Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ৩)

maro news
সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব - ৩)

আমার কথা 

সত্তর দশকের শেষেও ঠাকুর দেখতে যেতাম বাবা মায়ের সাথে। বরানগরে সে সময় বেঙ্গল ইমিউনিটি চমৎকার দুর্গাপূজা করতেন। প্রতিমার আয়তনে, আভরণে, আলোকসজ্জা ও নান্দনিকতায় তাঁদের পুজো লোক টানত খুব। ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার লোক থাকত। সেই পূজায় ধুনুচি নাচ দেখে অবাক হতাম। গঙ্গার ধারে রং কলের কাছে ছিল সাধন সমর আশ্রম। তাঁদের পূজা ছিল সম্পূর্ণ অন্য ঘরানার। সেখানে দেবী ছিলেন সহজ সুন্দরী। তিনি কৃষক রমণীর সহজ সরল বাহুল্যহীন বেশে সজ্জিতা। কোনো অস্ত্র টঙ্কার তাঁর ছিল না। শাদা শাড়িতে লাল পাড়ে তিনি অসামান্য সুন্দরী। শান্তি আর স্বস্তি আর মাতৃত্ববোধ সর্বাঙ্গে বিকশিত। এই সাধন সমর আশ্রমের পূজা অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠার সাথে হত বলে শুনেছি। বাবা এই পূজাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। দেবী ওখানে রণরঙ্গিণী খড়্গ কৃপাণধারিণী ছিলেন না কখনো। অসুরও তাঁর কাছে ক্ষমার্হ। আমার বিপক্ষে থাকলেই যে তাকে কোতল করতে হবে, এই কিলার ইনস্টিংক্ট সেই সাধন সমর আশ্রমের দুর্গার ছিল না। ১০ আমাদের বাড়িতে রাজনীতির চর্চা হত না। রাজনীতির লোকেরা ভোটের দিনগুলোতেও আমাদের বাড়িতে গল্পগাছা করতে আসতেন না। বাড়িতে কে আসবেন না আসবেন, তা ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। স্কাউট দলের তরফে কখনো কখনো অনেক সিনিয়র দাদারা কেউ আসতেন। আমাদের গৃহশিক্ষক ছিল না। বাবা মা যেটুকু পড়াতে পারতেন, তাতেই কাজ মিটে যেত। । বাবা পছন্দ করে পড়ার বাইরের বই দুই চারটা করে কিনে এনে দিতেন। বাড়িতে মজুত গল্পের বইয়ের সংখ্যা ছিল তেমন বলার মত নয়। যে কয়খানি মা বিয়েতে পেয়েছিলেন, তা অজস্রবার করে পড়ে ফেলেছিলাম। বাইরের জগতের তরঙ্গ বাড়ির মধ্যে বিশেষ পৌঁছত না। একটা রেডিও ছিল। মাতামহ তাঁর কন্যাকে বিবাহের কিছু পরে উপহার দিয়েছিলেন। সেটার লাইসেন্স রিনিউ করাতেন বাবা। সেটিতে মা বাবা গান শুনতেন। নাটক শুনতেন। শিশুমহল হত রবিবারে। মন দিয়ে শুনতে হত। ভালোই লাগত। আরো ভাল লাগত ফাঁক পেলেই রেডিওটির পিছন খুলে কি আছে সেখানে, দেখতে। মা গান শুনতে ভালবাসতেন। আধুনিক গান। আরতি মুখোপাধ্যায়, সুমন কল্যাণপুর এই নামগুলি মনে গেঁথে আছে। খবর কি শুনতাম? শুনেও কি বুঝতাম? এর মধ্যে বাবা একদিন বলেছিলেন হেমন্ত বসুকে হত্যার কথা। নিরভিমান সহজ সরল মানুষ হেমন্ত বসুকে রাজনৈতিক শত্রুতায় পিঠে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছিল। হেমন্তবাবু না কি আততায়ীদের বলেছিলেন, "তোমরা আমাকে মারছ কেন, আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করি নি।" হেমন্ত বাবু কি জানতেন না যে রাজনৈতিক শত্রুতার যুগে আততায়ী ভাড়া করা হয় খুন করার জন্য। খুন আততায়ীর পেশা। তার সাথে যুক্তি ও ভাবাবেগের কোনো সম্পর্ক নেই। ১১ সত্তর দশকের শেষেও বাংলায় দেওয়াল লিখনের কিছু গুরুত্ব ছিল। আমরা দেওয়ালে ভোট প্রচার ছাড়াও আরো কিছু জ্ঞানগর্ভ কথা লেখা দেখতে পেতাম। তার একটি হল "শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে মুক্তি।" আর একটা কথা ছিল "ভুখা মানুষ ধরো বই। ওটা হাতিয়ার।" সমাজ পরিবর্তনের দিকে জোর দেওয়া হত। যখন বোঝা গেল যে বামফ্রন্ট পর পর জিতেই চলবে, তখন দেওয়ালে এই সব জ্ঞানগর্ভ কথা লেখার প্রয়োজন হারিয়ে গেল। তখন খুব যত্ন করে আর্টিস্ট দিয়ে হলদিয়া পেট্রোকেম ও বক্রেশ্বর তাপ বিদ্যুতের কথা সব জায়গায় লেখা হত। কিন্তু একটি আধুনিক কারখানা সুনিশ্চিত ভাবেই পুঁজি নিবিড় হবে, তা কি করে লাখো মানুষের হাতে কাজের যোগান দেবে বুঝতে পারতাম না। তবে দেখেছিলাম হলদিয়া নিয়ে সুদীর্ঘকাল টালবাহানা চলেছিল। আর বক্রেশ্বর নিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে অপচয়ের কারণে রক্তদান আন্দোলন একটু হলেও ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। বামপন্থী ভোট যত সুনিশ্চিত হতে লাগল, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বামপন্থী বোধ ও বিবেক মার খেতে লাগল। তখন বুঝতাম পাওয়ার করাপ্টস। ১২ রাজনীতির লোকেরা উচ্চরুচিপূৰ্ণ হবেন, এটা শুনতে যত ভাল, বাস্তবে এর অভাব ততখানি। রাজনৈতিক সৌজন্য কাকে বলে কোনোদিন দেখিনি। আমার অল্প বয়সে, ইন্দিরা গান্ধী যখন জীবিত, তখন তাঁর মুখের সাথে একটি সর্পদেহ জুড়ে দিয়ে নিচে একটি রবীন্দ্র কবিতা লেখা হত। "প্রান্তিক" কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি। "নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। শান্তির ললিত বাণী শোনাইছে ব্যর্থ পরিহাস।" কবিতা রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু একজন মহিলাকে ভারতীয় সমাজে "নাগিনী" শব্দে চেনানো রাজনৈতিক সৌজন্য হতে শত যোজন দূরে। আসলে সৌজন্য জিনিসটাই রাজনৈতিক পরিসর থেকে গুমখুন হয়ে গিয়েছিল। তারই চেহারা দেখেছিলাম "হল্লা বোল" নাটক করতে গিয়ে সফদর হাশমির খুনে। এই বামপন্থী নাট্যকারের হত্যা নির্ঘাৎ রাজনৈতিক হত্যা ছিল। খারাপ লাগে যে ভোটের স্বার্থে এই মৃত্যুকেও ভোলা চলে। পলিটিক্স একই সাথে "সম্ভাবনার শিল্প" আর "লাস্ট রিসোর্ট অফ...." না, ওই শব্দটা উচ্চারণ করতে সৌজন্যে বাধছে আমার। বুঝ লোক যে জান সন্ধান।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register