T3 || আমার উমা || বিশেষ সংখ্যায় উজ্জ্বল কুমার মল্লিক

মৃত্যুঞ্জয়
ছুটির দিন। পাড়ার ঠেকে জায়গা পাওয়া ভার। সবাই সকালের বাজারটুকু করে দিয়ে
ঠেকে চলে এসেছে। পাশের চা’র দোকানের ছোকরারা এসে সবাই কে এক -প্রস্ত চা’র ভাঁড় ধরিয়ে চলে গেছে। আলাপ- আলোচনা বিলম্বিত লয়ে শুরু হয়ে দ্রুতে উঠতে চলেছে; আড্ডার মাহাত্ম্য নিয়ে চলছে তর্ক। সপ্তাহান্তে ঠেকে সবাই হাজির; নেই অফিসের কূট- কচালি, নেই কোন গভীরতা,নেই দায়-বদ্ধতা, কেবলই
প্রাণ খুলে আপনাকে প্রকাশ। শচীন- দা, চা’র ভাঁড়ের তলানিটুকু
শেষ করে মুখ খুলতেই , সবাই চুপ, কেবল অপেক্ষায়, দেখা শুধু, আলোচনা কোন দিকে যায়–।
“আচ্ছা, তোরা জানিস আমাদের ধর্মে উপবাসের একটা গুরুত্ব ভূমিকা আছে। একাদশী তো তোদের খুবই পরিচিত, কিন্তু কেন বলতো? বলতে পারলি না তো, জানি পারবি না” বলে শচীন- দা মুচকি হাসলেন। সবাই জানলেও বলবে, না, কারন, শচীন- দা’র বাচনভঙ্গিতে উত্তরটা
যে একটা বিশিষ্টতা পাবে , সেটা আর বলতে! তাই সবাই শচীন-দা’র মুখে র দিকে তাকিয়ে শোনার জন্য উন্মুখ।
“আমাদের শরীরের কোষগুলো সব সময় কাজ করে চলেছে এটা তো তোরা জানিস; আমরা যা খাবার হিসেবে খাচ্ছি, তা পরিপাক করে পুষ্টি জুগিয়ে, উত্তাপ সৃষ্টি করে দেহকে কাজ করার শক্তি জোগান দিয়ে চলেছে, আর ভূষি মাল, যেমন তোরা, তরকারির জন্য আনাজপাতির খোসা ইত্যাদি ঘরের ডাস্টবিনে ফেলিস, ঐ রকম কোষগুলোও নিজেদের পরিপাক ক্রিয়া শেষ করে, উচ্ছিষ্ট জমা রাখে নিজেদের কাছে থাকা ডাস্টবিনে।
বেশিদিন পড়ে থাকলে তো, দুর্গন্ধ বেরোবে, তাই মাঝে, মাঝে পরিষ্কার করতে হয়। এখন যদি,সব সময় রান্নায় ব্যস্ত থাকিস, তবে রান্নাঘর গোছাবি কখন, তাই তো ধর্মে রয়েছে অরন্ধন,উপবাস ইত্যাদি, ইত্যাদি।ঐ দিনগুলো রান্না বন্ধ, খাওয়া হয় পান্তা বা উপবাস। ঐ একই রকম শরীরে যদি কোন খাবার না দেওয়া হয়, মানে উপবাস করা হয়, তখন কোষগুলোর পরিপাকের জন্য কাজ নেই, নিজেরা ঐ ডাস্টবিনে থাকা জিনিসগুলোই খেতে থাকে, মানে পরিষ্কার পর্ব চলে, আর দূষিত জিনিস দূর হয়ে যাওয়ায়, শরীরটায় তাজা ভাব ফিরে আসে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। একে বলে অটো- ফেজ। জাপানী বৈজ্ঞানিক তো এই প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে নোবেল- প্রাইজও পেলেন। আরে, আমরা ওসব কবে বলেছি! যাক, এবার তোরা, এটাকে সারা সপ্তাহের অফিস- কাছারির কাজের সঙ্গে তুলনা কর, তারপর এই আড্ডায় আসা, বলে শচীন- দা মুচকি দিলেন।
সবাই তাড়স্বরে বলে উঠলো, “তার মানে, আড্ডার আসরে চলে ‘অটো- ফেজিং’; অর্থাৎ, আমরা সপ্তাহের কাজের ক্ষেত্রের গ্লানি, একঘেয়েমি দূর করে, নতুন অক্সিজেন নিয়ে, আবার এক সপ্তাহব্যাপী কর্ম- যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ”
“ঠিক তাই”, বলে শচীন- দা গম্ভীর হলেন।
আড্ডার অল্প বয়সী ছেলেটি বলে উঠলো, ” দাদা, কোষগুলো তো মরেও যায়।”
শচীন- দা , এবার শুরু করলেন পুরাণ কথা। আসর জম- জমাট।
“হ্যাঁ, কোষগুলো মরে যায়, আবার নতুন করে জীবনীশক্তি পেয়ে নতুন রূপে কর্ম- যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেন রিলে রেসের ব্যাটম হস্তান্তর ঘটে, তাই তো আমাদের শিবপুরাণে , মৃত্যুর মৃত্যু দেখি। ”
“সেটা কী রকম দাদা”, বলে সবাই উৎসুক হয়ে শচীন- দা’র পানে চায়।
” দেখ, আমাদের মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের নাম তো জানিস। আর এই মন্ত্রের
উপাস্য দেবতা আবার সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের কর্তা শিব- শম্ভু। স্বয়ং যম
একবার এই মন্ত্র জপকারী ঋষি মুকাণ্ডুর পুত্র, মার্কণ্ডেয়কে বিধির বিধান অনুযায়ী আনতে মৃত্যুকে পাঠালো। স্বয়ং শিব-শম্ভু, মুকাণ্ডুকে রক্ষা করে চলেছেন।মৃত্যুকে পাশ ছুড়তে দেখেই ক্রুদ্ধ হলেন পঞ্চানন; ভস্মীভূত হ’ল মৃত্যু—মৃত্যুর ঘটলো মৃত্য। অনেক টালবাহানার পর, শিব- শম্ভু, ব্রহ্মাকে কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে মৃত্যুকে জীবিত করতে আদেশ দিলেন। যম, শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পুজো করলেন, সেই লিঙ্গ যমেশ্বর লিঙ্গ বলে হল খ্যাত। আর মার্কণ্ডেয় ঐ মৃত্যুঞ্জয় মণ্ত্রে পেলেন অমরত্ব। এবার তোরা, নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখ, প্রত্যেক সেলের যেমন, মৃত্যু হচ্ছে, আবার একই রকম নতুন সেল জন্মাচ্ছে, পরে শূক্রানুর মাধ্যমে জীবন- ধারা প্রবাহিত হয়ে মৃত্যুঞ্জয় হচ্ছে, তাই তো আমরা অ-মৃতের সন্তান, আমাদের মৃত্যু হয় না, হয় কেবল রূপান্তর, আমরা রই মৃত্যুঞ্জয়।”