Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২২৪)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ২২৪)

পর্ব - ২২৪

তার মা যেন তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ছোটমণি, ওঠ ওঠ, আমি এসেছি। ঘুমের অতল থেকে মেয়ে বলছে, বোসো মা।
কাজের সহায়িকা বাসন্তীবালাকে বলছেন, তোমার মেয়ে এমন ঘুমোচ্ছে, যেন কতদিন ঘুমোয় নি। খাবার দেবার আগেই টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি এসে দেখি কি তোমার মেয়ে ঘুমিয়ে একেবারে কাদা। আজকে কাতলা মাছের কালিয়া করেছিলাম। পারশে মাছের ঝাল করেছিলাম। কিন্তু খেলে তবে না? ঘুমিয়ে একেবারে ঢলে পড়ে যাচ্ছে।
বাসন্তীবালার লজ্জা করতে থাকে। মেয়ে সকালবেলা কলেজেই সবজিভাত খেত। তার জন‍্য এক দু পিস মাছ রাখা থাকলে রাতের বেলায় খাবারের টেবিলে অন্তু জেদ ধরত তাকে মাছ দিতেই হবে। না দিলে ভাঙচুর করবার ভয়ে তিনি তুলে দিতেন মেয়ের ভাগের মাছটাও। এতদিন পর তাঁর মনে হল পেটের ছেলেদের তিনি আসলে ভয় পান।
কাজের সহায়িকা বলল, লুচি ভাজা হচ্ছে। আলুরদম করেছি। খেয়ে তবে যাবে। বাসন্তীবালা বলছেন, না গো ঘরে ছিষ্টির কাজ পড়ে আছে। মেয়েটা ওইভাবে বেরিয়ে পড়ল। আমার বুক টুকবুক করছে। কিজানি কি হয়। বেশি রাত হয়ে গেছে। মেয়ে বাড়ি ফেরে নি। কথাটা না পারছি গিলতে, না পারছি ওগরাতে। ঠাকুরের কাছে কাঁদছি। ওগো, বাছাকে আমার ফিরিয়ে দাও।
লোক জানাজানি পাঁচকান হলে বদনাম হবে না? মেয়ের বিয়ে তা ধরো একরকম ঠিক হয়েই গেছে। তারা খুব বড়লোক। বলে বসলেই হল, তোমার মেয়ে কোথায় গেছে? জানো, এখানে আমার জা জেউড়ি কেউ নেই, তাই বাঁচোয়া। ন‌ইলে বলতে নেই জ্ঞাতির মতো শত্রু নেই। তিলকে তাল করে রটিয়ে দেবে। এমনিতে মেয়ে আমার দেখতে সুন্দর।
কাজের সহায়িকা বলল, সুন্দর বলে সুন্দর? ডানাকাটা বললেই হয় ভাল। দেখলে তাঁহা তাঁহা পুরুষের মাথা ঘুরে যাবে।
বাসন্তীর অবাক লাগে। মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প হচ্ছে?
তিনি বললেন, ভগবান আমার বাছাকে বাঁচিয়ে রাখুন। কিন্তু আমার বড়মণির চেহারা ছবি আরো পরিষ্কার। ছোটোটার থেকে সে অনেক বেশি ফরসা। চুল তার খুলে দিলে পায়ের কাছে লুটোপুটি করে। যে দেখে সেই বৌ করে নিয়ে যেতে চায়।
সহায়িকা বলল, মানুষের আসল হল বুদ্ধি। তোমার ছোটোমেয়ের বুদ্ধি খুব। আমার দিদিমণি এই তল্লাটের ডাকসাইটে উকিল। পুরুষরা পর্যন্ত সমঝে হিসাব করে কথা বলে। কিন্তু তোমার মেয়ে যখন কথা বলে, দিদিমণি অবাক হয়ে শোনে। আরেকটা লোক আজ সকালে এসেছিল, অরি না কি যে নাম। লোকটা খুব বড়লোক, দেখলেই বোঝা যায়, সে লোকটা বলে কি... খি খি খি... সহায়িকা হাসে।
বাসন্তীবালার বুক ধুকপুক করে। অরিন্দমটাও এর মধ‍্যেই এখানে এসে জুটেছে! আচ্ছা বেহায়া লোক তো! মুখে তিনি বললেন, কি বলছিলেন ভদ্রলোক? বাসন্তীবালা জানতে দিতে চান না যে তিনি অরিন্দমকে ভাল মতোই চেনেন।
সহায়িকা হেসে বলল, অতো বড়ো পুরুষ মানুষটা বলল কি সে তোমার মেয়ের কাছে অনেক কিছু শিখেছে। আমি শুনে হাসবো না কাঁদব ভেবে পাই না। তোমার মেয়ে বড়োই হয়েছে। এখনও ছেলেমানুষি ভরতি।
বাসন্তীবালা বিরক্ত হলেন। শুনেছ বাছা, আদরে মানুষ করেছি, মেয়ে আমার পড়াশুনায় খুব ভাল। ওইজন‍্য সাংসারিক ঘোরপ‍্যাঁচে ঢুকতে চায় না। ও মেয়ে সরল, তবে বোকাহাবা নয়।
সহায়িকা বলল, বোকাহাবা নয় বলছ? আজ কি করেছে জান?
বাসন্তীবালার বুক ধড়াস ধড়াস করছে। কি করেছে?
সহায়িকা হেসে বলল, পরে বেরোনোর মতো কাপড়চোপড় না নিয়েই কলঘরে ঢুকেছেন। সাবান মাখছেন আর গান গাইছেন।
বাসন্তীবালা বললেন, তা আমাদের ছোটমণি একটু গানটান গায়। মাস্টার রেখে শিখিয়েছি কিনা। তবে  মাধ্যমিক পাশ করার পর সব উটে গেল। দ‍্যাখো, আমি বলি কি, চার চারটে ভাইবোন। ছেলেদুটো, তা হক কথা বলতে কষ্ট নেই,  ওরা বেশ একটু মাথামোটাই বলতে হবে। ওদের জন‍্য সব সাবজেক্টে মাস্টার দাও। বড়মণির‌ও কোচিংয়ে যাওয়া। অঙ্ক আর ইংরেজির বাড়তি স‍্যার। এই ছোটটাই কখনো কোনো মাস্টারের কাছে পড়ে নি। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। দিদির মাধ্যমিকের অঙ্ক মুখে মুখেই বলে দেয়। বড়মণির মাস্টার হাসত। ওরে তোর বোন যে  আমাদের ভাত মারবে রে!
সহায়িকা বলল, তাই তো বলছি, তোমার ছোটোমেয়ে পড়াশুনা অত বেশি করতে করতে প্র‍্যাকটিক‍্যাল জিনিসটা কম ভাবে। আজ দ‍্যাখো না, কলঘরে শুকনো কাপড়চোপড় নিয়ে যায় নি। আবার ওই অরি লোকটা বসে আছে। বেরোয় কি করে!
শুনে বাসন্তীবালার খারাপ লাগে। সাফাই গাইতে তিনি বলেন, আসলে কি জানো তো, ছোটো থেকে ঘরের লাগোয়া নিজস্ব বাথরুম পেয়েছে। ঘরের দরজা ছিটকিনি লাগালে পুরো নিজস্ব জগৎ। ওইজন‍্য তোয়ালে জড়িয়ে কলঘর থেকে বেরোনোর অভ‍্যেস। কিন্তু সব বাড়ি তো সমান নয়। অনেক বাড়িতেই পয়সা আছে। কিন্তু দেখবে বাথরুমের দরজা ভাঙা। কিংবা উ‌ইয়ে খেয়ে দিয়েছে। টিনের দরজা হলে, জং ধরে গেছে। আমাদের দেশে ঘরে গা খুলে চান করার মজা কি জিনিস অনেক মেয়ে জানেই না। আর বাথরুমে অ্যাসিড বা ফিনাইল দিয়ে রোজ সাফ সুতরো করার কথা ভাবেই না কত লোক।
 নিচের বাগানে শশাঙ্ক পাল গল্প জমিয়েছেন মালির সাথে। মালি লোকটা বদ্ধ কালা। বহু পুরোনো লোক। অনসূয়ার বাবার আমল থেকে এবাড়িতে রয়ে গিয়েছে। বুড়ো বুড়ি থাকে। ছেলেটাকে দেশে মুদিখানা দোকান করে দিয়ে গিয়েছেন কর্তা। তা সে ছেলে বাপ মায়ের বিশেষ খবরাখবর নিয়ে উঠতে পারে না।
 অনেকক্ষণ ঠাহর করে মালি বুড়ো শশাঙ্ক পালকে চিনতে পারল। আর পেরে সে কি হাসি! কর্তা কলকাতায় কবে যাবেন খবর রাখতেন শশাঙ্ক।  কলকাতার বাজারে হরেক রকমের মোটর পার্টস পাওয়া যায়। কম্পিটিশনের বাজারে কলকাতা থেকে জিনিস কিনে আনতে পারলে একটু কমদামে কাজ সেরে খদ্দের ধরা যায়।  সেইসব দিন সকালে এসে হত‍্যে দিয়ে থাকতেন শশাঙ্ক। কর্তা গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করতেন শশাঙ্ক খেয়েছ?
শশাঙ্ক বলতেন, আজ্ঞে সকালে দুটি মুড়ি চিবিয়ে বেরিয়েছি। কর্তা হুকুম করতেন, দুটো সেদ্ধ ভাত খেয়ে নাও। মুসুর ডাল সিদ্ধ, ডিম সিদ্ধ, আলুসিদ্ধ একসাথে মেখে খাওয়ার মজাই আলাদা। তার উপর কর্তামা একদলা মাখন ফেলে দিতেন। এখনো চোখ বুজলে সেই ব্রাউন অ্যাণ্ড  পলসনের মাখনের গন্ধ নাকে আসে। এবাড়িকে শশাঙ্ক পরের বাড়ি ভাবতেই পারেন না। যদিও বুড়ো মালি ছাড়া সব বদলে গিয়েছে। যাঁরা হেঁটে চলে বেড়াতেন, তাঁরা সব দেয়ালের ছবি হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই পগমিলের দালান কোঠা, শ্বেতপাথরের টেবিল আর জানালায় জানালায় বার্মা টিকের খড়খড়ি পুরোনো দিনের স্মৃতি ধরে আছে।
এমন সময় অনসূয়া আদালত থেকে ফিরে শ‍্যামলীর মা বাবাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।

ক্রমশ...

Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register