Fri 19 September 2025
Cluster Coding Blog

প্রবাসী মেলবন্ধনে দীপশিখা দে (মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া)

maro news
প্রবাসী মেলবন্ধনে দীপশিখা দে (মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া)

ডিঙি

অভ্যেসের অ্যালার্ম ক্লক বেজে উঠলো। পলা কোনোভাবে আধ বোজা চোখে ফোনটা কাছে নিল। অ্যালার্ম বন্ধ করে দেখলো ফোনের চার্জ ৫ পার্সেন্ট দেখাচ্ছে। আজকাল রাতের অন্ধকারে সময়ের হিসেব গড়িয়ে যায় ফোনের স্ক্রিনে হাত নেড়ে। এই থেমে থাকা জীবনে স্ক্রিনের উপর ফুটে ওঠে জানা অজানা মানুষের সুখের ছবি। সবাই কত সুখী , কেবল পলার জীবনেই কি কষ্ট ? ভার্চুয়াল সোশ্যাল গ্ৰুপে দেখে সবাই পুরোনো ফটো পোস্ট করছে। নাহ ! তাহলে শুধু পলা নয় , সবাই সক্কলে কষ্টে আছে। জীবনের রং হারাচ্ছে, সবাই যেন আগের বছরের ময়লা কাগজের ঠোঙায় দোলের বেঁচে যাওয়া বাড়তি রঙ মিশিয়ে দিচ্ছে এই ফিকে জীবনে একটু উৎসব হুল্লোড়ের আমেজ পেতে। পলা রাত জেগে সেই সব ছবি দেখে। মন দিয়ে জানা অজানা মানুষের খুশির রং মাখা চোখের সত্যি টা খোঁজে। ঘুম না আসা চোখে সেই খুশির কাজল মাখতে চায় সে । সময় কেটে যায়, রাত আরো গভীর হয় । বাড়ির পাশের জংলা ঝোপের মধ্যে থেকে বাদুড়ের আওয়াজ , পেঁচার ডাক শুনতে পায়। আজকাল দুটো ডাকের ফারাক সে করতে পারে। ফ্ল্যাট বাড়িতে ছেলেবেলা কেটেছে। বিয়ের পর এই বাড়িতে আসা। তখন পাড়া অনেকটাই ফাঁকা ছিল। শ্বশুর মশাই অনেকটা জলা জমি সস্তায় কিনে এই বাড়ি করেছিলেন।পাশের জমি এখনো ফাঁকাই আছে। জলা জমি বিক্রি হয়না, ইট পাথরের ইমারত তৈরী না হলেও অযত্নের অনাথ গাছপালারা ভালোই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বড় হয়েছে। আর সেখানে অনেক প্রাণ , বুনো ফলের পসার সাজানো। প্রথম প্রথম রাতে জান্তব ডাক গুলোতে শিউড়ে উঠতো পলা। এখন নিশাচর প্রাণীদের নৈশ জীবনের উল্লাস ভালো লাগে। থেমে থাকা জীবনে এই রাত টুকুই যেন নতুন করে বাঁচতে শেখায় পলা কে। তাই নিদ্রাহীন রাতে সেই সুখী সাজানো রং মাখানো মানুষের ছবি , আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের জান্তব উল্লাস শুনে পলার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে ভোর রাতের দিকে। যখন ভোরের আলো চাপা দুঃখের মত মেঘের আড়াল থেকে মুখ বের করে , কালো রাত তখনও কালি মাখা ভোরের চোখে একটা বিষাদ মাখিয়ে রাখে। ঠিক সেই সময় এক অদ্ভুত ঘুমের রেশ থাকে পলার চোখে। আর কিছু ঘন্টা পরেই তো সূর্যের প্রখরতা আবার একটা অজানা দিন শুরু করবে। রজত এখন সকালে চা টা বানিয়ে ডাক দেয় পলা কে। জোর করে শুকনো ঠোঁটে একটু হাসি এনে পলার কাছে চা নিয়ে আসে। এই একটি মুহূর্ত পলার জীবনের সব থেকে সুখী মুহূর্ত। ঠিক এই সময় একটা ছবি যদি তুলতে পারতো ....নাহ ! এ পলার একান্ত আপন মুহূর্ত। রজতের কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে দামী আদর। পাশের ঘরে চায়ের চুমুক শেষ করে গিয়ে দেখে নিজেরদের ভালোবাসার রক্ত মাংসে তৈরী একটি সম্পূর্ণ প্রাণ রোজ যে একটু একটু করে রঙিন হচ্ছে বড়ো হচ্ছে , রজত -পলার একমাত্র সন্তান।ওর জন্য একটা নিশ্চিত জীবনের ঠিকানা যে তৈরী করতেই হবে। রোজ সকালে হিসেবের লম্বা লাইন টানা খাতাটা নিয়ে বসে ওরা দুজনে। আমলা -মন্ত্রীরা জনগণের স্বার্থে ঘরবন্দি থাকার নতুন নতুন ফরমান জারি করছেন। নতুন হিসেব তাই পুরোনো হিসেবের সাথে কাটাকুটি খেলে। দুই খেলোয়াড় রজত - পলা কাটাকুটি খেলায় দুজন দুজনকে জিতিয়ে দিতে চায় কিন্তু পারেনা। খুঁটির জোর কম এমন দুটো মানুষ ও একসময় হাতে হাত ধরে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটিয়েছিলো। রজতের ট্যুর আলাউন্স , পলার টিউশন ক্লাস সব মিলিয়ে দুজনের চাকরির পাশে সহাবস্থান করতো এই আয়ের একটা বড়ো অংশ। ছেলের ভালো স্কুল , দুটো কোচিং , ক্রিকেট ক্লাব , বছরে পুজোর পর আর গরমের ছুটিতে ই এম আই তে কেনা চার চাকার ছিমছাম গাড়িতে বোলপুর,মুকুটমণিপুর, তালসারি , মাসে একবার বিরিয়ানি হাউসে নৈশভোজ, অল্প অল্প টাকা জমিয়ে শখের হালকা গয়না, কিছু ভালো প্রদেশীয় শাড়ি , কিছু ফিক্সড ডিপোজিট ইত্যাদি। একটা উত্তাল ঢেউ হীন মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভেসে চলা জীবন ডিঙি আজ চোরা ঘূর্ণির ফাঁদে পড়েছে। শক্ত করে ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে রজত পলা প্রানপনে তাদের ডিঙির কিনারা শক্ত করে ধরে রেখেছে। প্রাইভেট কোম্পানির ট্যুর দূর অস্ত , স্যালারি তিরিশ শতাংশ কেটেছে আর কিছুদিন পর হয়তো হাফ মাইনা,যদি না কোম্পানি উঠে না যায়।ওদেরও উপায় নেই যে। পলা প্রাইভেট স্কুলে extra curriculam এর শিক্ষিকা। এই পরিস্তিতিতে বিনা মাইনে তে আছে। বড়দি বলেছেন, মেন সাবজেক্টের টিচার দের মাইনা কমাতে হচ্ছে , সেখানে ডান্স -ড্রামা টিচার এর মাইনে কি করে সম্ভব। তাই স্কুল থাকলে চাকরি থাকবে এই প্রতিশ্রুতিতে পলাকে বলেছেন আপাতত অপেক্ষা। অনলাইন ক্লাসের বাজারে নাচের ক্লাস এর টিউশন বন্ধ। মিষ্টি আঙুরের এক থোকায় কিছু আঙ্গুরের পচন বাকি আঙ্গুরগুলোকেও পচিয়ে দেয়। জীবনের সব চাহিদা যোগান একে অপরের পরিপূরক হয়। আজ সেই সব নিয়ম ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে। পলা নতুন হিসেবের খাতা টা খুলে বসলো ভাত চাপিয়ে এসে। ভৌমিক বাড়ির সামনের ফটকে কালো রঙের দরজায় সাদা রং দিয়ে রজত লিখেছে ' অন্নপূর্ণা ভান্ডার ( এখানে চাল,ডাল ,সর্ষের তেল, মুড়ি , আটা , বিস্কুট নিত্যদিনের জিনিস ছোট প্যাকেটে পাওয়া যায় )' কারণ উপায়হীন জীবনে এখন মাস কাবাড়ির হিড়িক নেই , যখন যেমন অল্প করে মুদিখানা বাজার মানুষ করছে। হাতের টাকা এখন প্রাণ ভোমরা , একটু একটু তাকে পিষে সেই ভোমরার রক্ত তুলে মানুষ বাঁচছে। কাল রাতে কি একটা সংকোচ লজ্জ্বা মেশানো কান্না ডুকরে উঠছিলো গলা দিয়ে পলার।বাড়ির সামনের লম্বা বারান্দা হচ্ছে তাদের মুদির দোকান। আর সেই চার চাকার বাদামী রঙের গাড়ি এখন এমার্জেন্সি hospital সার্ভিস এর গাড়ি। রজত কিন্তু কিন্তু করেও শুরু করলো এই সার্ভিস। সপ্তাহে তিন দিন গাড়িটা কাজে আসছে। আশেপাশের পাড়ার লোক জানে ড্রাইভার সহ গাড়ি পাওয়া যাবে যেকোনো সময়। গতকাল রাতেই একটা ট্রিপ দিলো রজত , ভোরবেলা ফিরেছে। প্রথম যেদিন রজত বাড়ি ফিরেছিল হাসপাতালের এক রুগী কে বাড়ি পৌঁছে। বাথরুমে স্নানের শব্দের সাথে একটা ভারী গোঙানির কান্না শুনেছিলো পলা। তারপর থেকে সব ঠিক।রজত এখন অনেকটা ফুরফুরে মনে থাকে। কালো রঙের ভৌমিক বাড়ির গেটে সাদা রঙে তুলির আঁচড়ে রজত লিখেছে ' ড্রাইভার রজত ভৌমিক , সাথে যোগাযোগের নম্বর ,( এখানে রাত বিরেতে ইমার্জেন্সি ড্রাইভার সমেত গাড়ি পাবেন সম্পূর্ণ sanitize, ভইরাসমুক্ত গাড়ির পরিষেবা) ছেলেটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।একটা আলতো আদর করে পলা মুদিখানার সামগ্রীর একটা ফর্দ তৈরী করতে বসলো। হঠাৎ করে সংকোচ দ্বিধার মন খারাপটা সরে গেলো টেবিলের কোনায় রাখা গত বছরের পৌষ মেলার তিনজনের ছবিটা দেখে। মনে হল, দুটো খুঁটির জোরহীন মানুষই পারবে ডিঙি নৌকোকে শান্ত নদীর পাড়ে নিয়ে আসতে। পারতে যে হবেই , উপায় নেই। একটা নিশ্চিত ঠিকানা নিজেদের জন্য গড়তেই হবে। সম্মান, সংকোচ ,দ্বিধা ,ভয় সব কিছুর অর্থ রোজ পাল্টাচ্ছে। মধ্যবিত্ত বোধ হাত পাততে পারেনা , কিন্তু রজত -পলা দুজনের মধ্যবিত্ত হাত ডিঙির কিনারা শক্ত করে ধরে রাখবেই। উপায়হীনতা নতুন উপার্জনের পথ খুলে দিচ্ছে। রাতের জান্তব ডাক ভয়ঙ্কর সত্য ,তাতে আর ভয় করেনা পলার। বরং বাঁচার লড়াই শেখায় সেই শব্দ।
Admin

Admin

 

0 Comments.

leave a comment

You must login to post a comment. Already Member Login | New Register