। পরের দিকে অবশ্য খবরের কাগজের ঠোঙা। এরই মাঝে মা আনত গাছ। রথের মেলায় গাছ কেনা হবে না এমন দিন আমি প্রায় দেখিনি বললেই চলে। আমাদের গ্রামে এরকম কোন বিশেষ মেলা বা পুজোর দিনেই জিলিপি পাওয়া যেত। সারাবছর বোধহয় আজও পাওয়া যায় না৷ ফলে আমাদের জিলিপি খাওয়ার জন্য অপেক্ষাই করতে হত।

এরপর যখন বিবাহ (হিন্দিতে) সিনেমা দেখলাম তখন বোধ হলো জিলিপি রাবড়ি দিয়ে খেতে হয়। বাড়িতেই প্রথমবার জিলিপি এনে রাবড়ি দিয়ে খেয়েছিলাম। উফফ যেন অমৃত। তবে অমৃত কেমন খেতে তা কেই বা জানে! হয়তো তেতো! নয়তো খুব কষা!! এই স্বাদ কিন্তু জিভে লেগে থাকার মতন। এরপর জিলিপির আদিখ্যেতা দেখেছিলাম একটি হিন্দি সিরিয়ালে। তখনও জানতাম না জিলিপি কিভাবে আমাদের দেশে প্রচলিত হল।

আমি কখনও ভাবিইনি যে কোন মিষ্টি বা আমাদের বেশিরভাগ খাবারই বিদেশ থেকে এসেছে কিংবা বিদেশি খাবারের রূপান্তরিত রূপ৷ মিষ্টি যে পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও এতো পাওয়া যায় তাও ধারণার বাইরে ছিল। জীবন যেমন দিন দেখায় আমরাও তেমনই শিখি। আজ বলতে পারি মোটামুটি সারাবিশ্বে লেগিকেনি, রসোগোল্লা আর জিলিপি সর্বত্রই পাওয়া যায়। রসোগোল্লা আর লেডিকেনি কলকাতা তথা এদেশীয় হলেও জিলিপির আমদানি ভারতে বাইরের দেশ থেকেই হয়েছে। অবাক হলেও কথাটা সত্য। শুধু তাই নয়, আজও সারা ভারত সহ নানান দেশে জিলিপির কদর বেশ ওপরের দিকেই।

দশম শতকের শুরুর দিকে রান্নাবান্না নিয়ে লেখা অন্যতম বই কিতাব-উল-তাবিখ — পারসিয়ান লেখক মুহম্মদ বিন হাসান আল-বাগদাদী উল্লেখ করেন একটি বিশেষ পদের। যার নাম ‘জুলবিয়া’। এই সময়েই বা সামান্য আগে পরে, আরব দেশের লেখক সায়ার অল-ওয়ারাকের লেখা রান্নার বইতে এই নামটি পাওয়া যায়। এই দুই বই থেকেই খাদ্য ঐতিহাসিকরা জুলবিয়ার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানতে পারেন। এখন কথা হচ্ছে আমরা জিলিপির গল্প শুনব, কিন্তু এসব কেন বলছি! ওমা! বলব না? এই জুলবিয়াই তো ভারতে এসে নাম পালটে জিলিপি সেজে রাজত্ব করছে নয় নয় করে ছ'শ থেকে সাতশ' বছর। এখন তো মনেই হয় না জিলিপি আমাদের নিজেদের সৃষ্টি নয়। আবার এ'কথা আংশিক ভুলও বটে। কারণ প্রাচীন বই পত্রতে 'জুলবিয়া'র যে রন্ধনপদ্ধতি দেখতে পাওয়া যায় তা জিলিপির মতো খানিকটা হলেও তফাৎ অবশ্যই আছে। বলতে চাইছি 'জুলবিয়া' এদেশে এসে পুরোপুরি নিজেকে না বদলালেও হেঁশেলে ঢুকে খানিক এদেশীয় রঙে সেজেছে বৈকি।

পারস্য তথা ইরানের জিলিপি, থুড়ি জুলবিয়া অবলুপ্ত নয়। আজও বেশ ঐতিহ্যশালী খাবার৷ পার্সি নববর্ষের (নওরোজ) দিন আমাদের দেশের অনেক রাজ্যেই ছুটি থাকে৷ আর ভারতীয় পার্সিরা নববর্ষ উপলক্ষে তাদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, দরজায় রঙিন রংকলি দেয় সাথে ফুল দিয়ে সাজায়ও। এছাড়াও পরিবারের সকলে মিলে অগ্নিমন্দির বা আগারি যান এবং পবিত্র অগ্নির সামনে প্রার্থনা করে নতুন বছরের জন্য কল্যাণ ও শান্তি কামনা করেন। উৎসবের দিন এইগুলোর সাথে মূল আকর্ষন হল খাবার দাবার— তাই এই দিনটিতে তাদের ঘরে তৈরি হয় নানা ঐতিহ্যবাহী পার্সি খাবার—যেমন পাত্রা-নি-মাচি( পাতায় মোড়া মাছ) ধান-দার-পাটিও(ভাত ডালের সাথে মাছ বা মাংস), ল্যাগান-নু-ভেজান (পাত্রে রান্না বিশেষ মাংস), আর মিষ্টিমুখের জন্য শির খুরমা ও রাভা। কিন্তু পারস্য তথা বর্তমান ইরানের ঘরে ঘরেই নওরোজের দিন আজও তৈরি হয় জুলবিয়া৷ তবে জিলিপি আর জুলবিয়ার মধ্যে সামান্য পার্থক্য তো আছেই। আমাদের আড়াই প্যাঁচের জিলিপি ইরানে যখন তৈরি হয় তখন ফুলের আকার পায়। আবার মধ্যপ্রাচ্যের দিকে সরে এলে জুলবিয়া বদলে যায় ‘জালাবিয়া’-তে। ভারতের জিলিপি সাধারণত চিনির রসে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পর পরিবেশন করা হয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের জালাবিয়া চিনির রসের পরিবর্তে মধু ও গোলাপ-জলে ডুবে সুস্বাদু হয়ে ওঠে।

এখন কথা হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে কিভাবে এলো। খুব স্বাভাবিক যেভাবে ব্রিটিশদের হাত ধরে বা অন্যান্য বণিকদের হাত ধরে বিভিন্ন দেশের খাবার দাবার আমাদের দেশে এসেছে এবং এদেশীয় হেঁশেলের ছোঁয়ায় রং রূপ বদলেছে সেরকমই পারস্য বা ইরানের এবং মধ্যপ্রাচ্যের বণিকরা যখন ব্যবসার খাতিরে এদেশে আসে তখনই তাদের নানান সংস্কৃতির সাথে সাথে খাবার-দাবারও ভিড় করে। সেই দলে উল্লেখযোগ্য সূর্য উপাসনার পাশাপাশি জুলবিয়াও নিজের নাম ঢুকিয়ে দেয়। মোটামুটি ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ভারতে প্রবেশ ঘটলেও জনপ্রিয় হতে হতে প্রায় পনের শতকের শেষের দিক হয়ে যায়। ১৪৫০ খ্রীস্টাব্দে জিনাসুরার লেখা জৈন গ্রন্থ ‘প্রিয়মকর্ণপকথ’-এ প্রথমবার ভারতের জিলিপির দেখা পাওয়া যায়। তখন যদিও নাম ছিল ‘জলভাল্লিকা’ বা ‘কুণ্ডলিকা’। স্বাভাবিক, কারণ দেশ পার করে আসার পর ভিনদেশের মানুষ তাকে দেখে কি নাম দেবে সে কি আর আগে থেকে বোঝা যায়? পরবর্তীতে বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থে (‘গুণাগুণবোধিনী’, ‘ভোজন কুতূহল’ ইত্যাদি বই) এখনকার জিলিপি এবং তার তৈরির পদ্ধতি পাওয়া যায়। উৎসবে, অনুষ্ঠানে তো বটেই; মন্দিরের প্রসাদ হিসেবেও এর চল শুরু হয়। আজকাল ভারতবর্ষের নানান রাজ্যেও বেশ জনপ্রিয়। তবে নানান জায়গায় নানান নাম, আর অনুষঙ্গও আলাদা। কোথাও রাবড়ি, কোথাও দই কোথাও আবার এমনিই ঘি'এ ভাজা মুচমুচে৷ অনুষঙ্গ ছাড়াও আজকাল মাওয়া জিলিপি কিংবা ছানার জিলিপিরও দেখা মেলে অর্থাৎ মূল উপাদানের পরিবর্তন, তবে আড়াই প্যাঁচের গোল কুন্ডলিকৃত বলেও হয়তো জিলিপি নাম পিছু ছাড়েনি।

জিলিপি বা জেলেবি যখন অন্ধ্রপ্রদেশে ঢুকেছে তখন নাম হয়েছে ইমারতি। ওই আমরা যাকে অমরিতি বলি। তা দেখতেও ফুল ফুল। জিলিপির ইমারতি রূপ ভারতে বেশ বিখ্যাত। কারণ ভোজনরসিক মোঘল বাদশা জাহাঙ্গীরের বেশ পছন্দ হয়েছিল। আবেগে আহ্লাদে তিনি আবার আলাদা নামকরণও করেন। হ্যাঁ মোঘল আমলে জাহাঙ্গীরের পর এই ইমারতি বা জিলিপি জাহাঙ্গিরি নামে বেশ সুখ্যাতি লাভ করেছিল।

কোন কিছু তা খাবার হলেও দিন বদল ও হাত বদলের সাথে সাথে কত বদল ঘটে। এক সময় হয়তো তার আসল রূপটাই বদলে যায়। কিন্তু জিলিপির ক্ষেত্রে এতটা পরিবর্তন কখনোই ঘটেনি। আমার প্রবাসী জীবনে রথযাত্রাও যেমন নেই, রথের মেলায় গিয়ে জিলিপি পাঁপড় ভাজা খাওয়াও নস্টালজিক হয়ে গেছে। তবে জিলিপি কি আর পাওয়া যায় না অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু রথের দড়ি টানার পর জিলিপি খাওয়ার স্বাদ আজও কোথাও পাই না। সেই জিলিপি খাওয়ার স্মৃতি বুকেই বলে ফেললাম এতগুলো কথা। এক একটা খাবার কতকিই বয়ে আনে। এই গল্পের শেষে একবারও মনে হয় না যে জিলিপি বিদেশি বস্তু। সে আজ বড় আপনার। বাঙালির তথা ভারতবাসীর রসনা তৃপ্তির আপনজন।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register