Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

গদ্যের পোডিয়ামে মধুপর্ণা বসু

maro news
গদ্যের পোডিয়ামে মধুপর্ণা বসু

দূর্গের শহরে

বেশ কিছুদিন এই দূর্গ, পাহাড়, রুক্ষ শুকনো রাজস্থলীর শহরে শহরে, ঘুরছি। আমি দেবিকা, আমার কর্তামশাই এবং পুত্র। কয়েকটি স্বনামধন্য জায়গা, উদয়পুর, আবুপাহাড়, চিতোর, জয়পুর ঘুরে আমাদের গন্তব্য এবার আরাবল্লীর ছেড়ে থর মরুভূমির দিকে, আসলে রাজস্থান রাজ্যটি এতোই পর্যটন সমৃদ্ধ আর তার দূর্গ, হাভেলি, কিষাণ জিউর মন্দির, জৈন মন্দির দীলওয়ারা, জয়পুরের সিটি প্যালেস, অম্বর ফোর্ট, উদয়পুরের অসম্ভব সুন্দর প্রাসাদগুলো যে তার বর্ননা দিতে গেলে, তার ইতিহাস থেকে আমাকে বর্তমানে পরিভ্রমণ করতে হবে। তাই আমাদের সমতল আর আরাবল্লীর রুক্ষ, প্রাচীন সুদৃঢ় সৌন্দর্য, রাজপুত রাণাদের অমর কীর্তি দেখে শেষ করতেই লেগে গেছে প্রায় সাতদিন। তাও এবারের মতো না ছুঁয়ে ফেলে এসেছি ভরতপুর, আজমের শরিফ, পুস্করের অপার মহিমা। এবার আমাদের মরুভূমি দেখার পালা, আর সেখানেও শুয়ে আছে রেগিস্থানের অনেক উপকথা, লৌকিক বিশ্বাস, আর উপজাতি, আর আদিবাসীদের আদিম জীবনযাত্রার বিস্ময়।
খুব ভোরে যাত্রা শুরু করেছি, গাড়িতে আমরা ছাড়াও আর একটি পরিবার আছে, আমরা ব্রেকফাস্ট করে সাথে বেশ কিছু শুকনো খাবার নিয়ে নিয়েছি। বড় ইনোভায়, ছয়জন আর সাথে তেজস সিং, আমাদের চালক। গাড়ি খুব স্পীডেই যাচ্ছে, মাঝখানে একবার কফি খেতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ডেসার্ট এর দিকে ঠান্ডাটা বেশ ভালোই হয়, তার ওপর জানুয়ারীর প্রথম দিক, মাঝেই পাশ দিয়ে দু'একটা মরু যান চলেছে, পিঠে সওয়ারি নিয়ে।মরুযান বুঝলেন তো? উষ্ট্র, পিঠে পাগড়িধারী রাজস্থানী সওয়ার। এই এক্সপিডিশানটাও করবো তবে পৌঁছে। তারপর একে একে রাস্তার পাশে ক্রমশ ঝোপঝাড়, ক্যাকটাস দেখতে দেখতে অনেক কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। ' ফেলু বাবু, উট কি কাঁটা বাছিয়া বাছিয়া খায়?' আমাদের চালক বেশ হৃষ্টপুষ্ট এক ধীর স্থির যুবক, মাঝেমধ্যে সে এই অঞ্চলের নানা সামাজিক আর লৌকিক বিশ্বাসের গল্প বলতে বলতে চলেছে। আমার একবার মনে হল জিজ্ঞাসা করি, রাজস্থানে ডেকয়েটদের কি খবর? তারপর নিজেরই এমন হাসি পেল যে চেপে গেলাম। রাজপুতদের অনেক গল্পই অবন ঠাকুরের কৌলিন্যে আমরা পড়েছি ' রাজকাহিনী' তে। তবে এখানের প্রবল মেহনতী দরিদ্র মানুষের মধ্যে কতো যে উদ্ভট সব ধ্যানধারণা ঢুকে আছে, সেই সব কথাই ড্রাইভার তেজস সিং বলতে বলতে আমাদের জমিয়ে রেখেছে। রাজপুত মেয়েদের ছোট্ট বয়েসে বিয়ে, দশ কিলোমিটার হেঁটে পাতকুয়ো থেকে জল আনতে যাওয়া, জিন পরীতে বিশ্বাস। গ্রামের মুখিয়াদের সামাজিক অত্যাচার এসবও এসে পড়ছিল।
মাঝপথে, আরও একবার আমাদের চা আর তার সহযোগে বেসনের পকোড়া আর লঙ্কার বড়া সঙ্গত দিল। আমাদের ফটোগ্রাফার পুত্র নাবার সাথে সাথেই বিভিন্ন এ্যঙ্গেলে তার ক্যামেরায় খচাখচ ছবি তুলছে, আমি এদিকওদিক হস্তশিল্পের খোঁজ করছিলাম, এখনো গন্তব্যে পৌঁছোতে দেরী তাই। মাঝে হঠাৎ দেখলাম একটা ছোট বাজার মতো, সেখানে খরমুজ, আর সবেদা বিক্রি হচ্ছে, আর সবাই কিনে খাচ্ছে। সিং সাবকে গাড়ি থামাতে বলে আমরাও সবাই মিলে খেলাম, আর কিছু চিকু মানে সবেদা নিয়ে নিলাম। পরে কাজে লাগতে পারে। ধমক খেয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম, বিকেল গড়িয়ে এসেছে, আরাবল্লী পর্বত শ্রেনীর আর মরুভূমির দিকচক্রে সূর্যাস্ত নেমে আসছে। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে আর বেশী দেরি নেই। আজ গিয়ে হোটেলে চেকইন করে শুধুই বিশ্রাম। শুনেছি এখানের বানজারা উপজাতির নাচগানের ব্যবস্থা হয়েছে, তার সাথে আঞ্চলিক নৈশভোজ। মানে শুদ্ধ রাজস্থানি আহার। আহ! কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার। সাতটায় ঢুকে পড়েছি হোটেলে। এখানে রাত একটু তাড়াতাড়িই গভীর হয়। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, কারণ আমাদের এই হাভেলি হোটেলটা শহরের একটু বাইরে। কাল সকালে প্রথম দর্শন হবে,সেই ছোট বেলার থেকে যা দেখার উৎসাহ শ্রী সত্যজিৎ রায়, আমাদের মনে জাগিয়ে দিয়েছেন।  ফেলুদা, মুকুলের 'সোনার কেল্লা'। কি যে রোমহষর্ক লাগছে আগামীকালের কথা ভেবে।আজ হাভেলির লনে, বড় করে বন ফায়ার করা হয়েছে। তার সাথে তিন চারটে বার- বি- কিউতে মুড়গি, ভেড়ার মাংসের কাবাব সেঁকা চলছে, নিরামিষাশীদের জন্যে, পনির, আলু বেকড, দেশীয় সবজি।তার সাথে সেই বিখ্যাত রাজস্থানি ধুনের সাথে বিরাট ঘেড়অলা ঘাঘরা পরে রমনীয় নাচ। সাথে সুরার ব্যবস্থাও, সেই মিডনাইট ব্লু রাতে, লক্ষ্য তারার আকাশের নীচে বসে, আমরা সাক্ষী হতে থাকলাম, বানজারা নাচ, আর 'কেসারিয়া বলমা', 'বাগামা বোলে আধি রাতমা', সেই উদাস করা বালিয়াড়ির রুক্ষ সুরের আঁচ।
এই তো ছিল, আমাদের রোগমুক্ত দেশের স্বপ্নের গন্তব্য। থর মরুভূমি আর পৃথিবীর আদিমতম ভঙ্গুর পর্বতশ্রেণী আরাবল্লীর দেশ রাজস্থান।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register