Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় আবীর ভট্টাচার্য্য

maro news
।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় আবীর ভট্টাচার্য্য

সৌদামিনী, এক অন্য জীবন-কথা

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে।আসন্ন গোধুলীর আরক্ত আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছেন এক সৌম্য দর্শনা বৃদ্ধা। মোটাসোটা ফর্সামুখে একখানা বড় সিঁদুর টিপ, অস্তগামী সুর্যের লালিমা যেন সুন্দর মুখখানিকে আরও গৌরবোজ্জ্বল করে তুলছে, সামনের ছাদ-বাগানে এক নির্মেদ বৃদ্ধ আদরের গাছগাছালির পরিচর্যায় ব্যস্ত।এনারা এবাড়ির দাদু-ঠাম্মা,সন্ধ্যায় এক জরুরী আলোচনাসভায় ডেকেছেন বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের, উপলক্ষ্য নাতির বিবাহ।বেশ কয়েকদিন ধরেই এই ব্যপারে বাড়িতে বেশ একখানা গোলমাল বেঁধেছে,নাতি অরিন্দম পছন্দ করেছে তার সহপাঠিনী শর্মিলাকে, দুজনেই ভালো ছাত্র-ছাত্রী, একসাথে বিদেশে পড়তে যেতে চায়...।এপর্যন্ত্য সব ঠিকই ছিলো, হঠাৎ দুই মায়ের মনে হোল,যাবেই যখন, বিয়েটা সেরেই যাক।প্রথমে দুই বাড়ির ছেলেরাই ব্যপারটায় হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো, এই যুগে এত তাড়াতাড়ি কেউ বিয়ে করে নাকি? কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেল,পত্নীঅন্তপ্রাণ ছাপোষা মধ্যবয়সী কর্তাদুটি নিজেদের বৌয়ের কথা মানতে বাধ্য হয়েছেন। এবং বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও তাতে সোৎসাহে যোগ দিয়েছে,ছেলেমেয়ে দুটিরও তেমন আপত্তি নেই।এ পর্যন্ত্যও ঠিক ছিলো, অন্ততঃ সৌদামিনী-অনন্তবাবুর তো বেশ পছন্দসই হয়েছিল ঘটনাক্রম, কয়জনের আর ভাগ্যে নাতির বিবাহ দেখার সখ মেটে একালে! কিন্তু গন্ডগোলের শুরু এরপরেই। আধুনিক শিক্ষিতা বৌমা চেয়ে বসলেন শর্মিলার ঠিকুজি অর্থাৎ জন্মছক, সৌদামিনী অবাক হয়ে দেখলেন,ওপক্ষের মায়েরও এ ব্যপারে সমর্থন আছে।অতএব আনা হলো জন্মছক, দুই ভাবী বেয়ান মিলে একসঙ্গে জ্যোতিষীর কাছে গেল পাত্র-পাত্রীর যোটক-বিচারে। তিনি আজন্মকাল এসব বিশ্বাস করেন না,নিজে খুব বড়ো আচার্য্যবাড়ির কন্যা হয়েও। তবে অন্য কারো ব্যক্তিগত ধর্মাচরণে কখনও বাধাও দেন না, এবারেও মনের সমর্থন না থাকলেও বাধা দিলেন না। যাহোক,জ্যোতিষীর কাছ থেকে ফিরে এলো বৌমা একমুখ অন্ধকার নিয়ে, বারবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পেলেন না,রাতে খাওয়া দাওয়া বন্ধ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা বড়সড় গোলমাল হয়েছে.... পরদিন দুপুরবেলা ছেলে-নাতি অফিসে চলে গেলে ওনার কাছে এসে বললো সবকথা, ওদের নাকি ঠিকুজিতে একবারে মিল নেই,কন্যার স্বামীহন্তাদোষ, বিবাহ হলে নিশ্চিত বৈধব্যযোগ.....'এসব আবার কেউ আজকাল মানে নাকি?'-অনেক বোঝোবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মায়ের মন,ভবি ভোলার নয়। একমাত্র সন্তানকে এভাবে বিবাহ দেওয়া যাবে না। এদিকে অন্যবাড়িতেও একই অবস্থা..... তাদেরও একমাত্র কন্যা,তারাও চায়না এ বিয়ে হোক। কিন্তু ছেলেমেয়েদুটি যে পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসে,তা তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি.... রাতের পরে রাত বিনিদ্র কেটে যাচ্ছে অরুর,শরীর ভেঙে পড়ছে, এমনিতেই তো অসুস্থ হয়ে পড়বে.....তাই আজ সন্ধ্যায় তিনি নিমন্ত্রণ করেছেন শর্মি ও তার বাবা-মাকে, থাকতে বলেছেন নিজের ছেলে-বৌমাকেও,বলতে চান কোন গভীর কথা।প্রথমে ওনারা আসতে চাননি, কিন্তু সঠিক সময়ে মায়ের অধিকার ফলাতে এখনও যে তিনি বেশ দড়ো,তার প্রমান রাখলেন আবার। যাহোক,সন্ধ্যায় সবাই এলো তাঁর ঘরে, কিন্তু সবাই যেন বড়ো প্রাণহীন, মনমরা....সবার মুখের দিকে একবার তাকালেন সৌদামিনী,আজ তাঁকে বলতে হবে এক গভীর গোপন জীবনকথা....নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলেন মনে মনে; শুরু করলেন কথা...'সে অনেক কাল আগের গল্প। একটি ছোট্ট মেয়ের। মাঙ্গলিক সেই মেয়েটির ছিলো স্বামীহন্তাযোগ',একটু থামলেন,সময় দিলেন স্রোতাদের,অস্ফুট নারীকন্ঠের ফোঁপানি শুনলেন যেন,আবার শুরু করলেন,'তো জন্মরাতেই কন্যার পিতা নিজহস্তে জন্মচক্র বিচার করেছেন, উপায়ও ভেবে রেখেছিলেন;কাউকে জানাননি,এমনকি কন্যার মাকেও না। যথাবিহিত সময়ে পাল্টিঘরে সম্বন্ধ ঠিক করেছিলেন,একটিই শর্ত ছিলো ঠাকুর মশায়ের, বিবাহ হবে শেষ রাত্রে, একেবারে অন্তিম লগ্নে।পন্ডিতমানুষটির কথা ভাবী শ্বশুরবাড়ির কেউ অমান্য করেনি।তবে শুধুমাত্র বিবাহের আগের সন্ধ্যারাতে পিতা তার কন্যাকে নিয়ে গিয়েছিলেন পারিবারিক ঠাকুরের গর্ভগৃহে,একখন্ড বেলডালের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন নিজে হাতে,কার্য সমাপনান্তে নির্দেশ দিয়েছিলেন বেলডালটি ভেঙে পা দিয়ে মুছড়ে ফেলতে.... ছোট্ট মেয়ে না বুঝেই পিতার নির্দেশ পালন করেছিলো,সবটা এখন আর মনেও পড়েনা,তবে এটুকু মনে পড়ে, বেরিয়ে আসার সময় পিতা পইপই করে বারন করেছিলেন, একথা কাউকে না বলতে,মা বা নিজের স্বামীকেও না, মেয়েটি বলেওনি.....তারপরে যথাবিহিত বিবাহ হয়, দীর্ঘ পঞ্চাশবছরের সুখী দাম্পত্যজীবনে সে কথা মনেও ছিলোনা.... কিন্তু আজ আবার এক ক্রান্তিলগ্নে.....'চুপ করলেন সৌদামিনী,বাড়ির সবাই নিশ্চুপ, পরস্পরের নিঃশ্বাস শোনা যায় ঘরে এমন স্তব্ধতা....কারো বুঝতে বাকি নেই গল্পটি কার......ধীরে ধীরে সবাই ঘর ছেড়ে চলে গেল,নীচ থেকে ওদের খাওয়া-দাওয়া আর কথাবার্তার শব্দ আসছে,হয়তো বরফ গললো,এটাই চেয়েছিলেন তিনি।বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে মেয়েটার জড়িয়ে ধরা তাঁকে খুব তৃপ্তি দিলো,হয়তো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো, মনে মনে একবার স্বর্গত পিতৃদেবকে প্রণাম জানালেন, মানুষের শুভ চিন্তা যে অদৃষ্টের চাইতে অনেক বড়ো,তাই সারা জীবন শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন তিনি...তবে সবচাইতে বড়ো চমক অপেক্ষা করছিলো রাতে,যখন চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া রাতে বাগানের একগুচ্ছ গোলাপ এনে বুড়োবর তাঁর বললেন,'ছি ছি! সারাটা জীবন পরস্ত্রীর সাথে পরকীয়া করেই কাটলো গো!.....'লজ্জানত মুখখানিতে এই বৃদ্ধবয়সেও তিনি তখন যেন শারদ-কমলিনী,নির্ভার সৌদামিনী..... জীবনের দামী সম্পদ তো ভালবাসাই.......
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register