Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে নিলাম সামন্ত (পর্ব - ৩১)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে নিলাম সামন্ত (পর্ব - ৩১)

মহাভারতের মহানির্মাণ (অশ্বত্থামা)

তবে গুরু দ্রোণ নিজেও চেয়েছিলেন পাঞ্চালরাজা দ্রুপদকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিতে। দ্রুপদ বন্ধুত্বকে মর্যাদা দিতে পারেননি৷ এই সব কথা অশ্বত্থামা চরিত্র আলোচনা করতে গিয়ে আসছে কারণ অশ্বত্থামা মহাভারতের এমন একটি চরিত্র যা সর্বক্ষণ ছাতার তলায় বেড়ে ওঠা এবং বেঁচে থাকা। তার বিদ্যা, চালচলন কর্মক্ষম এমনকি প্রতিরোধ সবেতেই( মাটির প্রতিমাকে যেমন বাঁশের ঠেকা দিয়ে দাঁড় করিয়ে সুন্দর সাজানো হয় তেমনিই) পিতা তথা মহান যোদ্ধা, অস্ত্রচালক এবং সেরার সেরা শিক্ষক গুরু দ্রোণাচার্যের সাহচর্য সমেত ঢাল।

অশ্বত্থামা গুরুগৃহে সবার সাথে শিক্ষালাভ করলেও সখ্যতা তার দুর্যোধনের সাথেই গড়ে উঠেছিল, হতে পারে দুর্যোধনের কৃতিত্বও রয়েছে এর পেছনে, কিংবা বড়লোক বন্ধু হিসেবে রাজার ছেলেই প্রথম অধিকার পায়। এই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে প্রকাশ্যেও আসে৷ পাঞ্চাল কন্যা যাজ্ঞসেনী তথা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় দেখা যাচ্ছে অশ্বত্থামার উপস্থিতি৷ সে নিজে গেছে কন্যা জিততে এমন না৷ তাঁকে দেখা গেছে বন্ধু দুর্যোধনের পাশেই থাকতে। অথচ মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী সে বেশ সুদর্শন৷ কিন্তু তার বিবাহ বা সংসার কোনটার প্রতিই বিশেষ আগ্রহ বোধ করি ছিল না৷ আজীবন অবিবাহিতই থেকে গেল৷ দুর্যোধনের সঙ্গেই যে গিয়েছিল তার বিশেষ প্রমান হিসেবে পাই, দুর্যোধনের সাথেই ফিরে আসার দৃশ্য দেখে৷ ধীরে ধীরে পরম সখা হয়ে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু যুবরাজ দুর্যোধনের অনেক কার্যকলাপই তার পছন্দ হত না৷ মানিয়ে নিত, হয়তো রাজসুখের ভোগ বা রাজছত্রছায়া খোয়ানোর ভয়। কারণ অপছন্দ বা অসন্তোষ থাকলেও সে কখনও কৌরব পক্ষ ছেড়ে পান্ডবদের দলে গিয়ে ভিড়ে যায়নি৷ যখন ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্যপাঠ শুরু করল পান্ডবরা তখন হস্তিনাপুর ছেড়ে অনেক ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরকে নিরাপদ ও ধর্মরাজের আশ্রয় ভেবেই ইন্দ্রপ্রস্থে চলে গিয়েছিলেন। এই ব্রাহ্মণদের তালিকায় আমরা কোথাও কোন ভাবে কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য কিংবা অশ্বত্থামাকে দেখি না। সেক্ষেত্রে দুর্যোধন উপলক্ষ্য কতটা তার বিচার না করেই বলব আসল উপলক্ষ পিতামহ ভীষ্ম কারণ ভীষ্মর সিদ্ধান্তের কারণেই তাঁদের এই রাজভবনে বসবাদের অধিকার। তাই ইন্দ্রপ্রস্থে গঙ্গাপুত্র যেহেতু যাননি বাকিদের না যাওয়াই সঠিক কর্তব্য পালন বলে আমারও মনে হয়। এ গেল গুরু দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্যের কথা। অশ্বত্থামা যায়নি, কারণ দুর্যোধন ও কর্ণ দুঃশাসন শকুনি এদের সঙ্গ যেভাবে উপভোগ করত সেইভাবে পান্ডবদের সঙ্গে উপভোগ করতে পারত না। পিতা দ্রোণাচার্যের মতো তারও যে বড়লোক বন্ধুর সাহস আছে যে থাকার মোহ ছিল তা অস্বীকার করা যায় না।

ইন্দ্রপ্রস্থে অশ্বত্থামাকে আমরা দেখি কৌরব বাড়ির মাথা দের সাথে, যখন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ হচ্ছিল তখন। বাবা মা ও হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির প্রধান মুখগুলোর সাথে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তার জন্য একটি কাজও জুটে ছিল। আসলে যুধিষ্ঠির সবাইকে নিয়ে চলতে চাইত, এটা তারই প্রমাণ। অশ্বথামা বা তার সঙ্গী সাথীরা যে নিজের ইচ্ছাতে যজ্ঞের কাজে হাত বাড়িয়েছিল এমনটা নয়। ব্রাহ্মণ-বংশজ বলে তৎকালীন স্বগন্ধী গোষ্ঠীদের দান গ্রহণের বিষয়টা তিনি ভালোই বুঝবেন এটা চিন্তা করেই যুধিষ্ঠির তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যুধিষ্ঠিরের তরফের দান সমস্ত ব্রাহ্মণ যেন প্রতিগ্রহণ করেন কেউ যেন বঞ্চিত না হন এই বিষয়টা দেখভাল করতে। শুধু ব্রাহ্মণ বলেই না, যেহেতু ক্ষত্রিয় বাড়িতে বড় হয়েছে এবং ক্ষত্রিয়দের সাথেই মেলামেশা তাই ক্ষত্রিয়দের মতো একাগ্রতা থাকবে এমনটাই আশা করেছিলেন যুধিষ্ঠির। এইসব বিচার বিবেচনা করে এত বড় দায়িত্ব তার কাঁধে দিয়েছিলেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হলেও, এই ঘটনা এবং কৌরব ভাইদের আচার-আচরণ সবকিছু দেখে আমার বারবারই মনে হয় যুধিষ্ঠির নিজের ভাই এবং গুরুপুত্রের সাথে কোন দ্বন্দ্বই টিকিয়ে রাখতে চায় না। সবসময়ই তার প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল মিলেমিশে চলার। তবে এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে অশ্বত্থামার বিরাট কোন ভূমিকা কোনদিনই ছিল না। সে নিজেকে নিয়ে চিরকাল ব্যস্ত। নিজের অস্ত্রবিদ্যা নিজের ভালো থাকা আমোদ আহ্লাদ ইত্যাদি। বিশেষ কোন দিকে তাকে মাথা ঘামাতে হয়নি কারণ সেও জানতো বাবা তার মাথার উপর ছাতা হয়ে রয়েছেন। বাবা থাকতে তার কোনদিনই কোথাও কোন সমস্যাই হবে না।

অশ্বত্থামার ছাতা থাকলেও সে কিন্তু দুর্বল ব্যক্তিত্ব কোনদিনই নয়। অস্ত্রবিদ্যায় শৌর্যে কর্ণ অর্জুনের থেকের কোন অংশেই কম নন। তাঁরও যথেষ্ট সুনাম ছিল। ওই রাজসূয় যজ্ঞেই সে প্রশংসা পেয়েছিল। যদি তা সহজ ভাবে নয়। বাঁকা পন্থায়। কারণ মহামহিম ভীষ্ম যখন যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞার্ঘ্য-নিবেদনের জন্য শ্রী কৃষ্ণের নাম উল্লেখ করেন তখন ওই সভায় উপস্থিত শিশুপাল শ্রীকৃষ্ণকে ছোট দেখানোর উদ্দেশ্যে তুলনামূলক বাক্যবাণে অশ্বত্থামার হাজারও প্রশংসা এবং শ্রীকৃষ্ণের নিন্দে৷ সেখানে শিশুপাল বলছেন 'সর্বশাস্ত্র সুপণ্ডিত' - এত বড় বিশেষণ বড় বড় রাজা রাজড়াদের সামনে তো আর এমনি এমনি বলবেন না, নিশ্চয়ই এই জ্ঞান এবং এই সম্মান তার ছিল। সর্বোপরি তার শিক্ষাগুরু দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্যের সাহচর্যেই এই জ্ঞান তার ছিল তা প্রমাণ হয়। সেজে খুব একটা অসম্মানিত ব্যক্তি ছিল না তা আমরা বুঝি আরো একটি দৃশ্যে যখন পাশা খেলায় পাণ্ডবরা হেরে গিয়ে বনে চলে যাচ্ছেন তখন বাড়ির বড়দের এবং গুরুদেব প্রণাম এর সাথে সাথে অশ্বথামাকেও প্রণাম করছেন। অর্থাৎ সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও তার মর্যাদা কিন্তু পন্ডিত ব্রাহ্মণদের সমান সমানই ছিল।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register