Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় অভিজিৎ চৌধুরী

maro news
।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় অভিজিৎ চৌধুরী

শ্যামল কংসবণিক

প্যাংগং লেক থেকে সুচরিতা একটা নীল পোস্টকার্ড পাঠিয়ে ভিডিও কল করেছে । সন্দীপ ধরতে পারল না , ব্যাংকে বেশ ভীড় । কয়েকদিন লক ডাউনের পর ব্যাংক খুললে ভীড় উপচে পড়ছে । দত্ত-দা বলল , ব্রাদার , তোমাকে কিন্তু ইয়াং অফিসার-ই মনে হয় । কে বলবে – এক বছর পর তুমি অবসর নেবে । সুযোগ বুঝে সন্দীপ দত্ত-দা কে প্যাংগং লেকের ছবিটা দেখাল আর মৃদু স্বরে বলল – সুচরিতা । দত্ত-দা খুব দ্রুত কাজ করতে পারেন , আর খুব রসিক মানুষ । একটাই দুর্বলতা বা সবলতা ঘুমোনোর আগে ২ পেগ ভ্যাট সিক্সটি নাইন । দত্ত-দা বলল – ব্রাদার , কি রোমান্টিক সব ব্যাপার তোমার । কাজ করতে করতে সামান্য হাসল সন্দীপ । স্বপ্না ইদানিং কবিতা লিখছে । সে লস অ্যাঞ্জেলস থেকে পাঠায় মাঝে মাঝে । কয়েকদিন ছুটি পেয়েছে । সন্দীপ আজ রাতে ব্যাংকের গাড়িতে বাড়ি যাবে । নবগ্রাম , রেলওয়ে স্টেশনের নাম কোন্নগর । দীপংকর মুম্বাই থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নবগ্রামে ফিরে এসেছে । মনটা খারাপ-ই বলা যায় । জুহু বিচের চেয়েও বারবার ফিরে আসছে ওদের নাট্যগোষ্ঠীর কথা । রূপম-দা, রিহার্সাল আর প্রতিটি শোয়ের পর স্ট্যান্ডিং ওভেসন পাওয়া । নবগ্রামের রাস্তায় দু-চাকার একটা সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে । গলি ভুল হচ্ছে । বদল তো কিছু হয়েছে-ই । অবশ্য সেই মতিচ্ছন্ন চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব নেই , সবটাই হ্যালোজেন । কল্পনাগুলি আর নেই , অনেকটাই ঝকঝকে বাস্তব । একটা ঠিকানা তার বুকের মধ্যে রয়েছে – শ্যামল কংসবণিক । ওর স্টুডিও বলেছিল ধর্মডাঙায় । টুক করে সবটা মনে পড়ল দীপংকরের । কলেজের পিছন দিকটায় এসে সেই পুরোনো রেললাইনের গলি ধরল । কালভার্ট এখনও নীচু । দীঘল চেহেরার দীপংকর মাথাটা যতোদূর সম্ভব নামিয়ে যখন কালভার্ট পার করল – বেশ হাঁফ ধরল অনভ্যাসের দরুণ । একটি কিশোর ছেলেকে সামনে পেলো দীপংকর । সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল – ভাই , শ্যামল কংসবণিকের স্টুডিও-টা দেখাতে পারো ! ছেলেটি বলল – উনি আমার বাবা । চলুন নিয়ে যাচ্ছি । মুম্বাইয়ের প্রবাসী বাঙালিদের পুজোয় শ্যামল কংসবণিকের দুর্গা প্রতিমা নিয়েছিল দীপংকর । পরে সন্দীপের কাছ থেকে শুনেছে – সুচরিতা , রিংকু – ওরাও নিউ জার্সি , লস অ্যাঞ্জেলসে শ্যামলের প্রতিমা নিয়ে গেছে । ছেলেটি একটি এক তলা বাড়িতে এলে ডাক দিলো – বাবা , তোমার বন্ধু এসেছেন । ক্ষীণ কণ্ঠে একটা আওয়াজ ভেসে এলো - স্টুডিও-তে নিয়ে আয় । শ্যামল কংসবণিককে মুখোমুখি দেখেনি বহু বহু বছর । কালো , রোগা চেহেরার একটা ছেলে স্কুলে সরস্বতী প্রতিমা নির্মাণ করেছিল । একেবারে অন্য রকমের প্রতিমা । তখনও অতো বছর আগে আর্টের ঠাকুরের চল হয়নি । স্টুডিও-তে ঢুকলো দীপংকর । সারি সারি দুর্গামূর্তি । শ্যামল লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে রয়েছে । মোটা হয়েছে অর্থাৎ শরীরে মেদ এসেছে । চশমাটা নাকের ওপর থেকে খানিকটা নামিয়ে শ্যামল বলল – আপনি কে ! দীপংকর – তোর ছেলেবেলার বন্ধু । মুখ দেখে বোঝা গেলে শ্যামল মনে করতে পারছে না । দীপংকর খানিকটা কাছাকাছি সময়ের চলভাষ দিয়ে সাহায্য করল । মুম্বাই-তে প্রতিমা নিয়েছিলাম তোর । প্রবাসী ক্লাবে । আরে ! এবার চিনতে পেরে লজ্জিত হল শিল্পী শ্যামল কংসবণিক । ‘চা’ । দু-বার হাঁক দিলো শ্যামল । ভিতর থেকে জবাব এলো ‘দিচ্ছি’ । তখনই সন্দীপ আরেক বন্ধু শংকরকে নিয়ে ঢুকল । সন্দীপ চীৎকার করে বলল – ম্যাডাম , ৪ টে হবে । লিকার , চিনি ছাড়া। দীপংকরের দারুণ লাগলো একসঙ্গে পুরোনো বন্ধুদের দেখে । সন্দীপ , আমাদের সবার কি মধুমেহ ! না হোক । অতিরিক্ত শর্করা তো কাজের জিনিস নয় । সন্দীপ এবার শংকর দত্তের দিকে তাকিয়ে বলল – বৈশাখী ফোন করেছিল ! শংকরের সামনের দিকের মাথার চুলটা খানিকটা নেই কিন্তু চমৎকার হাসিটা এখনও লেগে রয়েছে । সন্দীপ আবার বলল – বৈশাখী , ফোন করেছিল । শংকর বলল – শালা , আমার কি ! সন্দীপ হেসে বলল – তুই কি যেন কি বলতিস ! গাইতিস , সরি ! দীপংকর বলল – কেসটা কি বলতো ! শংকর-ই বলল – দীপক স্যারের কোচিনে মেয়েদের ব্যাচে বৈশাখী আসত । সন্দীপ বাকিটা বলল – আর তখনই শংকর গাইত – এক বৈশাখে দেখা হলো দু-জনার । এবার ‘চা’ চলে এলো । লিকার ‘চা’ সঙ্গে সিঙ্গারা । সামান্য একটু মাটির প্রলেপ প্রতিমায় লাগিয়ে হাত ধুয়ে নিলো । সকলের হাতে স্যানিটাইজার দিলো । এবার শংকর বলল – কোভিডে তোর প্রতিমার বাজার কেমন ! শ্যামল বলল – ভালো না । দীপংকর বলল হঠাৎ - আমরা ৩ জন তোকে অর্ডার করলাম । মুম্বাই , বীরভূম , নবগ্রাম । শংকর বলল – রাইট । আমার বাড়ির প্রতিমা তুই-ই তো দিস । শ্যামল হেসে ঘাড় কাঁত করল । তারপর বলল – মুম্বাই-তে পুজো হবে ! দীপংকর ঠিক জানে না আর পুজো হবে কিনা ! তবু সে মিথ্যে করেই বলল – হবে । পকেট থেকে ৫০০০ টাকা বের করে বলল – অ্যাডভান্স । সন্দীপও ২০০০ টাকা দিলো । বাড়ির পুজোতো আছেই । শ্যামলের প্রতিমা হোক তবে এবার । সিঙারা , চা খেয়ে সন্দীপ বলল – এক জায়গায় যেতে হবে আমায় ! শংকর আর দীপংকর বলল – কোথায় ! শর্মিলার শরীরটা একদম ভালো নেই । আমরাও যাব । ওরা চলে যেতে শ্যামল কাজে ডুব দিলো । ভাদ্র মাসের আকাশে গুমোট সংকেত । হাওয়া নেই একটুও । প্রকৃতির কোন দাক্ষিণ্য নেই এবার । এক মরণ ভাইরাস মৃৎ শিল্পকে ধ্বংস করে দিচ্ছে । বন্ধুদের দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে কাজে শ্যামল কংসবণিক । ভাদ্র এক সময় শেষ হল । আশ্বিন এলো । ঢাকের বাদ্যি মৃদু হলেও শোনা যাচ্ছে । দীপংকর , সন্দীপ , শংকর । প্রতিমার মুখে আশ্চর্যভাবে তাদের সেই হারানো বান্ধবীদের ছাপ । কোথাও লাস্য , কোথাও সুখ , কোথাও বা অন্তর্লীন বেদনা ।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register