Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গদ্যের পোডিয়ামে অর্ঘ্য দে

maro news
গদ্যের পোডিয়ামে অর্ঘ্য দে

বিকেল রঙের নদী

     এবারের মতো পুজো শেষ। কার্তিকের আঙিনায় পা রেখে ফিরে এলাম তোমার কাছে। কেমন আছো? অনেক দিন দেখা হয়নি, গল্প হয়নি। তোমাকেই তো বলা যায়, তোমার কাছেই তো মন খোলা যায়। যতবার তোমার কাছে এসেছি, ততবার আমি যেন শুরু থেকে শেষ অব্দি শব্দ অক্ষরে ঠাসা একটা চিঠির মতো। ফিরে গেছি সাদা কাগজের মতো। তাপ-উত্তাপ, ক্লেশের খোলস ছেড়ে রেখে ফিরে গেছি। তবু কিছু না-বলা কথা তো থেকেই যায়। সে সব কাগজে লিখে ফেলে দিয়েছি এই জলজ ডাকবাক্সে। তবে জানি না সে সব কথা তোমার তল ছুঁতে পেরেছে কিনা। নাকি অতলেই হারিয়ে গেছে। হাঁসেরা হয়তো খেয়ে ফেলেছে জলকেলির ফাঁকে। তুমিই শিখিয়েছ নির্ভার হবার মন্ত্র। অহম আর অভিমানের মতো বিষয়কে ভাবলেশহীনভাবে তোমার বুকে ভাসিয়ে দিয়ে কীভাবে বীতশোক, বীতকাম হতে হয়। সে শিক্ষা এখনও চলছে নিরন্তর। আনন্দের দিনে তোমার কথা ভুলেই যাই। আমি ভুলে যাই সুখের সময় ক্ষণজন্মা। তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার অক্ষম চেষ্টা। কতবার ভেবেছি আর ফিরব না তোমার কাছে। দেখতে দেখতে শেষ হয়েছে চান্দ্রমাস। ঋণ বেড়ে যায়। আসলে সুখের দিনে ভগবানের কথা আমাদের মনে থাকে না। আমার এই বিস্মৃতিকে তুমি ক্ষমা করেছো বারবার। ‘বিকেল রঙের নদী’ তোমার কাছে অনেক ঋণ। কখনও কখনও মনে হয় এ ঋণ জন্মান্তরের।

    কোনও কোনও দিন কী অস্বাভাবিক নীল হয়ে ওঠো তুমি। যেন সংসারের সব গরল ধারণ করেছো তরলে। থিতিয়ে পড়ে মাছেদের খলবল। সেদিন তোমায় নীলকণ্ঠ ডাকতে সাধ হয়। এপারে বসে দেখি ওপারে রাখাল আর তার গরুর দল পিপাসা মিটিয়ে চলে যায়। তোমার কাজলা দিদির কথা মনে আছে? কোনও এক মাঘের শেষ বেলায় ভেসে উঠেছিল তোমার শরীরে। গোধূলির আরক্ত আলোর আভা মনে হচ্ছিল কেউ যেন জলে সিঁদুর গুলে দিয়েছিল। সেই আলোয় দিদির গায়ের রঙ চন্দনকাঠের মতো লাগছিল। আমি ওই নিথর দিশি আমড়া গাছটার মতো দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। লোকজনের ভিড় আর গুঞ্জনে গাছের বাদামি সমান্তরাল পাতাগুলো থেকে থেকে নড়ে উঠছিল। কেউ কেউ বলেছিল সংসারে নাকি কাজলা দিদির অরুচি জন্মেছিল। আমি যেন সেদিন প্রতিমার বিসর্জন দেখেছিলাম। নিজেকে তোমার বুকে ভাসিয়ে দিয়ে নির্ভার হয়েছিল কাজলা দিদি। সেদিন দিদির বাড়িতে চুলো জ্বলেনি। এর কিছুদিন পরেই ছিল পূর্ণিমা। সেই রাতে কাজলা দিদির বোবা ভাইটা আমড়া গাছে গলায় গামছা বেঁধে ঝলে পড়েছিল। সেই থেকে চাঁদের আলোয় আমড়া গাছের ছায়া পড়ত না। লোকে বলতে লাগল আমড়া গাছে ভূত আছে। গাছটা নাকি প্রেত। বদনাম কুড়তে কুড়তে আমড়া গাছটা শুকিয়ে গেল। আমি গাছটার দিকে তাকাতে পারি না। তোমার বুকে গাছটার ছবি ভেসে ওঠে। সাহস করে তাকাই। দেখি আগের মতোই সবুজ সতেজ।

     মাঝেমধ্যেই সুভাষ আসে তার বুটজোড়া নিয়ে। জলে ধুয়ে মুছে চলে যায়। আমার পাড়ারই ছেলে। স্বপ্ন দেখে গোলকিপার হবে। মস্ত বড় গোলকিপার। ময়দানের নামী ক্লাবে খেলবে। তারপর একদিন দেশের হয়ে এক নম্বর জার্সি পরে তিনকাঠির নীচে দাঁড়াবে। বুকে করে আগলে রাখবে গোলপোস্ট। ওর চোখে সম্ভাবনা। মেঘলা দিনে বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে। এ পোড়া গাঁয়ে আর তেমন ক্লাব কোথায়? বড় মাঠ একখানা ছিল। তবে ফি-বছর যাত্রা হয়ে মাঠের দফা রফা হয়েছে। ওর চোখে চোখ রাখতে আমার ভয় করে। ও পারবে তো? তুমি তো বহুদূর দেখতে পাও। তুমি তো জানো আমাদের আগামি, আমাদের ভবিতব্য। আহত সৈনিক আসে, সহযোদ্ধার প্রতি তর্পণ রেখে চলে যায়। আমিও তোমার উঠোনে জ্বেলে রাখি আমার সমস্ত দ্বিধা, সংশয়। সহস্রদল পদ্ম বুকে মেলে তুমি অনন্ত আশ্রম।     

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register