সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১৯)

শহরতলির ইতিকথা

১৯৫৯-৬০সাল,খাদ্য-আন্দোলনে সারা বাংলা উত্তাল;আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছে পঃ বাংলার বিভিন্ন কলেজের ছাত্রসমাজের এক বৃহৎ অংশ। রাজীবদের ,ঋষিবঙ্কিম কলেজের ছাত্ররা ঐ আন্দোলনে সক্রিয় অংশ করলো। আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুগত ছাত্র – ইউনিয়নগুলো। সব রাজনৈতিক দলই একটা করে ছাত্র -ফ্রন্ট খুলে রেখেছে;এই দলগুলো,ছাত্রদের সমস্যা সমাধানের দিকে ততটা নজর না দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ব্যস্ত। চললো বাস ট্রাম পোড়ানো;সরকার তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। বিরোধীরা বিরোধ করে,আর সরকার পক্ষ,সে বিরোধ বানচাল করতে চালায় পুলিশের ব্যাটন,তাতে কাজ না হলে চলে গুলি; পুলিশ তো বৃটিশের কাছ থেকে শেখা অভ্যেস, তখনও ভুলতে পারেনি; যতই হোক,বৃটিশ আমলের পুলিশ তো শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিল,বিশৃঙ্খলা তাদর কাছে ‘নৈব নৈব চ’; ফলস্বরূপ,পুলিশের গুলিতে নিহত হলো ছাত্র, আহত হলো অনেকেই। মৃত ছাত্র, নুরুল ও তার সাথীদের মৃতদেহ নিয়ে চললো বিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক ফায়দা তোলা।

রাজীব, ইউনিয়নের অ্যাসিসটন্ট-সেক্রেটারি হিসেবে,ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দিয়ে ঐ আন্দোলনে অংশ গ্রহন করার প্রস্তাব পাশ করিয়েছে।প্রতিদিন দশজন ছাত্রকে আন্দোলনে পাঠাবার ব্যবস্থা হলো। ঐ দশজন অংশকারীদের, কলেজের ছাত্রীরা কপালে চন্দনের তিলক এঁকে, শঙ্খধ্বনি ও আরতির মাধ্যমে তাদের শুভ কামনা জানিয়ে আন্দোলনে পাঠিয়েছে। অতীতে যুদ্ধ কালে, যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য যোদ্ধাদের একইভাবে শুড-কামনা জানিয়ে নীরাজন করার প্রথা ছিল।

দেশের রাজনীতির প্রতি রাজীব মোটেই আগ্রহী নয়; দেশের প্রধান সমস্যা জনস্ফীতি,সেটার উপর গুরুত্ব না দিয়ে,কেবল বহিরঙ্গে মালিশ করলে
যে অভাবরূপী ‘ঘোঘের’ সমাধান হয় না,সেটা সে নিজের জীবনচর্চা থেকে বুঝতে শিখেছে। বিরোধী দলগুলো বলে,মানুষ কেবল পেট নিয়ে জন্মায় না,দুটো হাতও থাকে,মানে সে উৎপাদনের অংশীদার হবে; আরে, সে তো সময় সাপেক্ষ;আগে ঐ পেটওয়ালা,জন-সম্পদে পরিণত হবে,তারপর তো —।না,সমাধান চায় না,জনগণের অভাবই তো ওদের মূলধন; চলুক অরাজকতা,চলুক ভাঙচুর,চলুক ট্রাম- বাস পোড়ানো;হোক মানুষের পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি ব্যাহত।ছাত্রদের সমস্যার সমাধানের পথে না গিয়ে,সরকারও দমন নীতি নিয়েছে,তাই রাজীব, এ আন্দোলনের অংশীদার;বিরোধীদলগুলো,ছাত্র সমস্যার সঙ্গে নিজেদের এজেণ্ডা জুড়ে
দিয়ে,ছাত্রদের আন্দোলনের পুরোভাগে
ঠেলে দিয়েছে; মরবে কে নিরীহ ছাত্র, আর ওদের লাশ নিয়ে চলবে রাজনীতি,ছিঃ!
ছাত্র-রাজনীতির আসল রূপটা তার কাছে স্পষ্ট হলো,আর সে ও রমিত হয়ে গেল সম্পূর্ণরূপে নিস্পৃয়।কলেজে পড়তে আসা,এটাই হোক,এখন তাদের একমাত্র পাখির চোখ ।

নাঃ! সবার চিন্তা তো এক রকম হয় না; সবাই যুক্তি দিয়ে বিশ্লষন করে না; অধিকাংশই, ভাবাবেগে চালিত হয়; অনেকে,রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে অথবা লায়লা-মজনুর প্রেম-কাহিনীর ঘুল-ঘুলাইয়ায় পথ হারায়ে,আপনাতেই হয় আপনি বিভোর।

ভালো! নির্ঝঞ্ঝাট! তাই কী কখনো হয়! কলেজের সামনে রেলের মাঠে রাজীব ও রমিত আসন্ন ফাইন্যাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করছে;এমন সময় নৈহাটির দিক থেকে কতকগুলো ছেলে এসে ‘রিনা-ব্রাউনের’ কথা পাড়লো,এবং রাজীবকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলো।রাজীব, শান্ত ভাবে শুনে,কিছু না বলে লজিক ক্লাসে,প্রিন্সিপাল মশাই’র উক্তিটা উদ্ধৃত করলো–” দ্যাহ,
ওদিকে তাকাইবা না,ঐগুলা দেখবো পরে, তোমাগো খুড়-শাশুড়ী,মাস-শাশুড়ী,মামী শাশুড়ী হইব,মনে রাইখবা”।
রাজীব বলে,”আমি তো স্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি”। রাজীবের কথা শুনে,ছেলেগুলো হাসি না চাপতে পেরে,রাজীবের পিঠ চাপড়ে চলে গেল। রাজীব-রমিত ভাবে,কী হুজ্জুত রে বাবা!

দেশ ভাগ করে, সমঝোতায় স্বাধীনতা পেয়ে,জহরলালজী দেশের প্রধান মন্ত্রী হয়েছেন;ঐ স্বাধীনতার বলি হল বাংলা আর পাঞ্জাব। বাংলার মানুষ হলো বাস্তুচ্যুত,হোল উদ্বাস্ত;পঃবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানবাবু,তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও বিচক্ষনতায়,সব সমস্যার সমাধান করতে বদ্ধপরিকর; কেন্দ্রের কাছ থেকে সব রকম সাহায্য আদায় করে, তিনি পঃবাংলাকে আবার গড়তে,হত-ভাগ্য বাঙালিকে আবার পুনরুদ্ধারে তৎপর হয়েছেন। চাইলে হবে কী!দেশের ভেতরের শত্রু বা বাঙলার বাইরে,অন্য প্রদেশের লোকে,বাংলাকে দেওয়া
বিশেষ সুবিধা সহ্য করবে কেন,আবার বিধানবাবুর সামনে কিছু বলার সাহস নেই, তবে,বাঙালিকে দিয়েই বাংলার উন্নয়ন আটকানো শুরু হলো,হতে পারে,বিরোধীদের সঙ্গে গোপন কোনো সমজোতা,হাজার হোক,’মিরজাফর,উঁমিচাঁদরা’ তো বাংলারই লোক ছিল। বিধানবাবু, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সরকারী বাসের ব্যবস্থা করলেন;খাদ্যের জন্য রেশন তো চালু ছিলই;ধীরে,ধীরে সব সমস্যা সমাধান চলছে; উদ্বাস্ত সমাধানের জন্য, অন্য প্রদেশের জমি নিয়ে চলছে দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্ট;তো সেই , সেই প্রদেশ যে বিধানবাবুর কাজে বাধা দেবে,উন্নয়ন প্রচেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটাতে উন্মুখ হবে, এ তে আর আশ্চর্য কী!এ তো স্বাভাবিক, ভারত এক দেশ,এক জাতি,এক প্রাণ, না!

রাজীব,যে ছাত্রদলের হয়ে নির্বাচিত হয়েছে,ঐ দলের প্রধান রাজনৈতিক দল, আবার এই আন্দোলনের বিপক্ষে,সুতরাং,রাজীবের সংগে হলো বিচ্ছেদ, ছাড়াছাড়ি; শাপে বর হলো,রাজীবও রমিত, মন দিয়ে এবার নিজেদের অভিষ্ট অভিমুখী হবার সুযোগ পেল–বিদায় ছাত্র-রাজনীতি।

————–
চলবে———

উজ্জ্বল কুমার মল্লিক

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *