Wed 24 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || ১লা বৈশাখ || 26য় তনিমা হাজরা

maro news
T3 || ১লা বৈশাখ || 26য় তনিমা হাজরা

নতুন বছরের ভিতর-বাইরের গপ্প

সময়শকটে চড়ে যদি আমরা এমন একটা ক্ষণে পৌঁছে যাই যখন মানুষ ঋতু গণনা করতো আকাশে নক্ষত্রের অবস্থান ও জলবায়ুর পরিবর্তন দেখে।

তাপমাত্রা এবং বৃষ্টির গতি অনুযায়ী তাই ঋতুগুলির নামকরণ এবং ঋতু অন্তর্ভুক্ত মাস গুলির নামকরণ তৎকালে, দৃশ্যমান নক্ষত্রের নাম অনুসারে।

বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র।

আর এই বিশদ অভিজ্ঞতা থেকেই তারা ফসল বপনের সময় নির্ধারণ করতো। যে শস্যের উদগম ও বৃদ্ধির জন্য যেমন উত্তাপ ও জল প্রয়োজন তেমন শস্য রোপণ করা হত সেই ঋতুতে। ফলে বর্ষগণনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হচ্ছে কৃষিকাজ। আর কৃষিকাজে উৎপাদিত ফসলের ভাগ দেওয়ার রীতি গোষ্ঠীপতিকে সেই আবহমানকাল থেকেই, সেই ভাগই পরে খাজনার রূপ নেয়। তাই ফসল উৎপাদনের সময়কালের সাথে সাথে বৎসর শুরুর এক গভীর যোগাযোগ। ক্ষেতে ফসল উঠলে পরে সম্বৎসরের খাজনা আগে রাজাকে মিটিয়ে তবে চাষা নিজের ভাগ ঘরে তোলে।

ক্ষেত থেকে ফসল মরাইয়ে উঠতে না উঠতেই হামলা করে দস্যুবাহিনী, তারা জোর করে কেড়ে নিয়ে যায় চাষির সারা বছরের শ্রম। তারপর আসে রাজার পেয়াদা বরকন্দাজ, তারা ঘাড় ধরে কড়ায় গন্ডায় আদায় করে রাজকর।

১৭৫১ সালের মে মাসে আলিবর্দি খাঁর সঙ্গে মারাঠাদের সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। এরপর বাংলায় বর্গি হানা বন্ধ হয়। কিন্তু বর্গি হানার ছড়া গান রয়ে যায় কালের সাক্ষী হয়ে:- খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিবো কিসে, ধান ফুরালো, পান ফুরালো এখন উপায় কী, আর ক'টা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি। ধনিয়া পিঁয়াজ গেছে পচে সরিষা ক্ষেতে জল, খরা বন্যায় শেষ করিলো বর্ষের ফসল। ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি সকল হলো খালি, ছিন্ন বসন জড়িয়ে গায়ে দিয়া শতেক তালি। কিবা মোদের নতুন বছর কিবা পুরাতন, চাষার একবেলা ভাত জোটে যদি ওবেলায় অনশন।।

আমাদের নববর্ষের সাথে সাথে পালিত এই যে "হালখাতা" উৎসব তাকে বর্তমানে একটি আপাত নিরীহ নতুন বস্ত্র পরিধান করে মিষ্টিমুখ করে বেড়ানোর উৎসব মনে হলেও এর উৎস কিন্তু সেই হালহকিকত ফয়সালা করার জন্য খাতা হাতে জমিদারের পেয়াদার কর আদায়জনিত অত্যাচারের ঘটনা নিয়েই।

ছেলেভুলানো ছড়ার গায়ে গায়ে জমে আছে সেই নয়া সালের কালশিটে রক্তদাগ:-

ইকির মিকির চামচিকির চামে কাটা মজুমদার, ধেয়ে এল দামোদর। দামোদরের হাঁড়িকুড়ি, দুয়োরে বসে চাল কাড়ি, চাল কাড়তে হলো বেলা, ভাত খাবি আয় দুপুরবেলা । ভাতে পড়ল মাছি, কোদাল দিয়ে চাঁছি, কোদাল হলো ভোঁতা, খা কামারের মাথা।

ছড়াটির ছত্রে ছত্রে চিত্রিত গ্রাম বাংলার সাধারন মানুষের জীবন যাত্রার চিত্র। বাদশাহ বা রাজা কয়েকটি গ্রামের খাজনা আদায়ের জন্য এর শ্রেণীর তহশিলদার নিযুক্ত করতেন এদের বলা হত "মুজলিমদার"।মজুমদার কথাটি এরই অপভ্রংশ।

"ইকির মিকির চাম চিকির " কথাটি সম্ভবত সেই অত্যাচারী শাসক শ্রেণীভুক্ত কর আদায়কারীর চিত্র তুলে ধরেছে। যারা দাঁত কিড়মিড় করে পিঠের ছালচামড়া তুলে নেবার হুমকি দিচ্ছে নিরীহ কৃষককে। চামে কাটা মজুমদার অর্থে ছাল চামড়া ছাড়িয়ে প্রবল অত্যাচারকারী কে বোঝানো হয়েছে। একদিকে কর আদায়ের জন্য অত্যাচার অন্যদিকে অকালে দামোদরের প্রবল বন্যা।উল্লেখ্য সে সময় কোন বাঁধ ব্যারেজ স্বভাবতই নির্মিত হয়নি, সুতরাং নিরুপায় চাষা অনিবার্য কারনেই এই হড়কা বানে গৃহহীন ও সর্বহারা। বন্যায় ঘরের বাসনপত্র সব ভেসে গেছে।তাই দামোদরের পলিমাটি দিয়ে তৈরী মাটির বাসনই সম্বল।আর ঠাঁই পরের দুয়োরের পরিত্যক্ত জমি। উদর পূর্তির জন্য জুটেছে আকাড়া দুমুঠো চাল। তাই বেছে কাড়া করে রন্ধনের আয়োজন। কথায় বলে না ভিক্ষের চাল আবার কাড়া না আকাড়া। সেই চাল ফুটিয়ে চলে বাঁচার লড়াই।এদিকে ঘরের মানুষটাকে খাজনা না দিতে পারার জন্য পাইকবরকন্দাজ হাঁকিয়ে বেঁধে নিয়ে গেছে মজুমদারের বাহিনী। তাই অপেক্ষায় বসে বসে ভাতে মাছি বসছে। এরপরে আবার শুরু হচ্ছে অনাবাদী পোড়ো জমি কোদাল দিয়ে পরিস্কার করে পুনর্বাসনের তোড়জোড়। সেই অমানুষিক শ্রমে মজবুত কোদাল ও ভোঁতা হয়ে যাবার জোগাড়। বিরক্ত চাষার মুরোদ নেই রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার তাই সে গাল পাড়ে কামারের প্রতি।বড়ই বেদনাদীর্ণ বিবশ করুণগাথা।।

তারপর যদি কিছু বাঁচে তবে চাষা খাবে নইলে মহাজনের কাছে ছুটবে পেটের দায়ে ধারকর্জ করতে। আর সেই ধারের চক্রবৃদ্ধি সুদের চোরাবালিতে সবংশে তলিয়ে যাবে তার ইহকাল পরকাল।

সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের দেশে এই নববর্ষ ব্যাপারটা গরীবগুর্বো চাষাবাদ করা মানুষের কাছে চিরকালই আনন্দের চেয়ে উদ্বেগেরই বেশি।

তাই ভাওয়াইয়া গানের পংক্তিতেও পাওয়া যায় একই ব্যথার সুর :-

নাঙল বেচায়, জোয়াল বেচায় আরও বেচায় ফাল, খাজনার তাপেতে বেচায় বুকের ছাওয়াল।

যুগ বদলেছে কিন্তু আজও চাষির ভাগ্য কিছুমাত্র বদলেছে কি? রাজতন্ত্র শেষ হয়ে আমলাতন্ত্র এসেছে, খাতায় কলমে গণতন্ত্র শব্দটি লেখা থাকলেও সে এক মরিচীকা, তাই ঋণের ভারে হতাশ চাষির আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলেছে আজও।

তবুও প্রবাদে বলে, আশায় বাঁচে চাষা। কৃষিপ্রধান দেশের সব উৎসব আনন্দ তাই সেই কৃষিকে ভিত্তি করেই। পুরাতনী ছড়াতে তারই চিত্র:-

চৈত্রী মাসে চড়কপূজা গাজনে বাঁধা ভারা, বোশেখ মাসে তুলসীগাছে দেয় বসুঝারা। জৈষ্ঠ্যমাসে ষষ্ঠীবাটা জামাই আসে বাড়ি, আষাঢ় মাসে রথযাত্রা লোকের হুড়োহুড়ি, শ্রাবণ মাসে ঝুলনযাত্রা পেসাদে ঘি আর মুড়ি ভাদ্র মাসে পান্তাভাত খান মনসা বুড়ি। আশ্বিনে অম্বিকা পূজা বলি পড়ে পাঁঠা, কার্তিকে কালিকা পূজা ভাইদ্বিতীয়ার ফোঁটা, অঘ্রানেতে নবান্ন হবে নতুন ধান্য কেটে, পৌষ মাসে পিঠেপার্বণ ঘরে ঘরে পিঠে। মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী ছেলের হাতে খড়ি, ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা ফাগের ছড়াছড়ি। বসন্তে কলেরা, গুটি ছড়ায় ঘরে ঘরে, আরোগ্যে হত্যে দাও হে নীল শেতলার ঘরে।।

তবুও সব রোগ, সব শোক, জীর্ণতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলতে চায় জীবন। হয়তো এই এগিয়ে চলার মন্ত্রের জোরেই পুরনো হলুদ পাতারা ঝরে পড়ে, পত্রমুকুলে উঁকি দেয় নব প্রেরণা, তার নামই কি "১লা বৈশাখ "? বিশাখা নক্ষত্র দূর থেকে দেখে সেই মৃত্যু পেরিয়ে আবার জীবনের জয়যাত্রা।।

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register