রামনারায়ণ মিশ্রের চেম্বারে ঢোকার আগে সে দেখল এক পাল্লার ভারি দরজাটি অতি সামান্য খোলা। প্রায় বন্ধ দরজার ভিতরে কি আছে উঁকি দেবার রুচি তার নেই। তাহলে সে কি করবে?
শ্যামলী আবার গেটের কাছে ফিরে গিয়ে দরোয়ানকে বলল, মিশ্রজীর সাথে দেখা করব কিভাবে?
দরোয়ান গেট লাগোয়া খুপরি থেকেই ফোনে মিশ্রকে শ্যামলীর খবর জানাল। তারপর সে বলল, ম্যাডাম, আপনি আরেকটি বার যান।
শ্যামলী যেতে যেতেই মিশ্র বাইরে বেরিয়ে এলেন। বললেন, চেম্বারে বাইরের কিছু লোকের সঙ্গে ব্যবসা নিয়ে কাজ চলছে, আপনি কি আমার বাচ্চাদের সাথে একটু বসবেন?
শ্যামলী বলল, না, আমার খুব সে রকম জরুরি কিছু কাজ নয়। দু মিনিটের মধ্যেই হয়ে যেত।
রামনারায়ণ হা হা করে হেসে বলল, মিস পাল এসেছেন। এই সুযোগটা আমি মিস করব না। প্লিজ আমার ভিতরের বাড়িতে বসুন। ওদের ছেড়ে দিয়েই আমি আসছি।
শ্যামলী লজ্জা পেয়ে বলল, সে কি কথা, আমার জানা ছিল না, তাই এসে পড়েছি। আমি না হয় অন্য একসময়...
রামনারায়ণ মিশ্রের বাচ্চারা ঘরে পড়ছিল। তাদের কাছে গিয়ে তিনি বললেন, এই দ্যাখো, ইনি একজন আন্টি। খুব ভালো গল্প বলতে পারেন। তোমরা চাইলে উনি গল্প বলবেন। আর মাম্মিকে বলো আন্টিকে কফি খাওয়াতে।
শ্যামলী বলল, সে কি, বাচ্চারা পড়ছে, এখন আপনি আমাকে কী অস্বস্তিতে ফেললেন বলুন তো?
রামনারায়ণ বললেন, ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিট। তারপরই আসছি।
কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে বাচ্চাদের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করল শ্যামলী। ছোটটি কন্যা সন্তান। সে বলল, আমার ফ্রেন্ড দের আণ্টিরা পড়ায়। কিন্তু আমি মাম্মির কাছেই পড়ব। তোমার কাছে নয়।
শ্যামলী বলল, না না, আমি তো পড়ানোর আন্টি নই। পড়ানো খুব শক্ত কাজ।
ছোট্ট মেয়েটি ঠোঁট উলটে বলল, আন্টিরা স্কুলে মারে। আই হেট।
শ্যামলী বলল, আই অলসো হেট বিটিং।
মেয়েটি বলল, দেন ইউ আর মাই ফ্রেন্ড।
তারপর তার বাক্স থেকে একটা চকোলেট বের করে বলল, হ্যাভ এ চকোলেট প্লিজ।
মেয়েটি চকোলেট দিতে তার কাছে আসতেই শ্যামলী তাকে জড়িয়ে ধরে কোলে না নিয়ে পারল না।
ছেলেটি তাকে বলল, আন্টি, তুমি ড্রয়িং পারো?
শ্যামলী বলল, একটু একটু পারি।
ছেলেটি পেনসিল এগিয়ে দিয়ে বলল, দেন প্লিজ ড্র সামথিং।
পেনসিল হাতে নিয়ে চটপট শ্যামলী কতকগুলো রেখার সাহায্যে দুষ্টু মিষ্টি দুটি ভাইবোনকে এঁকে ফেলল। ওরা দুজনে অবাক হয়ে শ্যামলীর আঁকা দেখছে, এমন সময় মিসেস মিশ্র এসে বললেন, ওরা দুটোতে আপনাকে খুব জ্বালাতন করছে নিশ্চয়ই।
শ্যামলী বলল, মোটেও না। ওদেরকে আমার খুব ভালো লাগছে।
এবার মেয়েটি বলল, আন্টি তুমি রিসাইটেশন পারো?
শ্যামলী বলল, আজ কি বার বাংলায় বলো তো?
ছেলেটি বলল, আজ সোমবার।
শ্যামলী বলল, তাহলে সোমবারের একটা কবিতা বলছি। বলে সে শুরু করল, সোম মঙ্গল বুধ এরা সব আসে তাড়াতাড়ি। দাঁড়াও, কবিতার নামটা আগে বলি। কবিতার নাম "রবিবার"
সোম মঙ্গল বুধ এরা সব
আসে তাড়াতাড়ি,
এদের ঘরে আছে বুঝি
মস্ত হাওয়াগাড়ি?
রবিবার সে কেন, মা গো,
এমন দেরি করে?
ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে
সকল বারের পরে।
আকাশপারে তার বাড়িটি
দূর কি সবার চেয়ে?
সে বুঝি, মা, তোমার মতো
গরিব-ঘরের মেয়ে?
সোম মঙ্গল বুধের খেয়াল
থাকবারই জন্যেই,
বাড়ি-ফেরার দিকে ওদের
একটুও মন নেই।
রবিবারকে কে যে এমন
বিষম তাড়া করে,
ঘণ্টাগুলো বাজায় যেন
আধ ঘণ্টার পরে।
আকাশ-পারে বাড়িতে তার
কাজ আছে সব-চেয়ে
সে বুঝি, মা, তোমার মতো
গরিব-ঘরের মেয়ে?
সোম মঙ্গল বুধের যেন
মুখগুলো সব হাঁড়ি,
ছোটো ছেলের সঙ্গে তাদের
বিষম আড়াআড়ি।
কিন্তু শনির রাতের শেষে
যেমনি উঠি জেগে,
রবিবারের মুখে দেখি
হাসিই আছে লেগে।
যাবার বেলায় যায় সে কেঁদে
মোদের মুখে চেয়ে।
সে বুঝি, মা, তোমার মতো
গরিব ঘরের মেয়ে?
বাচ্চারা খুব মন দিয়ে কবিতাটা শুনল। এমন সময় হাসিমুখে রামনারায়ণ বললেন, আজ যে আমার দারুণ একটা লাভ হল। এই কবিতাটা রাস্তায় চলতে চলতে অনেক আগে একদিন শুনে খুব ভাল লেগেছিল। তারপর এই আজ আবার আপনি শোনালেন। আচ্ছা, আমি ফ্রি হয়েছি। ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে মিশ্র বললেন, আন্টির সাথে আমার কাজ আছে। তোমরা টা টা করে দাও। মেয়েটি বলল, না, আন্টি যাবে না। আমাদের কাছেই থাকবে।
মিশ্র শ্যামলীর দিকে চেয়ে বললেন, ওফ্ কয় মিনিটে ওদের একেবারে জয় করে ফেলেছেন। তখন ছেলেটি বাবাকে দেখাল, শ্যামলী তার খাতায় কি এঁকে দিয়েছে।
রামনারায়ণ মিশ্র শ্যামলীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, কয়েক মিনিট আগে যে মেয়েকে এখানে রেখে গেলাম, এসে দেখছি সে বদলে গিয়েছে।
শ্যামলী বাচ্চাদের বলল, সত্যি সত্যি আজ আমার অনেক কাজ আছে। নইলে আমি আরেকটু থাকতাম।
রামনারায়ণ বললেন চলুন চেম্বারে যাই।
চেয়ারে বসে শ্যামলী বলল, গতকাল গাড়িটা পাওয়ায় খুব সুবিধা হয়েছিল। তারপর নিজের হাতব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার একমাত্র নোটটি বের করে বলল, তেলের খরচ বাবদ এটুকু রাখুন।
অদ্ভুত ভাবে দুহাত পেতে রামনারায়ণ শ্যামলীর দেওয়া টাকাটা নিলেন। তাঁর নেবার ভঙ্গি দেখে শ্যামলী হেসে ফেলল।
তারপর রামনারায়ণ বললেন, আপনাকে প্রথমটা দেখে খুবই অন্যরকম লাগছিল। এখন আবার একটু সামলে গিয়েছেন। তা রবিবার টা আপনি কেমনধারা কাটিয়েছেন কবিতার মধ্যে বলে দিয়েছেন। বন্ধু বলে সম্মান দিয়েছেন তাই বলছি, বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ দেবেন। আজ আপনার মুখটা খুব শুকনো লাগছিল। আমি আপনার খানিকটা জানি। অনেকটাই জানি না। তবুও বলছি, কোনো ক্রাইসিস থাকলে নিজের মনে করে বলবেন। আমাকে লোকেরা মাফিয়া বলে। কিন্তু ভেতরে আমার এখনো একটা মানুষ আছে, যে কাঁদতে জানে। বন্ধু, কাঁদার জন্য এই একটা কাঁধ আপনার রইল।
শ্যামলী হাসার চেষ্টা করে বলল, ওমা, আপনারা থাকতে আমি কাঁদব কেন?
রামনারায়ণ বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান আর শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত কিনে এনেছি। সকালে কথামৃত পড়া শুরু করে দিয়েছি। আর রাতে শুতে যাবার আগে গীতবিতান খুলে একটার পর একটা গান কবিতার মতো করে পড়ে যাই। ওতেই একটা গান আছে, আমার না বলা বাণীর...
0 Comments.