Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (উনপঞ্চাশৎ পর্ব)

আমার নিজেকে কেমন যেন নির্ভার মনে হচ্ছে। যেভাবে শিমুলতুলো বাতাসে উড়ে বেড়ায়, সেভাবেই যেন আমি এগিয়ে গেলাম সেই আধশোয়া বিবসনা নারীমূর্তির দিকে। এক অপূর্ব সুন্দর আলোয় ভেসে যাওয়া তরঙ্গে আমার চেতনাশরীর যেন সাঁতরে চলেছে। এগিয়ে দেওয়া স্বর্ণচাঁপা আঙ্গুলের তর্জনীতে বাঁধা পড়লো আমার তর্জনী। আমি ক্রমশ বক্ষলীন হচ্ছি। যেভাবে পুস্পসৌরভ মিশে যায় মলয়বাতাসে, যেভাবে মেঘজল এসে মিশে যায় নদীজলে, সেভাবেই যেন আমরা দু'জন, আমাদের শরীর মিশে যাচ্ছে। সেই নারীমূর্তির ওষ্ঠে আমার ওষ্ঠ, তাঁর অধরে আমার সোহাগরেণু, তাঁর চূর্ণ কুন্তলে আমার আঙুল, তাঁর পদপাতে আমার পায়ের পাতা। গভীর, সে কোন অতলে অথচ সেখানে কোনো আঁধার নেই, উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যাচ্ছি আমি।
কতক্ষণ যে এভাবে ছিলাম জানি না। আমার কর্ণকুহরে যেন অতিদূর থেকে ভেসে আসছে এক পরিচিত সুর, কে যেন আমার আপন সত্তায় সুরে সুরে আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছেন। ক্রমশ আমি উপলব্ধি করলাম অন্য কেউ নন, স্বয়ং আমিই সুরে বেঁধেছি আমার আমিকে। --" নয়কো বনে, নয় বিজনে নয়কো আমার আপন মনে সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয় সেথায় আপন আমারো বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও। সবার সাথে যেথায় বাহু পসারো সেইখানে প্রেম জাগিবে আমারও গোপনে প্রেম রয় না ঘরে আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে সবার তুমি আনন্দধন, হে প্রিয় আনন্দ সেই আমারও --"
জানি না, এ কি ভাবাশ্রু, নাকি প্রেমাশ্রু, নাকি আনন্দাশ্রুতে ভাসছি আমি। আমার সামনে সেই পরিচিত ছবি, ডানদিকে কানাইদা, বাঁদিকে ধ্রুবদা, মুখোমুখি সেই সাধুবাবা, পেছনে ছুটকি আর ধ্রুবদা আর সাধুবাবার মাঝখানে -- না কোনো স্থির শিখায় প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ না, দাঁড়িয়ে আছে বাউলনি। তবে এখন আর আগের সেই বিমর্ষ ভাব নেই, এখন যেন মুখময় খেলে বেড়াচ্ছে লজ্জারাঙা শুক্লা নবমীর চাঁদের আলো। কানাইদা দু'পা ঘষটে আমার কাছে এলেন। দু'হাত দিয়ে আমার দু'চোখের পাতা থেকে পরম আদরে জল মুছিয়ে দিচ্ছেন। -- " পদীপদাদা, জানি না মা তারার এ কী লীলা গো, তুমি যে রূপ দেকলে সে কিন্তু আমার কিষ্ণভামার লয় গো, সে রূপ স্বয়ং মা তারার। তুমি যে থির হয়ে জ্বইলতে থাকা পিদিমের আলো পত্যক্ষ করেচো, সেই তো তিনি গো। তিনি ছলনা করে মা কৃষ্ণভামার রূপে নিজে প্রকট হয়েচিলেন।" মনে পড়ছে বাউলনি আমায় বাউলতত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছিলো যে বাউলের একই অঙ্গে নারী পুরুষের অবস্থান। প্রকৃত বাউল প্রয়োজনে আত্মরতিতেই নিজের সাথে দয়িতার মিলন ঘটাতে পারে। নদীও আমাকে সেই একইরকম কথা বলেছিলো। তাহলে এই কি আত্মরতির স্বরূপ? কিন্তু আমি যে আমার অবস্থান বদল করিনি, সেটা তো পরিষ্কার। তাহলে আমায় নিয়ে যিনি খেলায় মাতলেন, তিনি যেই হোন না কেন, আমাকেই তার প্রয়োজন হলো কেন? -- " প্রদীপবাবু, তুমি, আপনি যেটা প্রত্যক্ষ করলে সেটা সাধারণের কাছে অলীক। বস্তুবাদীরা এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারবেন না। এটা ভাববাদের একটা চরম অবস্থা। আমরা এতক্ষণ যাবৎ যে অবস্থার আলোচনা করছিলাম, তুমি সেটাই প্রত্যক্ষ করলে। এ অতোটা সাধারণ বিষয় নয়। তুমি খুব ভালো আধার। সেজন্যই এ ঘটনা ঘটতে সুযোগ পেলো। এটা কিন্তু কোনোরকম রতিক্রিয়া নয়। এ হলো গে মিলন, পরম মিলন। এ বড়ো সাধারণ ঘটনা নয় গো, দাদা। তুমি কতোটা ভাগ্যবান আমি জানি না, তবে এ মুহূর্তকে প্রত্যক্ষ করাবেন বলেই বোধহয় মহাকাল আমায় এখন এখানে উপস্থিত করিয়েছিলেন। " আমি কথাগুলো শুনছিলাম বটে, কিন্তু আমার চোখ আটকে ছিলো কৃষ্ণভামার দিকে। কী অপরূপ রূপে নিজেকে সাজিয়েছে বাউলনি! মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলার সময় যেরকম আলো ছায়ার খেলা চলে, যেন সেরকমই আলোর খেলায় মেতে উঠেছে বাউলনি। --" ফের একবার গানটা গাও না গো পদীপদাদা, আহা -- কী অপূব্ব কথা , আর সেরকমই তার সুরের বাহার। বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো -- বাউলরাজা ছাড়া এ গান আর কে বাঁদবেন বলো দেকি! সচ্চিদানন্দের কাচে মিলবার কী অপূব্ব আকুতি, সবার তুমি আনন্দধন, হে প্রিয় -- এ গানই তো বলে দিয়েচে গো, তোমার সাতে তার মিলনের কতা। কোন শরীলরে ভর কইরে কার সাতে মিলনের লীলা সাঙ্গ করলে গো ঠাকুর! "

চলবে

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register