Mon 22 September 2025
Cluster Coding Blog

T3 || বাণী অর্চনা || 26য় দিলীপ কুমার ঘোষ

maro news
T3 || বাণী অর্চনা || 26য় দিলীপ কুমার ঘোষ

সেই সব সরস্বতী পুজো

ক্লাস নাইন। স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব আমাদের কাঁধে। সেই সময়ে প্রায় প্রত্যেকেরই নাইনে ওঠার এই একটা অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল। ক্লাস সেভেন থেকেই শুরু হয়ে যেত মানসিক প্রস্তুতি। দাদা-দিদিদের মুখের গল্প এবং চোখ-কান খোলা কিছু বিচ্ছুর 'আঁখো-দেখা-হাল' আমাদের তাড়িত করত নাইনে উঠে সরস্বতী পুজোর দায়িত্বভার গ্রহণের। বাইরে থেকে দেখলে ছিল দায়িত্বভার, কিন্তু আসলে স্কুলের সরস্বতী পুজো ছিল আমাদের কাছে বড় হওয়ার একটা অন্যতম প্রধান ধাপ। আমাদের কাছে নাইনে ওঠার আরও একটা তাৎপর্য ছিল। ক্লাস ফোরের পর ক্লাস এইট পর্যন্ত সহপাঠিনীশূন্য আমাদের জীবনে আবার আবির্ভাব ঘটত সহপাঠিনীদের। অবশ্য প্রাইমারির ফ্রক বদলে যেত লালপাড় শাড়িতে। সেই চতুর্দশী-পঞ্চদশী-ষোড়শীদের সঙ্গে পরিচয়ের শুরুতেই এসে পড়ত সরস্বতী পুজো। অনেকের জীবনে তাই আর 'গান গেয়ে পরিচয়' হত না, সরস্বতী পুজোয় পরিচয় হত। সরস্বতীর পুজোর মিটিংয়ে প্রথম ক্লাস নাইনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হত। স্যারেরা যখন এক-এক করে সমস্ত দায়িত্ব নাইনের হাতে তুলে দিত, তখনই সেই দায়িত্বভার সামলানোর জন্য তৈরি হয়ে যেত স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্ব। তারপর ঠাকুর বায়না দেওয়া থেকে আরম্ভ করে প্যান্ডেল কেমন হবে, কবে খাওয়ানো হবে, কী খাওয়ানো হবে, কে কী দায়িত্ব পালন করবে সব ঠিক করে ফেলত ক্লাস নাইন। সরস্বতী পুজোর আগের দিনের রাত ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। রাতদুপুরে স্কুলের পাশের আশ্রমের জমিতে লাগানো নারকেল গাছ থেকে পুজোর ডাব পাড়া বদলে যেত ডাবের বেশ কিছু কাঁদি নামানোয়। পুজো প্যান্ডেলের ফাইনাল টাচ সবসময় ফেলে রাখা হত পুজোর আগের রাতের জন্য। যার যত কেরামতি আছে সব বেরিয়ে আসত রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে। রাত জাগা সবাই তখন বিশ্বকর্মার সাক্ষাৎ বরপুত্র। ময়দা ফুটিয়ে তৈরি আঠা দিয়ে রঙিন কাগজ জুড়ে লম্বা শিকলি করতে বসে যেত কয়েকজন। আবার বেশ কিছুজন কাতাদড়িতে আমপাতা লাগিয়ে মন্ডপে ঝোলানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। তারপর মধুদা-বাসুদা বা রাতে আমাদের সঙ্গে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত স্যারের শুধু একটু আড়াল হওয়ার অপেক্ষা! ছেলেদের হাতে উঠে আসত সুখটানের লম্বা-সাদা নিষিদ্ধ বস্তু। জীবনের প্রথম ধূমপানের জন্য এর থেকে বড় অবসর তখন আর আমাদের জীবনে ছিল না। কোনও কোনও বছর বেশ কিছু কিশোরীও তাদের জীবনের প্রথম এবং হয়তো বা শেষ ধূমপানের আস্বাদনে পিছপা হত না। কতিপয় বৎসর পূর্বে দেবী সরস্বতীর পাদপদ্মে হাতেখড়ি দেওয়া আমরা আয়তলোচনা সরস্বতীর সামনেই মুখেখড়ি দেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারতাম না, চাইতামও না হয়তো! আমাদের দেখভাল এবং সহযোগিতার জন্য নিয়োজিত স্যার অথবা অন্যান্যরা সহপাঠিনীদের নিয়ে রাতে বিদ্যালয় ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় আমাদের হাতে চাবি তুলে দিয়ে যেত। আর তারপর আমরা হয়ে উঠতাম স্বাধীনতার আর এক নাম। মুক্তপ্রাণের হুল্লোড়ে মেতে উঠে আমরা প্রথমে যে কী করব ভেবে উঠতে পারতাম না। কেউ গলা ছেড়ে হেঁড়ে গলায় গান ধরতাম, কেউ নতুন শেখা শব্দের যথেচ্ছ প্রয়োগ করতাম, কেউ কেউ ধরাধরি বা লুকোচুরি খেলতে আরম্ভ করে দিতাম। সরস্বতী পুজোর দু'দিন আগে থেকেই শরীরটা একটু একটু খারাপ করতে শুরু করেছিল। পুজোর আগের দিন স্কুলে গিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেঞ্চ বের করা অথবা মাঠ পরিষ্কারের কাজে সেভাবে হাত লাগাতে পারলাম না। গা-হাতপা ম্যাজম্যাজ করছিল। বাড়ি ফিরতেই সেই যে জ্বরে পড়লাম, জ্বর ছাড়ল দু'দিন পর। ঠাকুর বিসর্জনের দিনও স্কুলে যেতে পারিনি। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের কীর্তিকলাপ শুনে মন এত খারাপ হয়ে গেল যে মনে হল দু'দিন পর খাওয়ানোর দিনও আর স্কুলে যাব না! সহপাঠী-সহপাঠিনী নির্বিশেষে সুখটানের যে মৌতাত তৈরি করেছিল, তার অন্যতম কুশীলব হতে না পারার অভিমানেই হয়তো আমি পরবর্তী আরও বছরপাঁচেক সুখটান থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলাম।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register