ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ৩৯)

আলাপ

তবলার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বলেছিলাম তবলার ছয়টি মূল ঘরানার কথা। এগুলি হলো দিল্লি, আজরার, ফারুখাবাদ, লক্ষ্ণৌ, বেনারস এবং পাঞ্জাব ঘরানা। এর মধ্যে দিল্লি ও আজরার ঘরানার বাজকে বলা হয় পশ্চিমী অঙ্গের বাজ, যেখানে মূলত ডাঁয়া বা তবলা যেটি ডান হাতে বাজানো হয় তার প্রাধান্য এবং তর্জনী ও মধ্যমা অর্থাৎ দুটি আঙ্গুল দিয়ে ছোট ছোট কায়দা, টুকরা, গৎ, মোহর, মুখড়া, রেলা ইত্যাদি বাজানো হয় মূলত তবলার কাণি বা চাঁটি অঞ্চলে আঘাত করে। ফলে এই দুই ঘরানার তবলার আওয়াজ হালকা ও মিঠে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে তবলা ডাঁয়ার চামড়ার মুখটিতে অর্থাৎ যেটিকে বাজানো হয়, তার তিনটি কনসেনট্রিক সারকুলার অংশ। একেবারে বাইরে কাণি বা চাঁটি, তারপর সুর এবং একেবারে ভিতরে বা মাঝখানে কালো বৃত্তটিকে বলা হয় গাব। তবে আজরারা ঘরানায় তবলার সঙ্গে সঙ্গে বাঁয়া বা ডুগির কাজও করা হয় এবং আড়ি লয় ব্যবহার হয়।
ফারুখাবাদ ও লক্ষ্ণৌ ঘরানার বাজকে বলা হয় পূরব অঙ্গের বাজ। এতে দুটি আঙ্গুল দিয়ে কাণিতে বা চাঁটিতে আঘাত ছাড়াও হাতের তালু ও অন্যান্য আঙ্গুল সহযোগে বা হাতের থাবা দিয়ে সুর ও গাবে আঘাত করে বিভিন্ন শব্দ ও কায়দার উৎপত্তি করা হয়। এই ঘরানাগুলিতে লম্বা লম্বা কায়দা, টুকরা, গৎ, চক্রধার ইত্যাদি সবই বাজানো হয়। এই দুটি ঘরানায় কিছু কত্থক নাচের বোলও ব্যবহার হয়। এতে এই দুই ঘরানার বাজ আরো আকর্ষণীয় হয়েছে।
বেনারস ঘরানার বাজ খানিকটা পূরব অঙ্গ এবং খানিকটা পাখোয়াজের বাজ নিয়ে তৈরী। এই ঘরানায় কায়দা, টুকরা ইত্যাদির জায়গায় ছন্দ, পরণ ইত্যাদিতে বেশী জোর দেওয়া হয়।
এদের সবার চেয়ে আলাদা হলো পাঞ্জাব ঘরানার বাজ। এতে পুরোপুরি পাখোয়াজের বাজকেই একটু চেপে বা বন্ধ করে বাজানো হয়। তাই পাখোয়াজের সব বৈশিষ্ট অর্থাৎ জোরালো আওয়াজ, লম্বা লম্বা গৎ, কায়দা, বোল, চক্রধার, লয়কারী, তেহাই সবই এই ঘরানায় ব্যবহার হয়। এই ঘরানার কিছু বিখ্যাত বোল হলো ঘিরতক, ধুগ ধুগ, নগ, করতান, ধির তা, ধির না ইত্যাদি যার মধ্যে তবলার সঙ্গে সঙ্গে বাঁয়ার ব্যবহারে জোরালো আওয়াজ নিয়ে আসা হয়।
আমরা তবলার সবচেয়ে খ্যাতনামা বা বিখ্যাত শিল্পীদের দিকে তাকালে দেখবো তাঁরা মূলতঃ ফারুখাবাদ, বেনারস ও পাঞ্জাব ঘরানার। তাই এই তিনটি বিভিন্ন ঘরানার কথা বিশদে লিখবো। এর মধ্যে ফারুখাবাদ ঘরানার কথা আগেই বলেছি। এবার আসি পাঞ্জাব ঘরানার কথায়।
পাঞ্জাব ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা হলেন লাল ভবানীদাস। এই ঘরানার বিখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে আছেন মিয়াঁ কাদেরবক্স, মিয়াঁ হাদ্দু খান, মিয়াঁ শওকত হোসেন, আলতাফ হোসেন ইত্যাদি। তবে ঘরানাটিকে পৃথিবী বিখ্যাত করেছেন যাঁরা তাঁরা হলেন পিতা ও পুত্র উস্তাদ আল্লারাখা খান এবং উস্তাদ জাকির হুসেন। তাই পাঞ্জাব ঘরানার এই দুই শিল্পীর কথা না বললে তবলার কথা অসম্পূর্ণ থাকবে।
উস্তাদ আল্লারাখা খান কুরেশীর জন্ম ১৯১৯ সালে জম্মু কাশ্মীরে। তিনি ডোগরা সম্প্রদায়ের মুসলিম ছিলেন। তাঁর বাবার বিরাট খামার ছিলো। খুব ছোটবেলা থেকেই গান বাজনা বড়ো ভালোবাসতেন আল্লারাখা। ভবঘুরে সম্প্রদায়ের গায়করা যখন রাস্তা দিয়ে গেয়ে বাজিয়ে যেতো, তিনি তাদের পিছু নিতেন। তাঁর বাবা একেবারেই চাইতেন না যে ছেলে সন্তান হয়ে তিনি গান বাজনা শিখে বা বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করুন। তবলা বাজানোকে বিশেষতঃ ছোট করে দেখা হতো তাদের গ্রামে। সঙ্গীতপাগল বালক আল্লারাখা প্রথমে বাড়ি থেকে পালিয়ে লাহোরে কাকার কাছে চলে যান। কিন্তু সেখানেও শেখার সুযোগ না পেয়ে বারো বছর বয়সে পালিয়ে অবশেষে পাঞ্জাবের গুরদাসপুরে এসে পৌঁছন এবং পাঞ্জাব ঘরানার উস্তাদ মিয়াঁ কাদেরবক্সের কাছে পাঞ্জাব ঘরানায় তাঁর তবলা শিক্ষা শুরু হয়। কাদেরবক্সের কোন সন্তান ছিলো না। তিনি আল্লারাখাকে দত্তক নেন। ছোটবেলা থেকে দীর্ঘদিন অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কঠিন রেওয়াজ করতেন আল্লারাখা, যার ফল তিনি ভবিষ্যতে পেয়েছিলেন। এক নতুন সৌরভ ফুটে উঠলো তাঁর তবলাবাদনে। পাতিয়ালা ঘরানার উস্তাদ আশিক আলির কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিমও নেন।
লাহোরে তবলা সঙ্গত করে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর ১৯৩৬ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে বাজানো শুরু করেন আল্লারাখা। ১৯৪০ সালে তিনি মুম্বইতে যান এবং সেখানে রেডিওতে প্রথম একক লহরা বাজিয়ে সবাইকে চমকে দেন। তিনি এ আর কুরেশী নামে অনেকগুলি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে প্রায় ২৩ টি সিনেমায় সুর দেন। মুম্বইতেই পন্ডিত রবিশংকরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয় এবং তিনি আল্লারাখার তবলায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে স্থায়ীভাবে তাঁর সঙ্গে বাজানোর জন্য আহবান করেন। তাঁর আহবানেই তাঁর সঙ্গে বাজাতে আমেরিকা চলে যান আল্লারাখা। এরপরে তাঁর শুধুই উত্থান। পৃথিবী মুগ্ধ হয়ে যায় তাঁর বাজনায়। রবিশংকর ছাড়াও তিনি বড়ে গুলাম আলি খান, আলাউদ্দীন খান, বসন্ত রাই, আলি আকবর খানের সঙ্গে বিভিন্ন সময় অসাধারণ সঙ্গত করেন দেশ বিদেশের নানা সঙ্গীত সমারোহে। শুধুমাত্র সঙ্গত নয়, একক বাদক হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ! অসম্ভব সুন্দর সুন্দর সৃষ্টি ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গতানুগতিক বাজনায় তাৎক্ষণিক চমক তৈরী করতেন আল্লারাখা, যার জন্য তাঁর পুত্র জাকির হুসেনও বিখ্যাত ছিলেন। রবিশংকরের সঙ্গে তাঁর জুড়ি ছিলো বিশেষভাবে সফল এবং কিংবদন্তীস্বরূপ। ১৯৬৭ সালে তাঁদের মন্টেরি পপ ফেস্টিভ্যালের পারফরম্যান্স এবং ১৯৬৯ সালে উডস্টক ফেস্টিভ্যাল ভারতীয় মার্গসঙ্গীতকে ও তবলাকে পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো।
মন্টেরি পপ ফেস্টিভ্যালের সেই বিকেলে পন্ডিত রবিশংকর সেতারে বাজাচ্ছিলেন রাগ ভীমপলাশি। সঙ্গে সঙ্গত করছিলেন আল্লারাখা। সেখানে পশ্চিমী সঙ্গীতের তাবড় তাবড় ব্যক্তি
উপস্থিত। ছিলেন আমেরিকার গীটার লিজেন্ড জিমি হেনড্রিক্সও। প্রত্যেক শিল্পিকে চল্লিশ মিনিটের স্লট দেওয়া হয়েছে। বাজাতে বাজাতে, দ্রুত ঝালায় এসে রবিশংকর তাঁর ডান দিকে আল্লারাখার দিকে তাকালেন এবং একেবারে কমিয়ে দিলেন তাঁর সেতারে শব্দ। আল্লারাখার তবলা থেকে যে বিচিত্র জটিল অতি দ্রুত বোলরাশি বেরোচ্ছিলো তা যেন গোটা প্রেক্ষাগৃহে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। দর্শক উত্তেজনায় চীৎকার করে দীর্ঘ হাততালি দিয়ে উঠলো! এরপর দর্শকের অনুরোধে তবলা বেঁধে নিয়ে প্রথমে এককভাবে একতাল এবং পরে ত্রিতালে কায়দা, টুকরা ইত্যাদি বাজিয়ে শোনাতে হয়েছিলো তাঁকে! সেই অনুষ্ঠান অবশেষে চার ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলো দর্শকদের। সবশেষে যখন সেতার ও তবলায় যুগ্ম তেহাই দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান, ততক্ষণে ভারতীয় মার্গসঙ্গীত বিশ্বজয় করে নিয়েছে। সেই অনুষ্ঠানের পর থেকেই গায়ক বা যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীর গায়ন বা বাদনের সঙ্গে তবলিয়ার তবলায় সওয়াল জবাব অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে শুরু হয়, যা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে দর্শকদের কাছে।

আমেরিকার রক অ্যান্ড রোল ব্যান্ডে “গ্রেটফুল ডেড”-এর পারকাশনিস্ট মিকি হার্ট তাঁকে অসংখ্য প্রশংসায় ভূষিত করেছেন এবং তাঁর বাজানোর টেকনিক তিনি বিশেষভাবে স্টাডি করেছেন। বিশ্বসঙ্গীতে তিনি যেভাবে প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁকে মিকি হার্ট বলেছেন “Allah Rakha is the Einstein, the Picasso; he is the highest form of rhythmic development on this planet.” জ্যাজ ড্রামার বাডি রিচের সঙ্গে তাঁর রেকর্ড রিচ-আ-লা-রাখা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবীতে নিউইয়র্ক সিটিতে একটি কনসার্টে রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে বাজান আল্লারাখা। এতে বিদেশের এক বিশাল জনগণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও বাদ্যের বিশালত্ব ও সৌন্দর্য সম্বন্ধে অবহিত হন। পদ্মশ্রী ও সঙ্গীত নাটক আকাদেমী পুরস্কারে ভূষিত হন আল্লারাখা। তাঁর পুত্র আর এক বিখ্যাত তবলিয়া জাকির হুসেন তাঁর পিতা ও গুরু উস্তাদ আল্লারাখাকে ষাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানিয়ে বলেছেন যে তিনি যখনই তবলা ছোঁন, তাঁর মনে হয় তিনি প্রতিবার মনে হয় যেন তাঁর পিতা সেখানে উপস্থিত আছেন। আল্লারাখাকে আদর করে ছাত্রেরা সবাই আব্বাজী বলে সম্বোধন করতেন।
আল্লারাখার তিন পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে জাকির হুসেন ছিলেন সবচেয়ে বড়। কথিত আছে, জাকিরের জন্মের সময় নাকি আল্লারাখা কোরানের বাণীর বদলে তাঁর কানে ফিসফিস করে তবলার বোল বলেছিলেন। তাঁর বিবি যখন জিজ্ঞাসা করলেন তখন আল্লারাখা বলেছিলেন যে তবলা তাঁর কাছে ঈশ্বরের মতো এবং বোলই ঈশ্বরকে সবচেয়ে বড়ো ইবাদৎ করা। সবচেয়ে বড় ছেলে হিসাবে ঘরানার এবং পিতার ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিলো জাকিরের ওপরে। জাকিরের খুব ছোটবেলা থেকেই তবলার প্রতি এক অসম্ভব টান এবং নিজে নিজেই বাজানোর প্রবণতা ছিলো। পিতা পুত্রের মধ্যে বন্ধনও ছিলো তীব্র। বাবা না ফেরা অবধি শিশু জাকির কিছুতেই ঘুমোতে যেতেন না। উস্তাদ আল্লারাখা ছিলেন খুব স্নেহপ্রবণ। তিনি ছেলেদের রান্না করেও খাওয়াতেন। এ প্রসঙ্গে জাকির গল্প করেছেন যে একবার জন্মদিনে তাঁর ছোট ভাই তৌফিক কোন গিফট পায়নি বলে আব্বাকে এসে বলে। আব্বা বলেন “আমি গিফট বানাচ্ছি!” এর খানিক পরেই ৯-মাত্রার একটি কঠিন চক্রধার তৌফিককে দেন উপহার হিসাবে কারণ সেটি ছিলো তাঁর নবম জন্মদিন!
ছাত্রছাত্রীদের প্রতিও এমনি স্নেহপ্রবণ ছিলেন আল্লারাখা। পুত্রদের সঙ্গে ছাত্রদের কোন তফাত করতেন না। সে সময় যখন মুসলমান কোন মহিলা বোরখা ছাড়া বেরোতেন না, তিনি তাঁর বেগমকে কোনদিন বোরখা পরতে বলেননি। এমনকি তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীও ছিলো তবলার। নিজের মেয়েদেরও সুশিক্ষিত করেছেন তিনি। কড়া না হলেও রিওয়াজের ব্যাপারে খুবই কঠোর ছিলেন আল্লারাখা। পড়াশুনার পাশাপাশি তবলা রিওয়াজে কোন ফাঁকি তিনি বরদাস্ত করতেন না। জাকিরকে বলতেন তাঁর হাত পা টিপে দিতে। তিনি একপাশে কাত হয়ে শুতেন। শুয়ে শুয়েও মুখে বোল তৈরী করে করে বলতেন ও শেখাতেন তাঁকে। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়তেন কিন্তু তাও তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলি নড়তো। মনে মনে তখনো তিনি কনসার্টে থাকতেন। জীবনের শেষ দুদশক নিজে পারফর্ম্যান্স কমিয়ে পুত্র জাকিরের শিক্ষা ও অন্যান্য ছাত্রদের শিক্ষায় বেশী মনোযোগ দেন আল্লারাখা। ২০০০ সালে হঠাত হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর ঘরানা ও পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যান পুত্র জাকির হোসেন এবং ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত তবলিয়াদের মধ্যে একজন হন। মাত্র তিন বছর বয়সেই মৃদঙ্গ বাজাতে পারতেন জাকির। মাত্র বারো বছর বয়সে তাঁর প্রথম তবলার একক স্টেজ পারফরম্যান্স! সেন্ট জেভিয়ার্স মুম্বই থেকে গ্রাজুয়েশনের পর তিনি আমেরিকা চলে যান এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন থেকে সঙ্গীতে ডক্টরেট করেন। প্রতি বছর দেশে ও বিদেশে প্রায় দেড়শো কনসার্টে বাজান জাকির হোসেন। ১৯৭০ সালে আমেরিকায় তিনি পন্ডিত রবিশংকরজীর সঙ্গে বাজানো শুরু করেন। রবিশংকরজী তাঁকে ওয়াশংটন ইউনিভার্সিটিতে এথনোমিউসিওলজি বিভাগে অধ্যাপনা করতে বলেন এবং তিনি তা করতে শুরু করেন।
বিভিন্ন পাশ্চাত্য সঙ্গীতজ্ঞের সাথে যুগলবন্দী বাজান জাকির। বিটলস পপ ব্যান্ডের সঙ্গে তাঁর বাজনা বিখ্যাত হয়। আমেরিকান সাইকাডেলিক ব্যান্ড শান্তির সঙ্গেও তিনি বাজান। তিনি ক্রমাগত তাঁর তবলার বাজ ও আওয়াজ নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন ও ইম্প্রোভাইজ করেন তাঁর বাজনাকে। এতে তবলা একটি বাদ্যযন্ত্র হিসাবে এক অন্য মাত্রা পায়।
১৯৮৭ সালে জাকির তাঁর প্রথম সোলো তবলা অ্যালবাম “মেকিং মিউসিক” রিলিজ করেন। এটি একটি ইস্ট-ওয়েস্ট ফিউশন অ্যালবাম। ১৯৯৯ সালে তিনি তবলা বিট সায়েন্স বলে একটি সংস্থা তৈরী করেন বিল লাসওয়েলের সঙ্গে। তবলা ম্যাট্রিক্স এই গ্রুপেরই কাজ। তাঁর অ্যালবাম প্ল্যানেট ড্রাম ১৯৯২ সালে গ্রামি পুরস্কার পায়। হিট অ্যান্ড ডাস্ট, ইন কাস্টডি, মিস্টিক ম্যাসিউর এবং আরো অনেক হলিউড সিনেমায় তিনি সঙ্গীত কম্পোস করেন। আপোকালিপ্সোতে, লিটল বুদ্ধ প্রভৃতি সিনেমায় তিনি তবলা বাজান। তিনি সবচেয়ে কমবয়সে পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ পুরস্কার ও সঙ্গীত নাটক আকাদেমী পুরস্কার পান।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জাকিরের একক বাজনা শুনি ডোভার লেনে। শুধু তাঁর বাজনা শুনতে সেবার নজরুল মঞ্চের বাইরে যা লাইন পড়েছিলো তেমন আমি কোনবার দেখিনি। তাঁর হাতে তবলা যেন কথা বলতো। হাতের যে কোন অংশ দিয়ে তিনি তবলাকে কথা বলাতে পারতেন। হাতের আঙ্গুল ও চেটো ছাড়াও গাঁট দিয়ে, হাতের পিছনের অংশ দিয়ে, হাতের আংটি দিয়ে এবং মুখে নানারকম আওয়াজ দিয়ে বোল তৈরী করেন জাকির! তাঁর বাজনা শোনা এক বিস্ময়! শুধু তবলার মুখেই নয়, তবলার গায়ে বা পাশে, তবলা ঘুরিয়ে নীচেও আঘাত করেন তিনি বাজাতে বাজাতে! কী পরিমাণ অভ্যাসে এবং তবলা ও শব্দকে নিয়ে কতো চিন্তা করলে একটি যন্ত্রকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় তা জাকিরের বাজনা না শুনলে বোঝা যায় না। বিরজু মহারাজ যেমন তাঁর ঘুঙ্গুরের বোলে হরিণের আওয়াজ, ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ, বাঘের আওয়াজ করতেন, জাকিরকেও স্টেজে তবলায় ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ, ঝড়ের আওয়াজ, তবলায় নখ দিয়ে শঙ্খের আওয়াজ হুবহু করতে শুনেছি। নিজের ঘরানার অসাধারণ সব কায়দা, টুকরা, গৎ, চক্রধারের সঙ্গে সঙ্গে এইসব নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা শ্রোতাকে যেন পাগল করে দেয়! তাই তো তাঁর প্রতিটি কনসার্ট এমন হাউসফুল, এতো জনপ্রিয়! ঝাঁকড়া চুল নাড়িয়ে মুখে এক বালকসুলভ হাসি নিয়ে তবলার সামনে জাকির যেন এক চিরযুবক! তবলার রাজকুমার!

সামনের পর্বে বেনারস ঘরানার কথা দিয়ে শেষ করবো তবলার কথা। এরপর চলে যাব নৃত্যঘরানা ও নৃত্যের কথায় ও তাই দিয়েই শেষ হবে আলাপ!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।