Thu 18 September 2025
Cluster Coding Blog

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ১৭৩)

maro news
দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ১৭৩)

পর্ব - ১৭৩

কেন যে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না! বাড়ি ফেরার কথা ভাবলেই বাবার তেড়ে ওঠা মনে পড়ছে। বলেছেন, জুতোর বাড়ি মেরে মুখ ছিঁড়ে দেব। কেননা, শ‍্যামলী সবিতার নিজের মনোমত জীবনের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছিল। কেমন যেন মনে হচ্ছিল পালবাড়ি সবিতাকে শুধু নিংড়ে নিয়েছে এতদিন। বিনিময়ে কিচ্ছু দেয় নি। যে মেয়েটা নারীত্বের অভিষেক হবার আগেই বিধবা হয়েছে, তার অধিকার কী কী ছিল, সে সেদিন জানত না। আজ জেনে ফেলেছে। আজ সবিতাপিসি মনস্থির করে ফেলেছে, কোনো অজুহাতেই পালবাড়িতে পড়ে থেকে জীবনের বাকি কটাদিনকে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। বাবা ওকে বলেছেন, ফুটপাতের হোটেলের মালিক ওকে এক হাটে কিনে আরেক হাটে বেচে দেবে। মেয়েদের যে এমন পরিস্থিতি হয় না, তা তো নয়। বিস্তর মেয়ে প্রেমের টানে ঘর ছেড়ে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যায়। সবিতা পিসির কি তাই হবে? কিন্তু সবিতাপিসি যে অবস্থায় ছিল, তাতেই কি তার কোনো ভবিষ্যৎ ছিল? পালবাড়িতে সে কতটা সম্ভ্রমের সঙ্গে ছিল? শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত মনে পড়ে যায় শ‍্যামলীর। কি আশ্চর্য রকম কথাশিল্পী ছিলেন পাগল ঠাকুরটি। এদিকে পরনের কাপড়চোপড় পর্যন্ত মাঝে মাঝে সামলে উঠতে পারতেন না। বালকের ভাব। ওদিকে বলছেন, শিশুরা খেলনা নিয়ে ভুলে থাকে; কিন্তু যেই একবার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়, আর কোনো খেলনা, কোনো কিছুই তাকে ভুলিয়ে রাখতে পারে না। তখন মাকে তার চাইই চাই।
স্বামী বিবেকানন্দকে মনে পড়ে। বাংলা ভাষাকে নিয়ে বলছেন, ভাষা হবে সাফ ইস্পাতের মতো। একচোটে কেটে দেয়। সবিতাপিসিও একচোটে সম্পর্কের মায়া কেটে বেরিয়ে পড়তে পারল। পরে কি হবে না হবে, সেটা পরের ব‍্যাপার। কিন্তু যাকে একবার ভুল বলে বুঝতে পেরেছি, কোনো কারণেই সেখানে আর থাকব না।
আবার কথামৃতের ঠাকুরকে মনে পড়ে শ‍্যামলীর। এক গৃহবধূ সর্বক্ষণ স্বামীকে খোঁটা দেয়। বলে, দ‍্যাখো দিকি, অমুকের কেমন বৈরাগ‍্যভাব! একটু একটু করে জিনিস পত্র গুছোতে লেগেছে। গেরুয়া ছুপিয়েছে, কমণ্ডলু কিনেছে। আর তুমি? তখন একদিন স্বামী অতিষ্ঠ হয়ে ব‌উকে বলল, ওরে, বৈরাগ‍্যভাব ওকে বলে না। কাকে বলে জানিস? এই দ‍্যাখ্, এই কাপড় ছেড়ে রেখে গামছা পরলাম। আর এই চললাম। বলে, লোকটা গেল তো গেল, আর এল না।
 রামনারায়ণ মিশ্র কথামৃত কিনে এনেছেন। রোজ সকালে একটু করে পড়ছেন। ভাবতেই ভাল লাগছে শ‍্যামলীর। সে নিজে ব‍্যাগের ভিতরে করে মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড আর মার্কশিট সাথে করে নিয়ে বেরিয়েছে। এতদিন যে বাড়িকে নিজের নিশ্চিন্ত আশ্রয় বলে জানত, আজ আর সেখানে দরকারি কাগজপত্র রাখতে ভরসা পাচ্ছে না। অথচ কাগজগুলো বাঁচানো জরুরি। অনসূয়া চ‍্যাটার্জির বাড়িতে সে রাখবে। ওঁর ওখানে গিয়ে অনুরোধ করবে শ‍্যামলী। সে নিশ্চিত, তাকে তিনি নিরাশ করবেন না। কেন যে কাল রাতে অ আজার বালথাজার সিনেমার কথা স্বপ্নের ভিতর উঁকি দিয়ে গেল, ভাবার চেষ্টা করে সে। তলপেটে অত্যন্ত ব‍্যথা বোধ হচ্ছিল। কে যেন গুহ‍্যদ্বারে উত্তপ্ত লৌহশলাকা দিয়ে খুঁচিয়ে দিয়েছে। অথচ সত‍্যি সত্যি শারীরিক কোনো আঘাত নেই। মা ছিলেন পাশেই। আধোজাগর অবস্থায় ছিলেন। বাস্তবে কোনো দুর্ঘটনাই ঘটে নি। তাহলে বালথাজার সিনেমার কথা স্বপ্নে উঠে আসা আর তলপেটে তীব্র যাতনাবোধের  মধ‍্যে যোগসূত্র কি?
অ আজার বালথাজার। রবার্ট ব্রেসঁর ফিল্ম। কি অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন অ্যান উইয়াজেমস্কি। তখন কতটুকু বয়স তাঁর? অনেকটাই শ‍্যামলীর মতো। অ্যান জন্মেছিলেন ১৯৪৭ সালের মে মাসে। আর ফিল্মটা রিলিজ করেছিল ১৯৬৬ সালের মে মাসে। ফিল্মে মারি চরিত্রে অ্যান। জ‍্যাকস চরিত্রে ওয়ালটার গ্রীন। গেরার্ড চরিত্রে ফ্রানকয়েস লাফার্জ। ছোটবেলায় জ‍্যাকস আর তার বোনেরা গাধাটাকে পুষ‍্যি নিয়েছিল। জ‍্যাকসের শৈশবের অন্তরঙ্গ সঙ্গিনী ছিল মারি। জ‍্যাকসরা ফার্ম ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। গেরার্ড, কুসঙ্গে বড়ো হয়ে উঠতে থাকা তরুণটি একদিন মারিকে তার‌ই গাড়ির ভিতরে যৌনসঙ্গম করল। প্রীতিমূলক সঙ্গম তা নয়। কিন্তু তাও কেন মারি গেরার্ডকে বারবার শরীর দিল? শৈশবের সাথী জ‍্যাকসকে আর কাছে পেতে চায় নি মারি। ধ্বস্ত হতে বারবার গিয়ে পড়েছে গেরার্ডের খপ্পরে। তারপর শ‍্যামলী তলপেটে ব‍্যথা অনুভব করে আবার। অথচ আপাতভাবে কোনো কারণ নেই। মারির কাপড়চোপড় সর্বস্ব খুলে নিয়ে লাঞ্ছনা করে গেরার্ড আর তার নষ্ট দুষ্ট বন্ধুরা। মারিকে তার বাবা মা উদ্ধার করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু শেষ অবধি মারি কি বাঁচল? বালথাজার গাধাটাও কি বাঁচল? বাঁচা অত সোজা? অ্যান উইয়াজেমস্কির অভিজাত শারীরিক গড়ন। সাবলীল উপস্থিতি। বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ লুক গোদারের চোখে পড়ে গেলেন। ১৯৬৭তেই গোদারের সাথে অ্যানের গাঁটছড়া।  বিয়ে। তারপর বিয়ে কি টিঁকল? মোটে ১৯৭০ অবধি একসাথে থাকতে পারলেন। তারপর ছাড়াছাড়ি। আলাদা আলাদা থাকা। বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলল অনেকদিন ধরে। ১৯৭৯ এ বিচ্ছেদ পূর্ণ হল। এরমধ্যে ১৯৭১ সালে গর্ভপাতের সপক্ষে দাঁড়িয়েছেন অ্যান। বলেছেন, একটা মেয়ে সন্তানের জন্ম কবে দেবে, আদৌ দেবে কি না, এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার শুধুমাত্র মেয়েটির। তখনো ফ্রান্সের মাটিতে এসব কথা বললে লোকজন নিন্দা করে, রাষ্ট্র তাকে বলে বেআইনি কথাবার্তা।
তলপেট চেপে ধরে অনসূয়া চ‍্যাটার্জির বাড়ির সামনে দাঁড়ায় একটা মেয়ে।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register