Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

maro news
সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (একচত্বারিংশ পর্ব)

আমার মনে সুর আসছে। আসছে না বলে ভাসছে বলাই হয়তো বা ঠিক হবে। ভাসছে কিন্তু ধরতে পারছি না। কারণ, সুরের সাথে বাণীর যুগলবন্দী ধরা দিচ্ছে না। শুধুই সুর, এক অনির্বচনীয় ঐশ্বরিক সুর। এ যেন --" তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর পেলেম না "। এদিকে তখন আমার তুরীয় অবস্থা। একটা আশ্চর্য স্বপ্নের ঘোরের মতো, অথচ স্বপ্ন নয়। চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো একের পর এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আলোচনার যে আশ্চর্য জ্যোতি, সে জ্যোতি যে কোনো জন্মান্ধ মানুষকেও চক্ষুষ্মান করে তুলবে।
--" গৌরলীলার বাজারে, অবাক যাই হেরে ওরে ছুঁচের ছিদ্রে মজার কথা পার করে গজ বরে।
নতুন সজনে গাছেতে জোড়া আম ধরেচে আবার আমের ভিতর জামের চারা কাজল কালো জাম ধরেছে সে গাছে। তার নীচেতে বাঁকা নদী সেথায় প্রেম ঝরে আর ক্ষীর ঝরে।
একটা সাপে নেউলে দুটো ইঁদুর বিড়ালে এক ঘরেতে বসত করে, একই মিশেলে। "
আমি কি ভুল বলি? কানাইদার কি এখন গান ধরার কথা ছিলো? তাও আবার এই গান? এ গান কি কানাইদা ধরলেন, না কি সময় ধরালো? সময় অন্ধকেও আয়ুষ্মান বানিয়ে ছাড়ে।
--" একই ফুল ঝরি আমি দুটি কামনায় আমাকে প্রদীপ করে এ কী আলো দিলে জ্বেলে না পেলে বুকের জ্বালা সে তো নিভে যায়, এ কী অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়? "
আমার গলার থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো ছত্রগুলো। হায় ভগবান! কোথায় রবিঠাকুরের গান বেরোবে, একান্তই না হলে লালনের। কিন্তু তাই বলে শেষপর্যন্ত মান্না দের কণ্ঠনিঃসৃত সুর? এই সুরই কি গোলাচ্ছিলো পেটের ভেতর, বাণীর অভাবে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না!
সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। প্রথম মুখ খুললেন কানাই বাউল। --" আহা, থামলে কেনে গো ঠাকুর! দেওঘরের প্যারার থেকে একটুকরো ভেইঙে মুকে দে বাকীটা সরিয়ে রাকলে রসনার কী অবস্তা হয় বলো দেকি ! " --" এ কার গান প্রদীপ ভাই? কি অপূর্ব সুন্দর বাণী ! কি সুর ! কি জোছনা গো সারা অঙ্গে ! থামলে কেন ভাই ? " সে কি! এই গানও তাহলে এই শ্মশানভূমে, একজন নাগা সন্ন্যাসী আর একজন খ্যাপা বাউলের মনের তারে ঝঙ্কার তুলেছে! জয় গুরু, জয় মান্নাসাহেব।
মগজে ধুয়োর মেঘ তখনও জমাট বেঁধে আছে। পৃথিবী যে এত দোলনশীল, সেটা কে জানতো? পেন্ডুলামের মতো দুলছে পৃথিবীটা। তবে ফারাক একটা আছে, এ দোলন সেকেন্ডে একবার করে দোলে না, তার চাইতে প্রলম্বিত সময়ে পেন্ডুলামটা দুলছে। হয়তো পাঁচ সেকেন্ডে, নয়তো দশ সেকেন্ডে, পনেরো বা কুড়িও হতে পারে। তবে দুলছে যে এটা ঠিক। আমার মুখের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে দু'জোড়া চোখ। ভুল বললাম। একজোড়া চোখ, আর একটা মন। ধুস কী সব আবোলতাবোল ভাবছি, কানাই বাউল যদি অন্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে দুনিয়ায় কেউই চক্ষুষ্মান নন।
-- " এ কি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায় ভালোবেসে, ভালোবেসে রাজা বা ফকির দুইই হওয়া যায়, দুইই হওয়া যায়, দুইই হওয়া যায়, এ কি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়, এ কি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায় এ কি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায় ! কখনো সমাধি পরে কখনো বাসর ঘরে কখনো সমাধি পরে কখনো বাসর ঘরে কখনো সমাধি পরে একই ফুল ঝরি আমি দুটি কামনায় -- একই ফুল ঝরি আমি দুটি কামনায় দুটি কামনায় দুটি কামনায়... "
কতক্ষণ ধরে যে গাইলাম গানটা জানি না। পাঁচ মিনিটও হতে পারে, পঞ্চাশ মিনিটও হতে পারে। গানটা শেষ করে একটা ঘোরের মধ্যে চুপ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। ঘোর ভাঙলো আমার ডান হাতের পাঞ্জায় কানাইদার দু' হাতের চাপে। দেখলাম কানাইদার দু'চোখে শ্রাবণের ঢল নেমেছে। নাগাবাবা শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। এতো স্থিরভাবে কোনোদিনও কাউকে বসে থাকতে দেখিনি।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register