Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || ঘুড়ি || সংখ্যায় জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

maro news
T3 || ঘুড়ি || সংখ্যায় জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

স্মৃতির ঘুড়িবেলা 

চিরকাল তাদের মনে হয়েছে পাখির মতো অলৌকিক রহস্যময় মুক্ত এক জাদুপাখি,এক ইচ্ছাপূরণ বার্তাবহ আর মুক্তির সমার্থক একরাশ অহংকার। হতে চেয়েছি তেমনই কিছু,তারই মতো বা তার চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী,সব বাঁধনের উপরে যে।কোনো আকর্ষণের অলঙ্ঘ্য নিষেধ ভাবার প্রশ্নই ছিল না তখন কেবল মুক্তি আর মুক্তির গরিমা। আমাদের ছোটোবেলায় ঘুড়ি বলতে দোকানে পাওয়া যেত পাতলা রঙিন কাগজে তৈরি একরকম ঘুড়ি।বড়ো দুর্বল সেগুলো, কোনো আঘাত পেলেই ফর্দাফাঁই।তাকে বিশ্বাস করাই যেত না।যে-কোনো মুহূর্তেই অস্ত্রহীন হয়ে একা হাবাগোবা মুখে অন্যের ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে দুঃখে আফশোশে নিজেকে জারিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকত না। নিজেদের বানানো ঘুড়ির প্রচলন ছিল বেশি অন্তত আমাদের গ্রামগুলোতে। পলিথিন পেপারের যে নাছোড় লড়াকু ঘুড়ি আর শক্তিশালী যে ঘুড়ি বা মারাত্মক সুতো এখন প্রচলিত,চিনা মাঞ্জা আর মা উড়ালপুলের আতঙ্ক আমাদের শিহরিত করে তার নামও তখন কেউ জানত না।আমাদের সুতো ছিল দুর্বল গুলিসুতোর।তাতে দ্রুত পড়ত গিঁটের উপর গিঁট। আমাদের পাড়ার দাদু,কাকা-জ্যাঠা- দাদাদের উদ্যোগে সাইজ করে কাটা কাগজে নারকেল ঝাঁটার কাঠি ঠাকুমাকে লুকিয়ে খুলে এনে কাগজ দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় চেটানো হতো।সে কাগজও খুব টেকসই হত না।রঙিন ক্যালেন্ডারের পাতা ছিল শক্ত কিন্তু ভারী।তাই বেশি উঁচুতে ওড়ার ক্ষমতা তার ছিল না। কাগজ চিটানোর জন্য চাই আঠা,ফেভিকল জাতীয় সিন্থেটিক আঠা গ্রামে পাওয়া তো দূরের কথা,নামই শোনেনি কেউ।তাই প্রধানত আটা গুলে একটু আগুনে গরম করে নিলে আঠালো ভাব বেড়ে যেত।ছিল বাবলা গাছের গঁদ বা আঠা,একটু জল দিলেই চিটিয়ে ধরত,তবে তারও সমস্যা ছিল জল লাগলেই চিট খুলে যেত।আরও একটা আঠা খুব প্রিয় ছিল চিটফলের আঠা,অনেকে বলত,বয়ের কুঁড়ি ফলের আঠা।বেশ চিটালো,শুকিয়ে গেলে আরও শক্ত টান এসে যেত। এরপর লাঙুল কাহিনি,লম্বা করে কাগজ কেটে জুড়ে ল্যাজ তৈরি করা হতো।সে ছিল বেশ মজার 'ঘুড়ির ল্যাজ' !সেখানেও সমস্যা,ঘুড়িতে সুতো জোড়ার আগে সহজভাবে বললে বলা যায়,ঘুড়ির দেহটাকে কল্পনা করে ঘুড়ির বুকে আর কোমরে ঝাঁটাকাঠির দু-পাশে দুটো করে ফুটো করে নিতে হয় তারপর দাঁড়িপাল্লার মতো দুদিকের ওজন সমান করে সুতো বাঁধা হতো।আমরা ছোটরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতাম আর ভাবতাম,কবে আমরা ওইরকম করে সুতো বাঁধতে পারবো।ল্যাজওয়ালা ঘুড়ি উড়তো,তার ল্যাজ ছিল ভারী কখনো তাতে কাঁচা খেজুরপাতা ছিঁড়ে গিঁটিয়ে দেওয়া হতো।উদ্দেশ্য ? বেয়াড়া ঘুড়িগুলো মাঝেমাঝে ঘুরতে শুরু করত আর গোঁত্তা খেয়ে নীচে পড়ত।তা ছিল প্রায় হৃদয়বিদারক ঘটনা।ফলে সব আনন্দ বিস্বাদ হয়ে যেত।ল্যাজ ভারী হলে ঘুড়ি ঘুরতে পারত না।হাওয়া কম থাকলে সুতো ধরে জোরে দৌড় দিতাম তাতে ঘুড়ি বেশ উড়ত। কিন্তু এখানে একটা কথা না বললেই নয়,চিরকাল শত্রুর ঘুড়ি,মানে প্রতিদ্বন্দ্বীকে মন্দভাবে শত্রুই বলে,খুব ভালো উড়তো।মনের আক্ষেপ বন্ধুকে বলে সান্ত্বনা খুঁজতে হত। আর একটা বিষয়ে মনে তীব্র অশান্তি জমত,নারায়ণ দেবনাথ মশাইয়ের ছবিতে যে লেজহীন ঘুড়ি সুন্দরভাবে আকাশে উড়ে যেত,আমাদের ঘুড়ি তার ধারে-কাছে যেত না,তার একটা কারণ ওই লাঙুলবিভ্রাট,ভারী ল্যাজ তাকে মাটির দিকে টানত।কিন্তু বহুবার চেষ্টা করেও শুধু ঘুড়ি মানে ল্যাজহীন ঘুড়ি ওড়াতে পারিনি,তা শুধু পাক খেয়েই যেত,উপরে আর উঠতো না।এই অক্ষমতা আমাদের খুব কষ্ট দিত,স্মৃতিতে এখনো সেই যন্ত্রণা টের পাই। এমনদিন কম ছিল না যেদিন স্কুল থেকে ফিরে কিছু খেয়েই ঘুড়ি নিয়ে ছুটতাম রাস্তায় সেখান থেকে মাঠে মাঠে, আল টপকে ছুটছি,দূর গ্রামেও চলে গেছি কতদিন,সঙ্গে থাকত বন্ধুরা। স্কুল থেকে ফিরেই দেখতাম ঠাকুমা কাঁসার বড়ো বাটিতে দুধ,সর ও চিনি মাখা মুড়ি নিয়ে নাছোড় মুখে দাঁড়িয়ে।সেটা খেতেই হবে নইলে খেলতে যাওয়ার পারমিশন মিলবে না,দাদুকে ও বাবাকে নালিশ হবে,বকুনিও জুটবে। দুধমুড়ি ছিল আমার অত্যন্ত অপছন্দের খাবার(তার বদলে চপমুড়ি বা সিঙাড়ামুড়ি প্রিয় ছিল,এবং আছে এখনো),ঘুড়ি ওড়াতে বা ফুটবল খেলার নেশায় গোগ্রাসে কালমেঘের রস পানের মতো তাই গিলে দে দৌড় দিতাম। আহা! সেই গভীর আনন্দ ও চাপা দুঃখের ঘুড়িবেলা কিন্তু আমাকে ছেড়ে যায়নি এখনো, ছোটোদের ঘুড়ি ওড়াতে দেখলে আমি আজও সেই দুরন্ত বালক হয়ে ফিরে যাই প্রিয় ঘুড়িবেলায় বারবার।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register