সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১৪)

শহরতলির ইতিকথা
রাজীবদের স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা
শেষ হয়েছে। রমা এবারও পরীক্ষায় বসেছে।ফল বের হতে প্রায় আড়াই মাস মত সময় লাগে। এসময়টা, সব পরীক্ষার্থীই একটা রিলাক্স মুডে থাকে; না, রাজীবকে, এসময়টাকে কাজে লাগাতে হবে; সকাল-সন্ধ্যে সে দুটো বাড়িতে গিয়ে ছাত্র পড়ায়; কলেজে পড়ার পাথেয় সংগ্রহ করে রাখছে। বেলা একটু চড়তেই, পাড়ার ছেলেদের সাথে চলে গঙ্গার বুকে দাপাদপি; সাঁতার কেটে দূরের চড়ায় যাওয়া; হ্যাঁ এই চড়াতেই সমরেশবাবুর ‘গঙ্গা’ বই’র সিনে
মার সুটিং হয়েছিল; জাল উপরে ফেলা, মারামারি-হাতাহাতির দৃশ্যগুলো এ চড়াতেই নেওয়া হয়েছিল। তখন, ভাটার সময় চড়া জেগে উঠতো, জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসে আবার থাকতো জলে ডোবা। রাজীবদের দল ভাটার টানে যেত চড়ায়, আবার জোয়ারের সময ছিল, নিজেদের গঙ্গার ঘাটে ফেরা। পাড়ার ছেলেদের মধ্যে, অশোক বলে একজন ছিল, মোটামোটি বলিষ্ঠ চেহারা,পরে সে ভারোত্তলে মিঃ ইন্ডিয়া হয়; সে সাঁতার জানতো না, হাঁটু সমান জলেতেই চান সারতো; গঙ্গার কাদায় সে শুয়ে থাকলে, জাম্প দিয়ে তার পেটের ওপর মাথা রেখে ছিল ভল্ট খাওয়া, সে এক অনন্য দৃশ্য, কাদা মেখে সবাই তখন এক একজন শ্মশানচারী।
ও পাড়ার একজনকে প্রায় সময়ই
মাঝ-গঙ্গায় সাঁতার কাটতে দেখা যেত, স্রোতের বিপরীতে সে প্রায় সময়ই সাঁতারে থাকতো। সাঁতারে বেঙ্গল-চাম্পিয়ান হওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করেছে, আরও অন্য প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
এ অঞ্চলে, এ সময়কালের আগে খুব একটা সাঁতার শেখার প্রবণতা ছিল না। কিছুদিন আগে, বিখ্যাত সাঁতারু মিহির সেন মশাই, সস্ত্রীক, এ অঞ্চলের গড়-বাড়ির ভিতরে, ঠিক হংশ্বেশ্বরী মন্দিরের সামনে থাকা বাগানের পুকুরে সাঁতার প্রদর্শন করেন; রাজীবও তার সহপাঠিরা টিকেট কেটে সে সাঁতার প্রদর্শন দেখেছে; একটা বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাদের অর্থ সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই উদ্যোক্তারা, এ সাঁতার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। তারপর থেকেই, এ অঞ্চলে সাঁতার শিখে,বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার হিড়িক পরে যায়।
স্কুল-ফাইন্যাল পরীক্ষার ফলের গেজেট বেড়িয়েছে; কোলকাতা থেকে ট্রেনে এ অঞ্চলের স্টেশন চত্বরে এসে পৌঁছেছে। রাজীবও অন্যরা খুব টেনশনে থাকা অবস্থায়, রোল নং বলে, নিজেদের ফল জেনে এসেছে। রাজীব খুব ভালো ফল করেছে;পাড়ার একটা মেয়েও ভালো ফল করেছে । না, নিজেদের বাড়িতে কোনও উচ্ছ্বাস তারা দেখায়নি; রমা, এবার কমপার্টমেন্টাল পেয়েছে, মানে কয়েকমাস পরে, ঐ বিষয়ে পরীক্ষায় বসে পাস করতে হবে। পাড়ার দাদার কাছে যারা পড়তো, সবাই উৎরে গেছে। এবার, কলেজে ভর্তির জন্য ফর্ম ফিলাপে সবাই তৎপর। জেলার নামকরা সরকারী কলেজ, মহসিন কলেজে, সবাই হাজির। কলেজের মেন বিল্ডিং’র দোতলায় ওঠার জন্য, ভিতরে গ্রাউন্ড-ফ্লোর থেকে দুদিকে, উত্তর ও দক্ষিনে রয়েছে কাঠের সিঁড়ি; উঠলেই ধপ ধপ করে শব্দ ওঠে। রাজীব উত্তর দিক দিয়ে ওঠে দক্ষিন দিয়ে নামে; আবার উত্তর দিয়ে ওঠে।প্রতিটি পায়ের শব্দে সে যেন ঋষি বঙ্কিমের পদধ্বনি শুনতে পায়। মনে মনে ‘আনন্দমঠ’ স্রষ্টার স্মরণ করে। দোতলায়, কাউন্টার থেকে I.Aও I.Scতে ভর্তি হবার দুটৌ ফর্ম নিয়ে দোতলার হলের বড় বড় গোল থামগুলোকে জড়িয়ে ধরে, মহাপুরুষদের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করে, না, কয়েকদিন আগেই হয়তো ডিডিটি স্প্রে করা হয়েছে, ডিডিটির উগ্র গন্ধটাই নাকে আসছে । মনে মনে সে প্রথম গ্রাজুয়েটদের স্পর্শ পায়, একটা অব্যক্ত শিহরন বহে যায় তার শরীরে। ফেরার পথে শোনে, কলেজের গ্রাউন্ডে একটা খবর নিয়ে আলোচনা চলছে; গঙ্গার পশ্চিম পারের কলেজগুলো সব নতুন ইউনিভার্সিটির মধ্যে চলে যাবে। কোলকাতার পর এই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠত হলে, এসব কলেজ চলে যাবে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। এ খবরে অনেকেই গঙ্গার ওপাড়ের কলেজে ভর্তি হতে চাইছে, ওপার রয়েছে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে।রাজীব বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই বাড়ি ফিরে এল। নাঃ, ওপারের কলেজ থেকেও ফর্ম তুলতে হবে।
(চলবে)