Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || ঘুড়ি || সংখ্যায় সুনন্দা চক্রবর্তী

maro news
T3 || ঘুড়ি || সংখ্যায় সুনন্দা চক্রবর্তী

গোলাপি ঘুড়ি আর মিতুল

এইমাত্র শ্রী মার্কেট থেকে তিনটে চুড়িদার কিনে ফিরেছে মিতুল। আজ খুব ভিড় ছিল মার্কেটে। তা দেখে সুমেধা বলল, “আরে, আজ বিশ্বকর্মা পূজা তো সব বোনাস পেয়ে কেনাকাটি করতে এসেছে।” এইজন্য মিতুল এই কেনাকাটার পর্বটা আগেই মিটিয়ে ফেলতে চায় কিন্তু বন্ধুরা বলবে যে এতো আগে থেকে কিনলে এবারের লেটেস্ট ফ্যাশনটা ক্যাপচার করা যাবে না। মিতুল এই যে ওড়না দেওয়া চুড়িদার কিনল এই নিয়েও সবার সে কি হাসাহাসি, আজকাল কেউ ওড়না ইউজ করে না, আজকাল কুর্তি অ্যান্ড টাইট লেগিন্স আনে স্মার্ট লুক আর ট্রেনে বাসে চলতেও সুবিধা। মিতুলের পরিবার খুব কনজারভেটিভ বলে মিতুল কুর্তি পরলেও ওড়না নেয়। এইতো মা মামীমনিকে বলে দিয়েছে যে মিতুল বড় হয়েছে কলেজে পড়ে তাই কিছু শাড়ি হওয়া প্রয়োজন। মামীমনি মাকে একটা খেস আর মিতুলকে টিস্যু শাড়ি দিল ডিজাইনার পাড় বসানো। পিমা ও একটা ভাগলপুরী দিয়েছে গোলাপি রঙের জরি রঙের ফুলছাপ দেওয়া। মিতুল ভাবছে কবে ঐ শাড়িটা পরে গোলাপি আঁচল উড়িয়ে বন্ধুদের সাথে ঠাকুর দেখতে বেরোবে? এইসব ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে এসেছিল কলিং বেলের আওয়াজে তন্দ্রা চটকে গেল। পাশে মা অসাড়ে ঘুমাচ্ছে দেখে দরজা খুলে দেখে কাজের মাসি। “মাসি, তুমি তো এখন রুটি বানাবে, বাসন মাজবে, ঝাড়ু দেবে অনেক কাজ আমি তাহলে ছাদে বসেই যোগা করি”, এই বলে নীল রঙের ম্যাট বগলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে চলল। মিতুলদের চারতলা ফ্ল্যাটের এই ছাদটা আগে অপুদার দখলে ছিল। তখন মিতুল কত ছোট, মায়ের হাত ধরে ছাদে আসত বড়ি শুকাতে দিতে, কখনও লেপ কম্বল রোদে দিতে, গরমকালে শুতে যাওয়ার আগে গা ধুয়ে ছাদ ঘুরে ঘুমাতে যেত। বাবা ঐ যে ছাদের পশ্চিম কোনটায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেত, মা আলতো পায়ে হাঁটত গলায় হালকা রবীন্দ্র সঙ্গীত গুনগুন করতে করতে, মিতুল হাঁ করে চাঁদ দেখত, চরকা বুড়িকে খুঁজত। তারাদের ভিড়ে জ্যাঠুন, দিম্মা, ঠাম আর স্কুলের হেড মিস্ট্রেস লুনা ম্যাডামকে খুঁজে বেড়াতো। কিছুদিন আগেই লুনা ম্যাডাম এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। যে তারাটা বেশি বেশি ঝিকঝিক করত মিতুল ভাবত ওটা নিশ্চয় জ্যাঠুন, জ্যাঠুন তো সবসময় ওরকম ঝকমকিয়ে হাসত। আর চুপ তারাটার নাম দিত দিম্মা, যে নীরবে সংসারের সব কাজ করে যেত। অপুদা এই ছাদে পড়াশুনা করত, রেডিওতে গান শুনত, এমনকি জলখাবার তো খেতই কখনো শীতের দুপুরে ভাতের থালাটা নিয়েও উঠে আসতে দেখেছে মিতুল। এখন সেই অপুদা কত ব্যস্ত মানুষ, হায়দ্রাবাদে চাকরি করে। আগে প্রতি পূজায় আসত কিন্তু ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবার পর আসতে পারে না। আসলে চারতলায় ছিল অপুদাদের ঘর। আর বাকি তিনটে ঘরে কেউ থাকত না, তালা বন্ধই থাকত আজও যেমন আছে। মিতুলরা তিনতলায় বলে মাঝে মাঝে আসত। একতলা, দোতলার কেউ ছাদে আসতই না। অপুদার অনেক গাছ ছিল, যত্নে ফুল ফুটত। এখন ফাঁকা টবগুলোতে মিতুল বন্ধুদের বাড়ি গেলে গাছের চারা সংগ্রহ করে আনে, লাগায়, জল দেয় সুন্দর ঝাপড়া হয়েছে কয়েকটা পাতাবাহারি। বাবা সেবার রথের মেলা থেকে দুটো জুঁই এনে দিলে সেই গাছ দুটো এবারের বর্ষায় কিছু ফুল দিয়েছিল এসব ভাবতে ভাবতেই মিতুল ভাবল সামনের বার একটা স্থল পদ্ম আর শিউলি লাগালে কেমন হয়? যোগা ম্যাট পেতে মিতুল সকালে এখানে যোগা করে, গাছে জল দেয়। সূর্যের নরম রোদ গাল ছুঁলেই মিতুল নিচে নামে। এখন যোগা ম্যাটটা পেতে শুয়ে পড়ে । আকাশ দেখতে মিতুলের খুব ভালো লাগে, নেট সার্চ করে যখন আকাশের কর্মকাণ্ড দেখে, মহাবিশ্বের রহস্য পড়ে কেমন একটা হাতছানি অনুভব করে। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ভাবছিল, আকাশের রঙ এতো গোলাপি কেন? আচ্ছা, আলো আর অন্ধকার কি প্রেম করে? ওদের মনে হয় এই শেষবিকালে রোজ দেখা হয়, প্রেমালাপে এমন গোলাপি গোলাপি হয়ে যায়, কখনো রাগে কমলা, অভিমানে বেগুনী নয়ত এই বিকেলেই আকাশের বুকে এতো রঙের ছটা কেন বাপু? কখন এতো রঙ খেলে মুখের আভায়? এই তো সুস্মিতার যখন প্রণবদার সাথে দেখা হয়, ওরা কথা বলে আর মিতুল দূরে দাঁড়িয়ে থাকে গান্ধিঘাটের রেলিং ধরে তখন আড়চোখে দেখে প্রণবদার কথা শুনে সুস্মিতার গালের রঙ পাল্টে পাল্টে যায়। ওখান থেকেই ওরা বি কে ডির কাছে ফিজিক্স পড়তে যায়। আকাশে আজ অনেক ঘুড়ি তো। একটা বেগুনী ঘুড়ি আর একটা লাল ঘুড়ি পাশাপাশি অনেকক্ষণ থেকে উড়ছে, মাঝে মাঝে একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সরে যাচ্ছে কেউ কিন্তু কাউকে কাটছে না, তার মানে ও দুটি সখ্যতার ঠিক সুস্মি আর প্রণবদা যেন। একটা হলুদ ঘুড়ি, এ বাবা ওটাতো কেটে গেছে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসেই চলেছে, এখনও উঁচুতে আছে তো কোনও সময়ে ঠিক নারকেল গাছের পাতায় আটকে যাবে। আহারে! একলা ঘুড়ি ঠিক যেন নিনা পিসির মতন একদম একা বিচ্ছিন্ন। মিতুল একা থাকতেই পারে না। ভাইয়ের জ্বালায় একা থাকাই তো দায়। মিতুলের থেকে ঠিক ছয়বছরের ছোট ভাই আছে। আজ বিশ্বকর্মা পূজা, ও হরি! এই জন্য এতো ঘুড়ি আকশের বুকে। ঘুড়িকে শুধুই আকাশের বুকে ওড়ে? কিছু কি লিখে দেয় না অতো চওড়া জমিতে? একটা গোলাপি ঘুড়ি একদম একা একা এক কোণে আস্তে আস্তে নিজের খেয়ালে উড়ে চলেছে। বোঝাই যাচ্ছে, লাটাইটি যার হাতে তার কোনও কম্পিটিশন নেই, সে এক আপন ভোলা। শুধু শূণ্যে ঘুড়িটাকে ভাসিয়েই তার সুখ। মিতুল বসে বসে গোলাপি ঘুড়িটার প্রেমে পড়ে গেল, দুটো গানও গাইল। আস্তে আস্তে অন্ধকার নামবে, গোলাপি ঘুড়ি চলে যাবে তার গন্তব্যে আর কি দেখা হবে গোলাপি ঘুড়িটার সঙ্গে? এমন সময় কোথা থেকে একটা নীল ঘুড়ি সাঁ সাঁ করে গোলাপি ঘুড়ির দিকে তেড়ে এলো। গোলাপি ঘুড়ি যত সরে নীল ঘুড়ি গায়ে পড়ে আলাপ জমানোর চেষ্টায়। ইশ! গোলাপি ঘুড়ি, কক্ষনো পাত্তা দেবে না এমন আগন্তুককে । কত খায়? বদমাশ ! কিভাবে এইসব গোলাপি ঘুড়িকে বোঝাবে মিতুল যে অচেনা অজানা কাউকে পাত্তা দিতেই নেই? উত্তেজনায় মিতুল টানটান। আস্তে আস্তে গোলাপি মহাশূন্য থেকে নিচে নেমে আসছে, হাঁপিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়? নীল ঘুড়িও ছাড়বার পাত্র নয়। ধুর বাবা! নীল ঘুড়িটা কি বুঝতে পারছে না যে গোলাপি ঘুড়ি কিছুতেই কোনও আকচা আকচিতে নেই? ও নিজের মত থাকে একেবারে যেন মিতুল। নীল ঘুড়ি দুবার প্যাঁচ দিলেও গোলাপি প্যাঁচ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে। সাবাস! পিঙ্কি সাবাস! মিতুল পিঙ্কি নাম দিয়ে নিজেই খানিকটা হেসে নেয়। হঠাৎ গোলাপি ঘুড়িটা হু হু করে নীল ঘুড়িটার পাশে গিয়ে পাক খেতে থাকে। এমা! এরা কি সাতপাকে বাঁধা পড়বে? অপছন্দকেও কি একসময়ে মেনে নিতে হয়? পাগলের মত কয়েকটা পাক হ্যাঁচকা টান। রুদ্ধশ্বাস মিতুল চোখে জল, মন বিষণ্ণ। ওমা! নীল ঘুড়ি ভো কাট্টা। আনন্দে নেচে নেয় মিতুল। আপন মনে আকাশের বুকে উড়ে চলেছে গোলাপি ঘুড়ি মিতুলের পিঙ্কি। এইবার সন্ধ্যে নামবে। মেয়েরা জিতবে এবার।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register