ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ৪৮)

আলাপ

কত্থকে যেমন গুরু বিরজু মহারাজ, ওড়িশী নাচে যেমন গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র, তেমনই মণিপুরী নাচে গুরু বিপিন সিং। আরো তো বহু গুরু আছেন। তাহলে এই নৃত্যের প্রসঙ্গ উঠলেই এই গুরুদের কথা উঠে আসে কেন? তার প্রধাণ কারণ হল তাঁদের অসাধারণ অবদান, যা নৃত্যগুলিকে প্রকৃত শাস্ত্রীয় নৃত্যের সম্মান দিয়েছে, বহুগুণ প্রসার ঘটিয়েছে নৃত্যপ্রকরণের এবং নৃত্যগুলিকে নিজস্ব অঞ্চলের বাইরে গোটা ভারতবর্ষে এবং দেশের বাইরে জনপ্রিয় করেছে। এঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত সৃষ্টিশীল। শুধু যে নিজেরা নৃত্যের উৎকর্ষের চূড়ায় পৌঁছেছেন তাই নয়, বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, নতুন নতুন কোরিওগ্রাফি ও কাহিনী প্রয়োগ করেছেন, নতুনত্ব এনেছেন, যুগোপযোগী করেছেন নৃত্যগুলিকে, মন্দিরের বাইরে নৃত্যমঞ্চে নিয়ে এসেছেন নাচগুলিকে এবং সর্বোপরি তৈরী করেছেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে যাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ বিখ্যাত শিল্পী! এইসব কারণেই এই নৃত্যগুরুগণ প্রণম্য।
প্রথমেই অল্প করে বলে নিই মণিপুরী নৃত্যে গুরু বিপিন সিং এর কথা। ১৯১৮ সালে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পরিবারে মণিপুরী সংস্কৃতির চর্চা ছিল বহু আগে থেকে। তাঁর পিতামহ পি টোনা সিং একজন মণিপুরী পুরোহিত ছিলেন। বাবা লাইখোমসানা সিং ছিলেন কবি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। এবং মা ইন্দুবালা দেবী ছিলেন গায়িকা। তাই নৃত্যগীত তাঁর রক্তেই ছিল। ছোটবেলায় পড়াশুনায় তাঁর মন ছিল না। বরং আসপাশের কাছাড়, সিলেট ও ত্রিপুরার বিভিন্ন মণিপুরী নৃত্যবিশারদদের কাছে নাচ শেখায় ছিল বিশেষ আগ্রহ। মণিপুরের তৎকালীন রাজাদের এই নৃত্য শিক্ষা ও প্রসারে বিশেষ আগ্রহ ছিল। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি গুরু আমুদন শর্মার কাছে নৃত্য শিক্ষা শুরু করেন। ছেলের এতো উৎসাহ দেখে তাঁর বাবা পরিবারে অভাব সত্ত্বেও তাঁর নৃত্য শিক্ষা চালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অচিরেই তিনি এই নাচে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। কিন্তু পড়াশুনা একেবারে না করায়, একদিন বাবার সঙ্গে প্রবল বচসা ও মারামারি হয় এবং তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনি নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতেও বিশেষ দক্ষ ছিলেন। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে তিনি কলকাতায় এসে পৌঁছান। তিনি জানতেন কলকাতা গানের কদর করে। এখানে এসে তিনি মেগাফোন এবং অন্য একটি রেকর্ড কোম্পানী থেকে গান রেকর্ডিং ও রিলিজের সুযোগও পান। কিন্তু কলকাতায় যে শাস্ত্রীয় নৃত্য, বিশেষ করে মণিপুরী নাচের এতো জনপ্রিয়তা, তা দেখে তিনি অবাক হন এবং জানতে পারেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীই এই জনপ্রিয়তার জন্য দায়ী। তিনি তো এই নাচের বিশারদ ছিলেনই তখন তিনি গান ছেড়ে নৃত্যে মনোনিবেশ করেন। মঞ্চে বিভিন্ন স্থানে বহু জায়গায় নৃত্যপ্রদর্শন করে সুনাম অর্জন করেন গুরু বিপিন সিং। এরপর তিনি মণিপুরী নৃত্যশিক্ষাদান শুরু করেন এবং তাঁর প্রথম দিককার ছাত্রী কলাবতী দেবীর সঙ্গে কলকাতায় “মণিপুরী নর্তনালয়” নামে মণিপুরী নৃত্যশিক্ষালয় স্থাপন
এ ছাড়াও মণিপুরে তিনি “গোবিন্দজী নর্তনালয়” স্থাপন করেন, যেখানে শুধু মেয়েরাই নাচ শেখেন।
তিনি মণিপুরী নৃত্যকে নানাভাবে পরিবর্তিত ও যুগোপযোগী করেন। আগে মণিপরী নাচকে লোকনৃত্য বলা হত। কিন্তু তিনি এই নাচে শাস্ত্রীয় অঙ্গগুলি খুঁজে বার করে একত্রিত করেন, যার ফলে এটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের মর্যাদা পায়। সংস্কৃত শ্লোক এবং বিদ্যাপতি জয়দেব ও চন্ডিদাসের বহু রচনার ওপর নির্ভর করে তিনি মণিপুরী নাচে নতুন নতুন কোরিওগ্রাফি নির্মাণ করেন। আগে মণিপুরী মূলতঃ দলগত নৃত্য ছিল। তিনি একক নৃত্যের প্রবর্তন করেন। মন্দিরে রাসনৃত্যগুলি হত দীর্ঘ সময় ধরে। সন্ধ্যায় শুরু হয় পরদিন ভোরে শেষ হত। মানুষ ভক্তিভরে সেই নৃত্য দেখত। কিন্তু আধুনিক মানুষের হাতে অত সময় নেই। তাঁরা স্বল্প সময়ের বিনোদনের জন্য মঞ্চে নৃত্য দেখতে যায়। সেই অনুযায়ী তিনি এই নাচের কী কী অঙ্গ দেখালে তা মানুষকে আকৃষ্ট করবে অথচ নাচের মূল শাস্ত্রীয় অঙ্গের কোন হানি হবে না, সেই অনুযায়ী রাস নৃত্যকে ছোট করে আধ ঘন্টা বা একঘন্টায় নিয়ে আসেন। আগে মণিপুরী নাচে অন্য শাস্ত্রীয় নাচের মত বিভিন্ন ভাগ, যেমন ভারতনাট্যমে আলারিপু, জাতিস্বরম বা তিলান্না, এমন ছিল না। গুরুবন্দনা, দর্শক অভিবাদন, যন্ত্রানুসঙ্গে ও তালবাদ্যের সঙ্গে হস্তপদ মুদ্রার সহযোগে বিশুদ্ধ নৃত্য অথবা নাট্যাংশ শুধু অভিনয় দিয়ে দেখানো হবে এমন বিভাগ ছিল না। তিনি এই বিভাগ গুলি এনে নৃত্যকে কয়েকটি অঙ্গে বা অংশে প্রদর্শন করেন। মণিপুরী নাচের বিস্ময় উদ্রেককারী রণনৃত্য বা মার্শাল আর্ট এবং ঢোল সহযোগে সমবেত পুরুষ নৃত্যকে তুলে আনেন রাস বা এই ধরণের সুমিষ্ট ধর্মীয় নৃত্যের পাশাপাশি। নৃত্যনাট্যের আঙ্গিকে নির্মিত নাচের মধ্য থেকে তিনি এক একটি একক নৃত্যাংশ তুলে এনে তাকে নতুন করে কম্পোস করে সম্পূর্ণতা দেন এবং মণিপুরী একক নৃত্যের সুললিত স্টাইল তৈরি করেন। তিনি তাঁর গবেষণা সমন্বিত গ্রন্থও রচনা করেন। এই কাজে তিনি তাঁর প্রথম দিককার ছাত্রী কলাবতী দেবী ও দর্শনা জাভেরী সহ জাভেরী সিস্টার্সদের পাশে পান।
মণিপুরী নৃত্যকে এক নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ও এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করার জন্য তিনি বহু সম্মান লাভ করেন। তার মধ্যে আছে মহারাজা অফ মণিপুরের দেওয়া নৃত্যাচার্য সম্মান, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কার, উদয়শংকর ফেলোশিপ, মধ্যপ্রদেশ থেকে কালিদাস সম্মান, কলকাতায় অনামিকা কলাসঙ্গম পুরস্কার, শিরোমণি পুরস্কার, সুরশৃঙ্গার সংসদ প্রদত্ত সারংদেব ফেলোশিপ ইত্যাদি। এতো নাম এবং সম্মান সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সহজ সরল মাটির মানুষ। আমি তার রাসনৃত্য দেখি দূরদর্শনে। কলাবতী দেবী সেজেছিলেন রাধা এবং তিনি কৃষ্ণ। সেই নাচের লালিত্য এবং নৃত্যকলা ভুলে যাওয়ার নয়।
এবার আসি আধুনিক মণিপুরী নাচে যাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং মণিপুরী নাচকে নতুন করে ভালবেসে ফেলেছিলাম তার কথায়। সেবার আমি মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহে। উদ্দেশ্য দিনের বেলা খাজুরাহের অপূর্ব মন্দির দর্শন আর সন্ধেবেলা খাজুরাহো ডান্স ফেস্টিভ্যাল দর্শন। পিছনে মন্দিরকে রেখে মন্দিরের সামনের মাঠে বিশাল স্টেজ করে খোলা আকাশের নীচে নৃত্য প্রদর্শন! এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়, চারিদিকের পরিবেশ দেখে। মন্দিরগুলির গায়ে রিফ্লেক্টেড আলো যেন নতুন ডাইমেনশন নিয়ে আসে! সামনে বিশাল স্টেজে ভারতের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীদের নাচ – সে যেন কোন প্রাচীন যুগে নিয়ে যায় মনকে! মন্দিরগাত্রের শৃঙ্গার রসসমৃদ্ধ দেহভঙ্গিমাগুলি যেন তাঁদের নৃত্যভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। সেদিন সোনাল মান সিং এর ওড়িশী নাচের পরই ছিল প্রীতি প্যাটেল ও তার গ্রুপের নাচ! প্রীতি প্যাটেল ও শ্রুতি ব্যানার্জীর নাচ তার আগে আমি দূরদর্শনে দেখেছি। যৌথ রাসলীলার সৌকর্যে সমৃদ্ধ সে নাচ। কিন্তু জানতাম না সেইদিন কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য! যেমন আগে বলেছি, কথিত আছে, সূর্যের কন্যা বাঁ ভগিনী ঊষা নাকি মণিপুরী মহিলাদের প্রথম এই নাচ শিখিয়েছিলেন। তাই মণিপুরী নাচে সূর্যবন্দনা একটি বিশেষ অঙ্গ। কিন্তু সেদিন প্রীতি প্যাটেল ও তার গ্রুপের সূর্যপ্রণাম এবং সূর্যের সাতরঙ নামের অনুষ্ঠান যে কী দর্শনীয় বস্তু ছিল তা যারা সে নাচ না দেখেছেন তাঁদের বোঝানো যায় না। প্রথমে স্টেজে মিড কার্টেন টানা। তার সামনে সাদা ধুতি ও পাগড়ী পরিহিত পুরুষ নর্তকেরা ঢোল বাজিয়ে লাফিয়ে ঘুরে ঘুরে অসাধারণ নাচলেন! এরপর মিড কার্টেন সরে গেল। স্টেজে পাহাড়ের মত একটি সেট তৈরি হয়েছিল। তার থেকে ঝরণা নেমেছে। প্রথমেই হালকা লাল আলোয় পাহাড়ের পিছনে সূর্যোদয় বুঝিয়ে আহীর ভায়রোঁর সুর বাঁশীতে!। পিছনে সূর্যের গঠনের সোনার মুকুট পরে এক নর্তকের প্রবেশ! তার সঙ্গে একদল নর্তক, যাঁদের হাতে ঝকঝকে বর্শার মতো অস্ত্র ঝিকিয়ে উঠেছে! ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে নেমে এলো তারা! সূর্যের প্রহরীরা। তাঁদের খোলা বক্ষে এসে পড়েছে আলো! পরণে কালো ধুতি! কপালে চন্দন!  আস্তে আস্তে আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাড়ানাকাড়া বেজে উঠলো। অসাধারণ পদচারণা ও নৃত্যের সঙ্গে শুরু হল মার্শাল আর্টের ধরণে অস্ত্রসঞ্চালনা। নৃত্যের মধ্যে এমন উল্লম্ফন, ঘূর্ণন, মাটিতে বসে পড়ে দ্রুত গোটা স্টেজ জুড়ে ঘুরে যাওয়া! দর্শক হৃদপিন্ড হাতে চেপে ধরে যেন হাঁ হয়ে দেখছেন সেই নাচ! খানিকক্ষণ সে নাচ চলার পর সূর্যদেব নিজে নৃত্য শুরু করলেন!  দেখি, তিনি আর কেউ নন, প্রীতি প্যাটেল! পুরুষরূপে তাঁকে চেনা দায়! উজ্জ্বল ফর্সা মুখে রক্তচ্ছটা! হাতে মোটা
সোনার বালা! পরণে কালো ভেলভেটের আঁটা পোষাকের ওপর কোমর পর্যন্ত ললন্তিকা! মোটা কোমরবন্ধের নীচে লাল ধুতি! মাথার পিছনে বিশাল লম্বা পালক! কপালে রক্ত তিলক! অতি দ্রুত পদক্ষেপে, নানা যোগমুদ্রা সহযোগে, কখনো পাহাড়ে উঠে কখনো নেমে, সেই উদ্দাম নৃত্য আজও ভুলতে পারিনি! প্রীতির সৌন্দর্য যেন আরো অপরূপ করে তুলেছিল সেই নাচ! এরপর সূর্যের এক এক রঙের ওপর এক একটি অংশ গীতবাদ্য সহযোগে। নীল রঙের একটি বিশেষত্ব, বেগুনী রশ্মির আর একটি এমন ভাবে ভিবজিয়রের প্রতিটি রঙ নৃত্যে রঙিন হয়ে উঠল! সবশেষে সূর্যের রথে আসীন হয়ে মঞ্চ ত্যাগ করলেন। একটি সম্পূর্ন নাটিকা। আজ আর পুরো গল্পটি মনে নেই। তবে এমন কোরিওগ্রাফির নতুনত্ব, এমন অসাধারণ নাচ, একক এবং দলগত কত পরিশ্রমের ফল সেদিন বুঝেছিলাম। সেই থেকে আমার অন্যতম প্রিয় নৃত্যশিল্পী প্রীতি প্যাটেল।
প্রীতি প্যাটেল তার গুরু বিপিন সিং এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন যে গুরুজী নিজে দীর্ঘদিন তাঁকে শেখাতে তার বাড়িতে আসতেন। অত সম্মানীয় একজন গুরু, কিন্তু তার এতোটুকু অহংকার ছিল না। মাটির মানুষ ছিলেন। তার প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে তাঁরা যতই ভাল নাচুক, তিনি মুখে কখনো তাঁদের ভাল বলতেন না। অথচ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বলতেন “বাঃ, বেশ নেচেছ তো!”। প্রীতি কঠোর পরিশ্রমে এক একটি নাচ তুলতেন, কিন্তু গুরুর মুখে কখনো ভাল শুনতে পেতেন না। বেশ অভিমান হত তার। আজ বুঝতে পারেন তাঁকে গড়ে তোলার জন্যই গুরুজী এমন করতেন। যতক্ষণ না নিখুঁত হচ্ছে, করে চলতে হত একটি পদক্ষেপ বা একটি মুদ্রা। প্রিয় ছাত্রীর জন্য অনেক নতুন কোরিওগ্রাফিও তৈরী করতেন গুরু বিপিন সিং।
১৯৬০ সালে জন্ম হয় প্রীতি প্যাটেলের। গুরু বিপিন সিং ছাড়াও জাভেরী সিস্টার্স, বিশেষ করে দর্শনা জাভেরীর কাছে দীর্ঘদিন শেখেন প্রীতি। তাঁদের কাছে মূলত বৈষ্ণব রসসমৃদ্ধ সংকীর্তন ও রাসলীলা ধারাগুলিতে শিক্ষা লাভ করার পর অন্য ধারাগুলি যেগুলিতে বৈষ্ণব পূর্ববর্তী শাক্ত বাঁ শৈব মতের প্রকাশ এবং আদিবাসী লোকনৃত্যের বা যুদ্ধবিদ্যার প্রভাব আছে, সেই লাই হারবা, বা থাং-তা শেখেন যথাক্রমে ওঝা কুমার মাইবি এবং পদ্মশ্রী গুরু খেলচরণ সিং এর কাছে।
বিখ্যাত মণিপুরী পন্ডিত ও সাহিত্যিক পদ্মশ্রী মহারাজকুমারী বিনোদিনী দেবী, প্রীতি প্যাটেলকে মণিপুরী নাচের উৎস, ইতিহাস, গুরুত্ব ও এই নৃত্যের সংস্কৃতি ও সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে অনেক তথ্য দেন।
প্রীতি প্যাটেলই প্রথম মণিপুরী নৃত্যবিশারদ, যিনি মণিপুরী নাচের চারটি ধারা, থাং-তা, লাই হারবা, সংকীর্তন ও রাসলীলাকে একসঙ্গে নিয়ে এসে অসাধারণ কাজ
করেছেন। তার কয়েকটি বিখ্যাত কাজ হল “চিত্রা – দ্য প্রিনসেস অফ মণিপুর”, যেটি ২০০০ সালে উদয়শংকর পুরস্কার পায়, “ক্ষীতিশ – দ্য হরাইজন”, যেটি ২০০০ সালেই মৃণালিনী সারাভাই পুরস্কার পায়, “অগ্নি – দ্য স্যাক্রেড ফায়ার”, “দ্য থ্রো অফ ডাইস”, যেটি প্রায় বিলুপ্ত গল্প বলা ধারা বা ওয়ারি-লিবা প্রয়োগ করে করা । একটি ব্যতিক্রমী কোরিওগ্রাফি ছিল “দ্য ব্ল্যাক সান অ্যান্ড নংথাং লিমা”, যেটি মণিপুরী কবিতা ও শ্রুতি নির্ভর এবং যাতে মণিপুরের বর্তমান অশান্তির কথা আছে। “ইয়াইফাবি – দ্য ব্লেসেড” নাচটি কলাক্ষেত্রে ও মিনিস্ট্রি অফ কালচারে দেখানো হয়। প্রথমবার লাই হারাওবা মণিপুরের বাইরে তিনিই পারফর্ম করেন।
প্রীতি প্যাটেল নৃত্যে এবং মুভমেন্ট থেরাপির ওপর বোস্টনের লেসলি কলেজ থেকে বিশেষ শিক্ষালাভ করেন এবং ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সেরিব্রাল পালসির সঙ্গে একযোগে বিশেষ শিশুদের জন্য কাজ শুরু করেন।
১৯৯৫ সালে তিনি কলকাতায় তার নাচের স্কুল “অঞ্জিকা” প্রতিষ্ঠা করেন। বিশুদ্ধ মণিপুরী নাচকে বাঁচিয়ে রাখা ও তার আরো প্রসারই এই স্কুলের উদ্দেশ্য। অঞ্জিকা বিশেষ শিশুদের নিয়েও মুভমেন্ট থেরাপির সাহায্যে কাজ করে। যাঁদের মোটর নার্ভের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, সেই সব শিশুদের হাত পায়ের নড়াচড়া স্বাভাবিক করতে এই থেরাপি খুবই কাজ করে। যেহেতু মণিপুরী নাচের একটি ধারায় ধীর, কোমল, লালিত্যপূর্ণ নৃত্য করা হয়, তাই বিশেষ শিশুরা ধীরে ধীরে হাত পা নাড়িয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। প্রীতির এক ছাত্র সূর্যশেখর বসু, যিনি ডাউন’স সিন্ড্রোমে ভুগতেন, তিনি এই নাচ করে “শ্রী উমেদভাই প্যাটেল” পুরস্কারও পান।

প্রীতি প্যাটেল দেশ ও বিদেশের নানা বিখ্যাত মঞ্চে নৃত্য প্রদর্শন করেছেন এবং মণিপুরী নাচ সম্পর্কে খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনে বহুবার লিখেছেন এবং তার কাজের জন্য অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।