Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র - ৩৭)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র - ৩৭)

যাপনচিত্র ৩৭

মানুষ মানুষের জন্য

আজ আরো একটা ছোটো গল্প নিয়ে এসেছি ৷ কোভিড পরিস্হিতিতে আমরা যেমন অনেক কিছু হারিয়েছি তেমন আবার অনেক কিছুই পেয়েছি ,মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচয় পেয়েছি ,পেয়েছি সকলের মধ্যে বেঁধে থাকি থাকার আন্তরিক প্রচেষ্টা এটা তেমনই একটা গল্প ৷ সৌনক চক্রবর্তী আ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ৷ কলকাতায় একাই থাকেন ৷ কোভিড পরিস্হিতিতে রান্নার মাসি বেশ কিছুদিন ধরে আসছে না ৷ বাধ্য হয়ে আজকাল মাঝে মাঝে রাতে খাবার বাইরে থেকে অর্ডার করতে হচ্ছে ৷
- স্যার , আপনার অর্ডারটা নিয়ে লোকেশনে এ দাঁ ড়িয়ে আছি। একটু দাঁড়াও ভাই, আসছি এখুনি ৷ দরজা খুলে সৌনক চক্রবর্তী গেটের বাইরে এসে মোটর সাইকেল করে আসা জ্যোমাটোর র ছেলেটার কাছ থেকে তার খাবারের ব্যাগটা নেন ৷ধন্যবাদ স্যার ৷ দয়া করে ফাইভ স্টার দিয়ে দেবেন। দাঁড়াও একটু, দেখে-নি আগে সব ঠিক আছে কিনা! ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে সৌনক দেখেতে থাকে।থাকে।জ্যোমাটোর ছেলেটা মনে মনে অবাক হয়, ভাবে, এখন আবার প্যাকেট খুলে খুলে দেখবে না তো, ভেতরে সব ঠিকঠাক খাবার দিয়েছে কিনা! এইটাই লাস্ট ডেলিভারী ছিল, ভীষণ খিদে পেয়েছে ছেলেটার ৷ মনে মনে ভাবছিল এবার বাড়ি গিয়ে খেয়ে নেবে, এখন এ আবার কতো দেরী করায় কে জানে! এদিকে সৌনক ব্যাগের থেকে একটা খাবারের প্যাকেট বের করে নিয়ে বলে, এই একটা প্যাকেট নিয়ে যাও, আর একটা রাখলাম। - না.. মানে স্যার আপনি যা অর্ডার দিয়েছিলেন, তাই এনেছি, আপনি দুটো প্যাকেট চাউমিন ও দুটো স্প্রাইটের কথা বলেছিলেন। - হ্যাঁ, দিয়েছিলাম তো। এখন প্রায় রাত নটা-সাড়ে নটা বেজে গেছে, একলা মানুষ, দুটো প্যাকেট নিয়ে কি করব? তুমি একটা নিয়ে যাও আর একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস। Zomato র বাইশ-তেইশ বছরের ছেলেটা ভাবছে (এতো মহা ঝামেলায় পড়লাম, তাহলে অর্ডারটা দিলে কেন বাবা!) যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে বললো, -স্যার , আমি তো সময়ের মধ্যেই নিয়ে এসেছি। আপনার ফুল পেমেন্টও হয়ে গেছে। আপনাকে তো তাহলে ক্যানসেল করতে হবে অর্ডার টা, অসুবিধা হবে। এইভাবে একটা প্যাকেট নিয়ে আরেকটা ফেরত দিতে গেলে অসুবিধা হবে। জ্যোমাটোর এ্যাপ খুলে সৌনক ছেলেটির নামটা দেখে নিয়ে বললো, গৌতম থাকো কোথায়? কে কে আছেন বাড়িতে? এখানে তো দেখাচ্ছে, তোমার ওপর দুজন নির্ভরশীল আর তুমি ই একমাত্র তোমার পরিবারের রোজগেরে মেম্বার ৷
গৌতম ভাবে, এতো আমার ঠিকুজি নিয়ে পড়লো, আবার কমপ্ল্যান করবে না তো! স্টার পাওয়া তো দূর , এখন বক্ বক্ করো এর সাথে, কোথায় ভেবেছিল তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে একটু খাবে ! কি ফ্যাচাং রে বাবা!গৌতম একটু মাথা নীচু করে বলে, - কাছেই থাকি স্যার, ফুল বাগানে, মা-বাবা আর আমি। অনেক রাত হলো তো স্যার, আর ফেরত দেবেন না। ফ্রিজে রেখে দিন, কাল নাহয় খেয়ে নেবেন, এক্ষুনি বানিয়েছে, নষ্ট ও হবে না। এটাই আমার লাস্ট অর্ডার ছিল, না হলে.... একটু স্মিত হেসে, সৌনক বলে, - এই প্যাকেটটা তোমার বাড়ি নিয়ে যেতে বলছি। দোকানে তো ফেরত নিয়ে যেতে বলিনি। এবার গৌতমের অবাক হওয়ার পালা, - মা.. নে, ঠিক বুঝতে পারলাম না। সৌনক হেসে বলে, দেখো ভাই গৌতম্ আমি একা থাকি, ইচ্ছে করেই দুটো প্যাকেট অর্ডার দিয়েছি। তোমাকে খাওয়াবো বলে। এই পরিস্থিতি না থাকলে তোমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে খাওয়াতাম। তুমি যদি নিয়ে যাও, আমার খুব ভালো লাগবে। আমি যখনই অর্ডার করি তখনই একটা বেশি অর্ডার করি... নিয়ে যাও ভাই।
সৌনকের অমায়িক ব্যবহারে ,গৌতমের চোখটা ছল্ ছল্ করে ওঠে। যা রোজগার করে, কোনরকমে চলে যায় তিন জনের। রোজই এখান থেকে ওখানে খাবার বয়ে নিয়ে যায়, ইচ্ছে থাকলেও কখনো পকেটের টান ওকে দোকানের খাবার কিনতে দেয়নি। আবার ভাবে, এইভাবে ভিক্ষার জিনিস নেওয়া উচিত হবে কিনা!
সৌনক যেন গৌতমের মনের কথা শুনতে পায়, সঙ্গে সঙ্গে বলে,ভেবো না ভাই, আমি তোমায় ভিক্ষে দিচ্ছি। আসলে, একা থাকি তো, কেউ খেলে ভালো লাগে। নেবে?.. গৌতমআর কথা না বলে প্যাকেট-টা নিয়ে, তার চোখের ভাবেই ধন্যবাদ জানিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয়। এইরকম মানুষ-ও এখনকার এই কঠিন পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে আছে.... এরাই মনে হয় মানুষ রূপী ঈশ্বর.. ফুল বাগানের দিকে এইসব ভাবতে ভাবতে চলতে থাকে গৌতম। সৌনক চক্রবর্তী , বড় চাকুরে, কোলকাতার উপকন্ঠে একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে।কুচবিহারে মা-বাবা, একান্নবর্তী পরিবারে থাকেন, এখন ওয়ার্ক ফর্ম হোম হোলেও, মাঝে মাঝে অফিসে যেতে হয়, তাই আর কুচবিহার যাওয়া হয়না। অনেকসময় মা-বাবা এখানে এসে কয়েকদিন থেকে গেলেও সবসময়ের জন্য থাকতে চাননা। অগত্যা বিয়ে করতে অনাগ্রহী সৌনকএকা-ই থাকে, সকালে বাসন্তী মাসি রান্না আর ঘরের অন্যান্য কাজ করে দিয়ে যায়, তাতেই বেশ চলছে তার।,তার।,জ্যোমাটোরতে লক্- ডাউনের বাজারে এইভাবে ওই ছেলেগুলোকে খাইয়ে মানসিক প্রশান্তি পায়। অনেকে অনেকভাবে এই সময় মানুষকে সাহায্য করছে, ও এইভাবে কিছু করার চেষ্টা করে।
গৌতম রাজু আমিনুল, মিলন , সিদ্দিক আরো অনেকেই সেদিন এই অঞ্চলের নামকরা একটি রেস্টুরেন্টে-এর সামনে নিজেদের বাহন নিয়ে অর্ডার নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। একে অপরের পরিচিত হওয়ায় টুকটাক হাসি-মস্করাও চলছে, এমন সময় মিলনের কাছে নতুন অর্ডার ঢোকে। তার চোখে হাল্কা হাসি খেলে যায়,গৌতমের চোখ যায় মিলনের দিকে- কিরে, হাসলি কেন ওই ঠিকানাটা দেখে? - ও... কিছু না, এই বাড়িটাতে আগেও গেছি। - তো? শুধু এরজন্য হাসলি? বল্ না মিলন, কি ব্যাপার? গোপন কিছু?
গলাটা খাদে নিয়ে, একটু আড়াল করে মিলন বললো- - ওই বাড়িতে সৌনক চক্রবর্তী বলে একজন থাকেন, সবসময় একটা বেশি অর্ডার দেয় আর যে ডেলিভারী করতে যায় তাকে ওইটা দিয়ে দেয়। আজকে রাতে একটু ভালো-মন্দ পেটে যাবে। (একটু হেসে বলে) বড়ো ভালো মানুষ-রে দাদা, এইরকম লোকও আছে! মিলনের কথা শুনতে শুনতে গৌতমের-ও চোখ গোল গোল হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে বলে- আ.. মি চিনি ওনাকে, আমিও একদিন ওই এক্সট্রা বক্স-টা পেয়েছিলাম, মা-বাবা ভীষণ খুশি হয়েছিল সেদিন। উনি তো আবার অর্ডার -এর সঙ্গে টিপস্-ও যোগ করে দেন - কম করে হলেও পঞ্চাশ টাকা। সত্যি বড়ো ভালো মনের লোক।এই শহরতলীর অনেক জ্যোমাটোর ডেলিভারীর ছেলেদের এর কাছেই সৌনক চক্রবর্তী নামটা বিশেষ পরিচিত হয়ে যায়। এরা সবাই জানে, ওনাকে প্যাকেট দিতে গেলেই উনি ভালোবেসে আরেকটা ওদের হাতে ঝুলিয়ে দেবে। পয়সা রোজগার করতে বেরিয়ে উপরি পাওনা এই ভালোবাসা সবারই মনে দাগ কাটে।
সেদিন সকাল থেকেই সৌনকের শরীরটা ভালো লাগছিল না, মাথাটা টিপ্-টিপ্ করছে, কোমর- গা-হাত-পা ব্যথা, করছিল। বাসন্তী মাসি আবার কাজে যোগদান করলেও দুদিনের ছুটি নিয়ে দাদার বাড়ি গেছে, রান্না করে ফ্রিজে খাবার-ও রেখে গেছে, কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যের সময় প্যারাসিটামল খাওয়ায় শরীরটা একটু ঝর্ ঝরে লাগলে, জ্যোমাটোতে অর্ডার দেয়, পছন্দের দোকানের চাউমিন।
আটটা নাগাদ গৌতম সৌনকদার জন্য খাবার নিয়ে হাজির হয়। এখন আর ওরা লোকেশনে-এ এসে ফোন করেনা, সৌনকদার বাড়িতে কলিং বেল বাজিয়ে একদম হাতে দিয়ে দেয়। কিন্তু সেদিন দুবার তিনবার বেল বাজিয়ে ও দু-এক বার সৌনক -দা করে চেঁচিয়ে ডেকে,ফোন-এ পুরো রিং হয়ে যাওয়ার পর-ও সৌনকদার দেখা না পাওয়ায় গৌতম একটু ঘাবড়ে যায়। এমনিতেই ওর বাড়িটা পাড়ার শেষ প্রান্তে, আশেপাশে ফাকা, লোকজন- ও বিশেষ কাউকে এদিকে দেখা যায়না। ঘরের যে জানলার আলো বাইরের দিকে পড়েছে, সেদিকে গিয়ে পর্দা সরিয়ে তপন ভীষণ অবাক হয়ে যায়। দেখে, কিরকম অদ্ভুত ভাবে খাটের ধারে শুয়ে আছে সৌনকদা - বা হাত খাট থেকে নীচে ঝুলছে, বা-পা-টাও কেমন ধারের দিকে ঝুলে রয়েছে, মুখটা অন্যদিকে ঘোরানো। কিছুক্ষণ ওইদিকে তাকিয়ে, গৌতম হতবাক হয়ে যায়, কি করা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, সম্বিত ফিরতেই সে প্রথমেই মিলনকে ফোন করে। মিলন বাকিদের সব জানায়... সবাই প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে চলে আসে তাদের প্রিয় সৌনকদার বাড়িতে। রাজুর ওই অঞ্চলের জ্যোমাটোর জেনারেল ম্যানেজারের সাথে বিশেষ জানাশোনা থাকায় আর পুলিশের সহায়তায় সৌনক চক্রবর্তী -কে কোলকাতার হসপিটালে ভর্তি করা সম্ভব হয়।
কদিন প্রায় যমে-মানুষে টানাটানি যায়, কখনো রাজু কখনো গৌতম.... ওরা কেউ না কেউ হাসপাতালে থেকে, কখনো রাত জেগে যখন যা দরকার যোগান দিয়ে গেছে।কুচবিহার থেকে ওর মা-বাবা -খুড়তুতো ভাই এসে অর্থের ব্যবস্হা করলেও সৌনকের পাতানো জ্যোমাটোর ভাইয়েরা সমস্ত ছোটাছুটির কাজগুলো নির্দ্বিধায় স্ব-উৎসাহে করে যায় দিনের পর দিন। প্রায় একমাস হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফেরে সৌনক, সেদিন-ও তার সঙ্গী ছিল মিলন ৷ আরও একমাস পরে, আজ সৌনক চক্রবর্তী র ভাড়া বাড়িতে আনন্দ হইচই, বাড়িতে রীতিমতো ঠাকুর দিয়ে রান্না চলছে। সৌনকের জ্যোমাটোর ভাইদের আজ সারাদিনের নিমন্ত্রণ ঐ বাড়িতে, যার যখন সুবিধা এসে খেয়ে যাবে। ওরা নিজেরাই সবকিছু তদারকি করছে, গৌতম, মিলন আজ ছুটি নিয়েছে। শুধু ওদেরই নয় ওদের সাথে ওদের সকলের পরিবার নিমন্ত্রিত ৷ সৌনক বারান্দায় ঠায় বসে আছে তার এই বৃহৎ পরিবারের সদস্যদের সাদরে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। ওর মা-বাবাও ওদের এই মিলন উৎসবে সমান উৎসাহে মেতে উঠেছেন.... পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে তাঁরা বারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছেন, ভাগ্যিস্ সৌনকের এই ভাইয়েরা এখানে ছিল.... তা-না হলে কি যে হতো কে জানে ! আবার প্রমাণিত হল ভালোবাসায় কি না হয় ! মানুষই মানুষের জন্য ৷
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register