শহরতলির ইতিকথা
রমা,পরীক্ষার প্রস্তুতি চালাচ্ছে,শোনা গেল। এবারও সে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাবে।
কথকঠাকুরের নাতির এক বন্ধু, দূরের অঞ্চলে স্কুল- মাষ্টারি করে; সেই এখন রমাকে পরীক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করছে;সন্ধ্যেবলায়, প্রায় প্রতিদিনই এসে ওদিকের ভিতরের ঘরেই চলে, পড়ানো।
সামনেই রাস্তার দক্ষিণ দিকে হাজরামশাই বাড়ি করে উঠে গেছে। রমাদের বাড়ির দক্ষিণে, রাস্তার দিকে রয়েছে উঁচু রোয়াক; ঐখানকার দরজা দিয়েই সন্ধ্যের পর রমাদের ভিতরের ঘরে যাওয়া-আসার পথ। হাতে
হ্যারিকেন নিয়ে নিভাননীদেবী, সদর দরজার খিল বাইরে থেকে হাতল ঘুরিয়ে বন্ধ করে যাবার পর,ঐ সদর দরজায় হুড়কো দিয়ে ভিতর থেকে বন্ধ করা হয়। রোয়াকের ওপর দরজা দিয়েই, তারপর চলে যাতায়াত। রঞ্জনদের ঘরের রুজু-রুজু জানলা দিয়ে সবই চোখে পড়ে। সজীব-রাজীব, ওদের রাস্তার দিকের ঘরটায় থাকে, পড়াশোনা করে। পরের বছর, সজীব, স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষায় বসবে।
মেয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, ঐ নতুন বাড়িতে আসার কিছুদিন পর থেকেই, হৈমবতীরও আঁতুড় ঘরে ঢোকার প্রয়োজন পড়লো;ঘর তো মাত্র দু’টো,তাই রান্নাঘরের এককোনেই প্রসবের ব্যবস্থা হয়েছে; এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিল হৈমবতী। বাড়িতে তো আর কোনো মহিলা নেই, তাই ছেলেদেরই সব করতে হয়েছে; সজীবই, বাড়ির পিছনের চাঁপাগাছ তলার জঙ্গলে মাটিতে গর্ত করে, ‘গর্ভ-ফুল’ পুতেছে। নতুন সদস্যের আগমনে, হৈমবতীর পক্ষে তো কিছুদিন সংসারের রান্না-বান্না করা সম্ভব হলো না; ছেলেরা যা হোক করে ফুটিয়ে-ফাটিয়ে ঐ দিনগুলো কাটায়। রজত তো সবেমাত্র, এ বাড়িতে আসার পর দাঁড়াতে পারছে, এখনও সুস্থ হবার পথে, তাই সব কিছুই সজীব- রাজীবকে সামাল দিতে হলো। কিছুদিন পর থেকেই, সেই বোনকে কোলে নিয়ে, স্কুল-ছুটির পর,বিকেলে খেলার মাঠে, মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা; সব ছেলে খেলছে, আর রাজীব আছে দাঁড়িয়ে; চোখে আসে জল, কোলে জাপটিয়ে ধরে থাকা অসহায় সহোদরা; এভাবেই কাটলো রাজীবের, কিশোর-বেলা। এদিকে, শিশুর-খাবারের জন্য বড়দের খাবারে পড়লো টান; স্কুল থেকে আসার পর, প্রায়দিনই, দু’মাইল দূরের পথ, কল বাজারে, ধর্মদাসবাবুর ছিল,রাজীবকে নিয়ে বাজার করতে যাওয়া, সস্তায় সেখানে মাছ,সব্জি পাওয়া যায়; অর্থাৎ রাজীবের জীবনে, কৈশোরের অবসান ঘটলো চোখের জলে; কৈশোর-কালে, খেলাধুলা বহে গেল ,কাঁধে করে বাজার বহে।
খাবারের মুখ বেড়েছে,আয় রয়েছে সীমিত;সংসারের আর্থিক ক্ষেত্রে সর্বত্র ‘ঘোঘের’ উদ্ভব হয়েছে। না, তা মেরামতের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু জনসংখ্যার বৃদ্ধি, আর সজীব-রাজীবের সংঙ্গে হাজরা দম্পতির মানসিক দূরত্ব বেড়েই চললো। স্কুলের সহপাঠীরা
‘টিটকারি’ দিয়ে ভাই-বোন আসার সংবাদ জানতে চায়; জন্ম-রহস্য তো আর নাইন-টেনে পড়া ছেলেদের কাছে অজ্ঞাত নয়, শুধু লজ্জা, শুধুই লজ্জায় মুখ ঢেকে রাখা। রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দ প্রভৃতি মানুষদের পিতা-মাতারাও জন্ম নিয়ন্ত্রণ করেননি, তাঁদের প্রতিপালন ক্ষমতা ছিল; কোনো সন্তানকে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করতে, খোয়া ভাঙ্গতে হয়নি,কোলে করে সহোদর-সহোদরাকে নিয়ে খেলার মাঠের বাইরে
দাঁড়িয়ে, চোখের জল ফেলতে হয়নি, আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়নি।মেয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে পরিবার সীমিত করেছে;না,হাজরা-দম্পতির সে বোধ নেই, সে চক্ষু-লজ্জার বালাইও নেই; একটা নেশার ঘোরে তারা সংসারটাকে জণাকীর্ণ করে তুলতে তৎপর।সহপাঠীদের কথার উল্লেখ কালে,হৈমবতীর কী ঝাঁঝালো উক্তি, “ও রকম পড়াশোনার মুখে মারি ঝাঁটা,বাপ-মা’র সম্পর্কে এমন কথা”। হায়! অবোধ-অশিক্ষিতদের হয় এমনই কথা; পাড়ার লোকে, সামনে সমর্থন জানালেও, পিছনে যে টিটকারি দেয়, তা বোঝারও মানসিকতা, তারা হারিয়ে ফেলেছে; ফলে হলো কী, কাক-পক্ষীও আর অশান্তির চোটে বাড়িমুখো হতে ভয় খায়।পাড়ার লোকে পিছনে বলে, “বেশ হয়েছে,এবার দেখ মজা”।
ঘর তো মাত্র দুটো, জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট-এ, শুধুই ট্যাঁ, ভ্যাঁ; ছেলেদের পড়াশোনার দফারফা, সৌজন্যে তাদেরই জন্মদাতা-জন্মদাত্রী, হাজরা দম্পতি।