Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

maro news
কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

ক্ষুধা

বাবা বিখ্যাত কেউ না থাকলেও একটা বিশেষ কাজের জন্য তাকে সবাই চেনে৷ বৃটিশ বেনিয়াদের কাছ থেকে যখন এদেশ স্বাধীন হলো৷ সেদিন নিজের দোকানের ছাদে বাবাই এ শহরে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে৷ সেটা দেখতে কতো যে লোক এসেছিলো! স্যালুট দিয়েছিলো! এখনো অনেকে সে গল্প করে৷ ভালো লাগে৷

কোনো অসুখ-বিসুখ ছিলোনা৷ কিংবা খুব বয়স হয়েছে তা-ও নয়৷ হঠাৎ করে বাবা মারা গেলেন৷ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে যাওয়ায় আমরা অতল সাগরে পতিত হলাম৷

আমরা চার ভাই-বোন৷ দুই ভাই৷ দুই বোন৷ সবচেয়ে বড়বোনের বিয়ে হয়েছে৷ এখানেই থাকে৷ তবে ঘরজামাই বলা যায়না৷ শশুরের একখন্ড জমিতে নিজে বাড়ি বানিয়েছে৷ আয় রোজগার ভালো৷ উপরন্ত বাবার দোকানটা ভাড়ার নাম করে দখলে নিয়েছেন৷ এমন দুর্দিনে ভাড়াও দিচ্ছেন না আবার অন্যকে ভাড়া দিতেও দিচ্ছেননা৷ তাই আমাদের খোঁজ নেয় না৷ দূরত্ব রেখে চলে৷ আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাও এখন এমুখো হয়না৷

বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে৷ সে এখন আমাদের এ "জীবন-সংসার" নামক জাহাজের একমাত্র সারেং৷ আমরা বুঝি সংসার চালাতে তার কী প্রাণান্তকর সংগ্রাম৷ কলেজপড়ুয়া এক মেধাবী ছাত্রকে আজ দিন হাজিরাসহ এমন কোন কাজ নেই করতে হচ্ছেনা৷ একদিকে নিজের লেখাপড়া৷ অন্যদিকে আমাদের পড়াশুনা ও সংসারের খরচ৷ পেরে উঠছেনা৷ তবুও অদ্ভুত প্রাণশক্তি তার৷ হার না মানার জেদ৷

প্রায়দিন আমাদেরকে দিনের বেলা উপোস করতে হয়৷ আমি এইটে আর আমার ছোটবোন সিক্সে পড়ে৷ সেই সকালে একমুঠো মুড়ি-চিড়া খেয়ে সারাদিন স্কুল শেষে খালি পেটে থাকা কী কষ্ট তা সবাই বুঝবেনা৷ আমার আর ছোটবোনের ক্ষুধা সহ্য হয়না৷ মাকে জ্বালাতন করি৷ খাবার দিতে বলি৷ এটা-ওটায় লাথি মেরে রাগ আর ক্ষুধার কষ্ট প্রকাশ করি৷ মা রাগ না করে বরং শুধু কাঁদে৷ বলতে থাকে তোরাতো শুধু নিজের কথা ভাবছিস অথচ তোদের বড়ভাই জাকির এই ঝড়-বৃষ্টি-রোদের ভেতর কী কষ্ট করে যাচ্ছে সংসারের জন্য! ও কি কিছু খেয়েছে কী-না সেটা কেন বলিসনারে তোরা৷ বলতে বলতেই কাঁদতে থাকে৷ জাকিররে কতো স্বপ্ন ছিলো তোর৷ পড়াশুনা শেষ করে মস্ত বড় চাকরি করবি তুই! আর এখন তুই লেবারি করছিস ব্যাটা! মা গীত গাওয়ার মতো সুর তুলে কাঁদে আর বলে আল্লাহ্ কেন আমাকে তুলে নিলোনা গো আল্লাহ্৷ মা'র কান্না শুনতে ভাল্লাগছেনা৷ ক্ষুধায় মেজাজ ঠিক নেই৷ এমন সময় আমাদের আদরের ছোট বোনটা এসে আমার হাত ধরে টানতে থাকে৷ ওকে সাথে নিয়ে গিয়ে বলি কী হয়েছে বলতো? ও নিজের পেটটাতে হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে বললো ছোটভাই খুব ক্ষুধা লেগেছে৷ আমাকে কিছু খেতে দাওনা! বলেই কান্না জুড়ে দিলো৷ ওর কান্না যেন আমার বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছিলো৷ নিজেও কেঁদে ফেললাম অঝোরে৷ এটা কি শুধু বোনের ব্যথায় নাকি ক্ষুধার সেটা আজো রহস্যাবৃত৷ ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম চুপ কর৷ একটা ব্যবস্থা করছি৷ ওর হাত ধরে হাঁটছি আর ভাবছি কী করা যায়! এমন সময় মাথায় আইডিয়াটা এসে গেলো৷

আমাদের বাড়ি থেকে আধাঘন্টা পথ দূরে বড়খালার বাড়ি৷ ওনারা অনেক বড়লোক৷ খালাতো ভাই-বোনেরা সকলে উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত৷ এজন্য অবশ্য বড়খালা কম অহংকার করেননা! যার ফলে ওনারা আমাদের সাথে তেমন সম্পর্ক রাখেননি৷ ছোটবোনটা বুড়ির মতো পাকা পাকা কথা বলে আর সবাই ভালোবাসি তাই আমরা ওকে বুড়ি বলে ডাকি৷ আমি বললাম বুড়ি চল বড়খালার বাড়িতে যাই৷ ওখানে খেলতেও পারবো আর দুপুরে ভাত খেয়ে চলে আসবো৷ কেউ টেরই পাবেনা৷ দুপুর অবধি আমরা ক্ষুধার্ত দুই ভাই বোন খালার বাড়িতে থাকলাম৷ আঙ্গিনার অনেক গাছ৷ সেখানে কত পাখি! দু'একটা গাছে পাখির বাসা৷ বুড়ি পাখির ছানা চাচ্ছে৷ এ গাছ থেকে ও গাছে চড়ছি-নামছি৷ গাছের কোঁটরে হাত ঢুকে দেই৷ কিন্ত নাহ্৷ কোন ছানা পেলাম না৷ ভেতরে ভেতরে আনন্দ৷ কিছুক্ষণ পরেতো খালা খেতে দেবে৷ পেট ভরে খেয়ে বাড়ি যাবো৷ একটা প্রত্যাশা আর দারুণ ভালোলাগা যেনো ক্ষুধার কথাটাকে ভুলিয়ে রাখলো৷ ঠিক খাবারের সময় বড়খালা আমাদের ডাকলেন৷ বাঁধভাঙ্গা আনন্দে ছুটলাম৷ যে ডাকটার অপেক্ষায় এতো কসরত, এতো আয়োজন৷ বললাম কী বলবেন বলেন খালা? তিনি যা বললেন তার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলামনা৷ এমনকি কল্পনাও করিনি৷ খালা বললেন এখন খাবার সময় হয়েছে৷ খেলাধুলা বন্ধ করে বাড়ি চলে যাও৷ অনেক ছোট হলেও খালার কথাগুলো মনে দাগ কাঁটলো৷ প্রচন্ড ব্যথা পেলাম৷ তবে এবার আর আবেগপ্রবন হলাম না৷ বুড়ির হাতটা ধরে অনেকটা জোর করে টেনে আনলাম ঐ "মৃত্যুপুরী" থেকে৷ যেখানে আর কখনোই যাইনি আমি৷ আজ রোদের তীব্রতা বেশ৷ এটাকেই কি সানি ডে বলে? আচ্ছা সানি ডে'র বিশেষত্ব কী! ক্ষুধা নিবারণের ছলে বেশি ছোটাছুটির কসরত দু'ভাই-বোনের ক্ষুধার জ্বালাকে করেছে আরো তীব্র৷ বুড়ি কাঁদতে থাকে৷ ওকে আশ্বস্ত করি৷ এখান থেকে আমাদের বাড়ির পথে একটা বড় কবরস্থান আছে৷ সেখানে অনেক ফুল-ফলের গাছ৷ বিশাল ফলগাছগুলোতে প্রচুর ফল ধরে৷ ওখানেই পড়ে যায়৷ পাখি ছাড়া ফল খাওয়ার লোক নেই৷ কবরস্থানের গাছের ফল কেউ খায়না৷ কী জানি ভয়ে নাকি ধর্মে নিষেধ আছে জানিনা! বুড়িকে রাস্তার একপাশে ছায়ায় বসিয়ে রেখে আমি একটা আতা গাছে উঠে পরলাম৷ বড় আর পাকা দেখে বেশ কিছু আতা নিয়ে বুড়িকে বললাম৷ খেয়ে নে বুড়ি! পেটভরে খা৷ মনে মনে বলতে থাকি কবরে শায়িত লোকের নয় জীবিত মানুষের জন্য খাবার প্রয়োজন৷ কেননা তাদের ক্ষুধা আছে৷ খাওয়া শেষ করে যখন দু'জনে বাড়ি ফিরলাম তখনো হাতে ছিলো কিছু আতা৷ হয়তো আর কারো ক্ষুধা মেটাবে৷

মেঘে মেঘে অনেক বেলা৷ কিংবা বলা যায় মিনিট, ঘন্টা, দিন, বছর পেড়িয়ে যায়৷ সময়ের সাথে সাথে মানুষ সার্ভাইভ করে৷ নতুন করে গড়ে তোলে জীবন৷ আর জীবনও থেমে থাকে না কখনো৷

বড়ভাই সরকারী চাকুরে থেকে অবসরে গেছেন৷ আর বুড়ি এবং ওর স্বামী দুজনে সরকারি চাকুরি করে৷ বাহিরে থাকে৷ আমরা হয়তো কেউই বড়খালার সন্তানদের মতো মস্ত বড় মানুষ হতে পারিনি৷ তবে এখন আর আমাদের ক্ষুধা নেই৷

এখন আমি প্রতিষ্ঠিত৷ রং শিল্পি৷ সকলে আর্টিস্ট বলে৷ শিল্পচর্চার জন্য কত যে পুরুষ্কার আর সম্মাননা পেয়েছি তার হিসেব নেই৷ এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা পাই৷

কী অদ্ভুত জেনারেশন গ্যাপ৷ বাবা প্রচন্ড ভালোবাসায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে খ্যাতি পেয়েছিল৷ অথচ ঠিক চব্বিশ বছর পরে তার সন্তানরা সেই পতাকা ছুড়ে ফেলে স্বাধীন বাংলার পতাকার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে৷ এনেছে এক নতুন পতাকা৷ নতুন দেশ৷ আর সীমাহীন স্বপ্ন৷

আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের দুই সন্তান ও নাতি-নাতনী ছাড়াও আমার বাড়িতে এখন আরো একজন থাকে৷ মা মারা যাবার পর তাকে মায়ের মতো যত্ন করি৷ যেখানে শ্রদ্ধার চেয়ে করুণা কাজ করে বেশি৷

আমার বড়খালার তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সন্তানরা সম্পদের মালিকানার পর কেউই তাকে নিজের কাছে না রেখে অবহেলা করতে থাকে৷ তখনতো বৃদ্ধাশ্রম বলে কিছু ছিলো না৷ খালার থাকার জায়গা নেই৷ খাবার নেই৷ বেশ কিছুদিন আশেপাশের বাড়িতে ভিক্ষুকের মতো খাবার চেয়ে খেয়েছে৷ এসব মানিয়ে নিতে না পারায় অসুস্থ্য হয়ে পড়েন৷ একদিন আটপৌঢ়ে কাপড় পরিহিত অসহায় আর মলীন চেহারার এক বৃদ্ধাকে বাড়ির গেটে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কী চাই? তাঁর পরিচয় পেয়ে একবার মনে করেছিলাম দূর করে দেই৷ কিন্ত পরে ভাবলাম একজন অধম হবে বলে আমি উত্তম হবোনা কেন? সেই থেকে আজো তিনি এখানে আছেন৷ হয়তো থাকবেন আমৃত্যু! একজন ক্ষুধার্তের মুখমন্ডল দেখতে কেমন হয়? আচ্ছা বহুদিন আগে ক্ষুধার্ত দুই ভাই-বোনের মুখচ্ছবি কেমন ছিল? জানতে ইচ্ছে করে৷ এখন ক্ষুধার জ্বালা নেই৷ তবে খাবার সময় বড়খালা যেভাবে চোখ বড় বড় করে এক মুঠো ভাত মুখে ঢুকিয়ে পরবর্তি মুঠোর জন্য তাকিয়ে থাকেন৷ সেই দৃশ্য দেখার ক্ষুধাটা হয়তো থেকে যাবে অনন্তকাল৷

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register