Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব - ৩১)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব - ৩১)

আমার মেয়েবেলা

গোপাল দা

স্কুল জীবন মানেই আমার কাছে খোলা একটা বড়ো আকাশ,,বড়ো একটা খেলার মাঠ। একটাই স্কুল তাই অনেক অনেক মায়া মায়া নরম নরম বন্ধু,,, একসঙ্গে বড়ো হয়েছি,, একসঙ্গে খেলা করেছি,টিফিন খেয়েছি, শাস্তি পেয়েছি,ঝগড়া করেছি, মারামারিও করেছি,ব্যথা পেলে পাশে পেয়েছি, সে শরীরের ব্যথাই হোক আর মনের ব্যথাই হোক, এখনও পাই, প্রিয়জন ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে মাথায় হাত রাখা, কোন কোন সময় জড়িয়ে ধরেছি আমার বন্ধু কে। একটা বাবা বাবা ফিলিংস হয়েছে। মনে হয়েছে আরে এই বন্ধুর গা থেকে কেমন বাবা বাবা গন্ধ! কখন ও ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধুর তফাৎ পাই নি। আজও পাই না। এ যেন এক অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক। দিনের পর দিন কথা না হয়েও কত কথা হয়। মনের ভেতর পরম বিশ্বাসে নিশ্চিন্ত হই। আছে তো ,,আছে তো আমার বন্ধুরা,, অসুবিধে হলে ডেকে নেব, নাহলে সটান হাজির হব। যেহেতু একটা ছোট্ট জায়গায় থেকেছি,,স্কুলের পরও সেই বন্ধু দের সঙ্গেই খেলাধূলা গল্প, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া তাই ফরক্কার সবাই আমরা বন্ধুই ছিলাম। ছেলে বন্ধু বা মেয়ে বন্ধু বলে আলাদা ভাবে সেভাবে কিছু ভাবতে পারিনি। পরমাত্মীয়ের মতো অনুভূতি টের পেতাম। তবে এরই মধ্যে সবার জীবনেই প্রেম এসেছে যেমন আসে স্বাভাবিক নিয়মে।আমার ও এসেছিল কিন্তু নিজেকে নিয়ে এতটাই কনফিউসড ছিলাম যে সেভাবে কাউকে ভালোবাসতেই পারিনি। কাউকেই মেলাতে পারিনি আমার অনিকেতদার সঙ্গে,,,,তবে অসম্ভব শাসনের মধ্যে থেকেও প্রেম কিন্তু এসেছিল আমার জীবনে এবং আমি সেটা অনুভবও করেছিলাম দারুন ভাবে,,, যা বলছিলাম,, স্কুলের কথা লিখতে গিয়ে একজনের কথা না লিখলেই নয়। সে হচ্ছে আমাদের গোপাল দা। স্কুল জীবনে আমাদের সবার ই একজন করে গোপাল দা থাকে। স্কুলের পাশাপাশি আদরে, ভালোবাসায়,, নিঃশব্দে,, অবহেলায় আমাদের সকলের জীবনে এমন একটা গোপাল দা থাকেই,,,স্কুল ছেড়ে আসার সময় স্কুল, ক্লাসরুম টেবিল বেঞ্চ ক্লাসের দেওয়াল দরজা জানলা টিচার্স রুম ,,সেই জল খাওয়ার জায়গা, বাথরুম বারান্দা লাইব্রেরী রুম,, সঙ্গে পান স্যার(লাইব্রেরীয়ান) খেলার মাঠ ,,স্পোর্টস, লাঠিনাচ, সঙ্গে এই গোপাল দার জন্যও মনের ভেতরটা টনটন করে উঠেছিল। স্কুলের সঙ্গে গোপালদা যে কতখানি জড়িয়ে ছিল তা স্কুল ছাড়ার পর টের পেয়েছিলাম।,,,,, ##### আমার বয়স তখন ৬/৭। আমি তাকে প্রথম দেখে ছিলাম স্কুল গেটের সামনে। কি যেন যাদু ছিল ওর মধ্যে। আমাকে সব সময় ওর দিকেই টানত। স্কুলে আমায় যেতেই হবে। একদিন স্কুল যাওয়া বন্ধ তো আমার সব গেল। চোখ বন্ধ করে ওর সমস্ত আচার চেখে নিচ্ছি। গুড় বাদাম খাচ্ছি পা দুলিয়ে। কারেন্ট নুন,, আহা মুখে দিলেই কারেন্ট লাগত যেন। আমিই নামটা দিয়ে ছিলাম। বাড়িতে থাকলে তো তার সঙ্গে দেখাও হবে না আর এসব খাওয়াও হবে না। তখন আমার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ছটফটানি। ওর কথা ভেবে ভেবে ঠিক মতো ক্লাসই করতে পারতাম না। টিফিনের আগে তো আমার পাগল পাগল অবস্থা। আজ এসেছে তো গোপাল দা! আজ কি কোন নতুন আচার এনেছে?
যেই টিফিনের ঘন্টা পড়ত আমি ছুট্টে গিয়ে দেখতাম গোপাল দা এসেছে কিনা।তাকে দূর থেকে দেখে কী যে আনন্দ হত আমার।ওর সামনে তখন ভীষন ভীড়।কাছে যাওয়ার উপায়ই নেই।আমি দূর এ দাঁড়িয়ে থাকতাম।অত ঠেলাঠেলি করে ওর কাছে যেতেই পারতাম না। গোপাল দা ঠিক খেয়াল রাখত। আমায় চোখের ইশারা করত। আমি হাতটা বাড়াতাম। আর সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যেতাম আমার পছন্দের আচার ঝালমুড়ি কটকটি গুড় বাদাম। ঝালমুড়ি ওলা গোপালদার কথা বলতে গিয়ে কত কিছুই যে মনে পড়ছে।কী যে ভালোবাসত আমাদের কী বলব। কীভাবে যে বুঝতে পারত আমি সেদিন কোন আচারটা খেতে চাইছি। আজও মাথায় ঢোকে না। আমার ছোট্ট হাতে চলে আসত রকমারি লোভনীয় খাবার। খাবারটা নিয়েই আমি নাচতে নাচতে চলে আসতাম ক্লাসে। ভাবখানা এমন যেন বিশ্বজয় করে ফিরছি।আর যারা পেতনা তারা শুকনো মুখে আমার আচার খাওয়া দেখত। যাদের সঙ্গে ভাব থাকতো তাদের একটু করে দিতাম। কিন্তু যাদের সঙ্গে আড়ি থাকত তাদের কে তো দিতামই না উল্টে তাদের কে দেখিয়ে দেখিয়ে খেতাম। আজও সব মনে আছে সেই বন্ধু সেই স্কুল সেই ক্লাসরুম সেই আমাদের প্রিয় গোপাল দাকে।বছর পাঁচেক আগে তার সঙ্গে দেখা করে এলাম। এখনও ফরাক্কাতেই আছে। অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম গোপাল দা তুমি ভালো আছ? ছোট বেলায় ওকে কোনো দিনই জিজ্ঞেসই করিনি। মনেও আসিনি সেই কথা। রেজাল্ট বেরোনোর দিন গেটের সামনে শুকনো মুখে একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। গেট থেকে বেড়োলেই জিজ্ঞেস করত পাশ করেছ তো? কিংবা আমাদের হাসিমুখ দেখলেই বুঝে যেত। ছোট্ট একটি হাসি ফেরত দিয়ে হাতটা একটু আলতো করে নাড়ত। টাটা করার মতো করে। আমরাও টাটা করে দুভাইবোন বাবার সাইকেল এ বসতাম। কত আন্তরিকতা ছিল গোপাল দার মধ্যে। রাস্তায় দেখা হলেই জিজ্ঞেস করত ভালো আছ তো দিদিমণি বাড়ির খবর সব ভালো তো? কিন্তু আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করাই হত না। কিন্তু এবার গিয়ে ওকে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করেছি তুমি ভালো আছ তো গোপাল দা? তোমার কথা খুব মনে পড়ে। তোমাকে একটুও ভুলি নি জান? চোখ ভর্তি জল নিয়ে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল অনেক বড়ো হও দিদিমণি। কথাটা শুনে কেন জানিনা বুকের বাঁ দিকে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করেছিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপাল দাকে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধীর পায়ে চলতে চলতে ভাবতে লাগলাম,,,, কী জানি বড়ো হয়েছি কিনা,,,এর উত্তর তো আমার জানা নেই,,,,,,,

ক্রমশঃ

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register