শহরতলির ইতিকথা
সজীবের স্কুল-ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে।রমা, এবারও সজীবের সঙ্গে পরীক্ষায় বসেছে;না ,সজীব পরীক্ষায় থার্ড ডিভিশনে পাশ করলেও রমার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। রমাদের বাড়ির থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি; বাড়ি নিশ্চুপ, ভাড়াটিয়ার ছেলে পাশ দিল, আর তাদের মেয়ে?
সজীব,নৈশ-কলেজে ভর্তি হয়েছে; হাজরার কারখানায় শ্রমিকের চাকরি পেয়েছে; শিফ্টং ডিউটি থাকলেও পড়াশোনার জন্য, কোম্পানি তাকে মর্নিং ডিউটির সুযোগ দিয়েছে। দিনের বেলা কারখানায় কাজ, আর সন্ধ্যায় চলে যায় নৈহাটির ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজে, বাণিজ্য নিয়ে পড়ছে; সংসারে সামান্যতম আয় বৃদ্ধি হয়েছে; হলে কী হবে; ‘ঘোঘ’ যেখানে সর্বত্র, সেখানে তো গরম চাটুতে এক বিন্দু জলের মত তা নিমেষে উদাও; যা হোক, খড়-কুটোও তো ডুবন্তের কাছে আশার সঞ্চার——।
চাকরি আর পড়াশোনা, দু’টো চলছে একসাথে, তাই সজীবের পক্ষে সংসারের দিকে নজর দেবার সময় নেই। রাজীবকেই, সংসারের বাজার, দোকান, মিউনিসিপ্যালিটির টাইম-কল থেকে জল আনা, সব, সবই করে, নিজের পড়াশোনার চালাতে হচ্ছে। বাড়িতে তো পড়াশোনার পরিবেশ নেই। অগত্যা রাতেই—-। পরীক্ষার আর বিশেষ দেরি নেই। রজত আছে ব্যস্ত ঐ এণ্ড-গেণ্ডি নিয়ে। সুতরাং,সবই রাজীবের ঘাড়ে।
সকাল বেলা বাজার যাবার পথে, লাইব্রেরি ও পাঁচু ময়রার দোকানের মাঝপথে, শহরের মেন- রাস্তায়, প্রায়ই এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়; পায়ে থাকে গামবুট, সাইকেলে চেপে খুব ব্যস্তভাবে, অতি পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে,ভালো তো জিজ্ঞেস করে,প্রত্যুত্তরে,ভালো,ভালো, বলে অতি তৎপরভাবে সাইকেলের প্যাডেল চালিয়ে চলে যান;চোখে চশমা, লম্বাটে চেহারা,কালো রুক্ষ বর্ণ হলেও বুদ্ধিদীপ্ত চোখগুলো যে কোনও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের পক্ষে যথেষ্ট। কাঁধে থাকে উপচে পড়া সাইড-ব্যাগ, বিভিন্ন জিনিসে পরিপূর্ণ; ব্যাগ না বলে বস্তা বললেও, কোনো অত্যুক্তি হয় না। লোকটির পরিচয়, রাজীবের কাছে অজ্ঞাত; সে, স্কুলের বন্ধুদের কাছেও জিজ্ঞেস করেছে, কেউই কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। লোকটিকে আর সারাদিন, এ তল্লাটে দেখা যায় না।
পাড়ার এক দাদা,টেস্ট-পেপারের অঙ্কগুলো সমাধান করতে সাহায্য করছেন।তিনি,স্কুলের প্রধান ক্লার্ক,ব্যাচেলার মানুষ,তাই রাতেই সময় হয়। অন্যান্য সাবজেক্টের পড়া শেষ করে,রাতের খাবার খেয়ে, ন’টা, সাড়ে ন’টা নাগাদ দাদার বাড়িতে রাতে, এবিটি’র অঙ্কের টেস্ট পেপার গুলোর সমাধান চলছে। আরও তিনজন আছে,ওদের মধ্যে দাদার এক সম্পর্কের ভাইঝিও আছে; সে,স্থানীয় গার্লস স্কুলের ছাত্রী, এবার পরীক্ষায় বসবে। একদিন, কথা প্রসঙ্গে, ঐ অদ্ভুত ভদ্রলোকের কথা উঠতেই, দাদা ও ভাই- ঝি, পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করায় ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়। দাদার কাছে খবর পাওয়া যায়, পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিলাপ শুরু হবে; দাদার ভাইঝি, রাজীবের অঙ্কের খাতাটা চেয়ে নিয়ে বলে, কাল সকাল ঠিক ন’টার সময় এসে, ওদের বাড়ি থেকে খাতাটা নিতে; সময়ের ওপর জোর দেওয়ায়, রাজীবও ঠিক ন’টায় ওদের বাড়িতে গেলে, দাদার ভাই-ঝি, রাজীবকে ওদের বারান্দায় চেয়ারে বসিয়ে খাতাটা ফেরৎ দিয়ে বলে,” “বাবু,একটু আসতে পারবেন?” ঘরের ভিতর থেকে সেই অদ্ভুত রকমের ভদ্রলোক বেড়িয়ে এসেই বলেন, “কিছু বলবে মা”? রাজীবকে বসে থাকতে দেখেই বলেন,”বেশ, বেশ, তুমিও দুর্গার সঙ্গে এবার পরীক্ষায় বসছো, খুব ভালো, খুব ভালো; তা, মা, তোমরা কথা বলো, আমি বেরোই,বলেই গায়ে সেই নীল শার্ট, পরনে মোটা কালো পাড়ের ধুতি, পায়ে গামবুট পরিহিত অবস্থায়, কাঁধে উপচে পড়া ঝোলা ব্যাগ নিয়ে সাইকেল নিয়ে অতিদ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
রাজীব তো একেবারে ‘থ’। দুর্গা বললো, “কী রে, এবার ওঠ,স্কুলের দেরি হয়ে যাবে তো”। জ্যেঠিমা অর্থাৎ দুর্গার মা, রেকাবিতে একটা নারকেল নাড়ু দিয়ে বললেন, “এখনই ভাত খেয়ে স্কুল যাবে,তাই এটা দিলাম, খেয়ে জল খাও”। রাজীব বলে, “জ্যাঠামশাই, কোথায় গেলেন? আর সঙ্গে ঐ রকম ঝোলাই বা কেন?” জ্যেঠিমা উত্তরে বলেন,”ঐ ব্যাগে ওনার পুষ্যিপুত্তুরদের জন্য টিফিন আছে; সময় মতো, না পৌঁছালে, তারা তো কাজে উৎসাহ হারাবে; আর একদিন এসো, তোমার জ্যঠামশাই’র সব কথা শুনবে”।
স্কুলে পরীক্ষার ফর্ম-ফিলাপ শেষ করে, রাজীব ও অন্যান্যরা শেষবারের মতন ওদের ক্লাস-রুমের জানলার কাছে দুটো বেঞ্চে মুখোমুখি বসে দূরে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন মনে মনে স্মৃতি-তর্পণ চলছে; হঠাৎই একজন ঐ সময়কালে হেমন্ত মুখার্জি মশাই ‘র গাওয়া গান “ঝড় উঠেছে, বাউল বাতাস, আজিকে——“, অন্যজনেরাও সম্বিতে এসে, হাইবেঞ্চে তবলার সঙ্কেত তুলতে ব্যস্ত; সবাই আছে একটা ঘোরে; কখন যে হেড-মাষ্টার মশাই, স্কুল রাউন্ড সেরে নিজের অফিসে যাবার পথে, একটু থেমে, “বলেন, হ্যাঁ, ঝড় উঠেছে–মাঝি, নৌকা সামাল”বলে চলে গেলেন। রাজীবেরা, আউট-গোয়িং বলে হয়তো কিছু বলেননি। ছেলেদের তো লজ্জায় কুঁকড়ে যাবার অবস্থা; এরপর কী করে, তারা স্যারের মুখোমুখি হবে!