ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ৩১)

আলাপ
 

মাইহার ঘরানার পর আজ ভারতের দ্বিতীয় বিখ্যাত যন্ত্রসঙ্গীত ঘরানা “সেনিয়া ঘরানা”র কথা। ভারতের প্রতিটি যন্ত্রসঙ্গীত ঘরানাই কোন না কোনভাবে তানসেনের বিভিন্ন বংশধরদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। কথিত আছে তানসেনের পুত্রের দিকের বংশধরেরা মূলত রবাবিয়া ছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা রবাব বাজাতেন, যা থেকে পরে সরোদের উৎপত্তি হয়। অপরদিকে তানসেনের কন্যা সরস্বতীর বংশধরেরা ছিলেন বীণকার, অর্থাৎ তাঁরা মূলতঃ রুদ্রবীণা বাজাতেন। পরে এই বীণকাররাই সুরবাহার এবং সেতার বাজের সৃষ্টি করেন। এই তানসেন থেকেই সেনিয়া কথাটির উৎপত্তি। আমরা সবাই জানি তানসেন ছিলেন আকবরের সমসাময়িক এবং তাঁর সভাগায়ক। তাঁর বংশধরেরা বংশপরম্পরায় মুঘল দরবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলো এবং সেখানেই গান বাজনা করতো। সেই সময়ের ‘বাজ’ ছিলো প্রধাণতঃ ধ্রুপদ অঙ্গে অর্থাৎ ধ্রুপদের মতো করে বাজানো হতো। পরবর্তীকালে ঔরঙ্গজেবের সময় থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হতে শুরু করে। গানবাজনাও প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, কারণ ঔরঙ্গজেব গান বাজনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন। এই সময় থেকেই সঙ্গীতজ্ঞরা মুঘল সভা ছেড়ে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। পরবর্তীকালে আবার ত্রয়োদশ মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ (১৭১৯ – ১৭৪৮) সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং সঙ্গীতের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিখ্যাত হন। তিনি নিজে “সদারঙ্গিলা” ছদ্মনাম নিয়ে সাহিত্য রচনা ও সঙ্গীত রচনাও করতেন। তাঁর দরবার, “মুহম্মদ শাহ দরবার” নামে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়। সেখানে এই সেনিয়া বীণকার ও রবাব ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞরা আবার জড়ো হতে শুরু করেন। কিন্তু মুহম্মদ শাহের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের দ্রুত পতনের সূচনা হয়। বিভিন্ন রাজ্যগুলি মুঘল শাসণ থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করে। অবশেষে নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করলে মুঘল সাম্রাজ্য একেবারে ভেঙ্গে যায়। মুহম্মদ শাহ দরবারের শেষও এই সময়।
এরপর সেনিয়া সঙ্গীতজ্ঞরা তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়ে তিনদিকে ছড়িয়ে পড়েন এবং সেনিয়া জয়পুর, সেনিয়া বাঙ্গাশ এবং সেনিয়া মাইহার ঘরানার জন্ম হয়। মাইহার ঘরানার কথা আগেই বলা হয়েছে। উস্তাদ আলাউদ্দীন খান শিক্ষা পেয়েছিলেন রামপুর ঘরানার উস্তাদ ওয়াজির খানের কাছে। রামপুরের রাজার সভাগায়ক ছিলেন বলেই তাঁর ঘরানাকে পরবর্তীকালে রামপুর ঘরানা নাম দেওয়া হয়। কিন্ত এই ওয়াজির খান ছিলেন তানসেনের জামাই নৌবত খানের সরাসরি বংশধর এবং সেনিয়া বীণকার ঘরানার এক প্রতিভূ। তিনি নিজে রুদ্রবীণা ও সুরবাহার বাজাতেন। তাই ওয়াজির খান ও আলাউদ্দীন খানের মিলিত সঙ্গীতধারা নিয়েই সেনিয়া-মাইহার ঘরানা।
এবার আসি মুহম্মদ শাহ দরবারের সেনিয়া শিল্পীরা আর কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়লেন সেই কথায়। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর তা আমরা জানি। এই বাহাদুর শাহ জাফর, ১৭৭৫ – ১৮৬২ এই দীর্ঘসময় ইংরেজদের অধীনস্থ হয়ে এবং সিপাহী বিদ্রোহের পর তাঁদের হাতে বন্দী হয়ে কাটান। কিন্তু তিনি শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নিজে সঙ্গীত রচয়িতাও ছিলেন। তাঁর পরে মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব সেভাবে না থাকলেও, মুঘল সাম্রাজ্যের জমি এবং সম্পদ কম ছিলো না। বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্র জাহান্দার শাহ দুই সেনিয়া ধ্রুপদ গায়ক জাগু খান ও মক্কু খানকে বেনারসে কিছু জমি দিলে তাঁরা সেখানে বসবাস শুরু করেন। এই জগগু ও মক্কু খানের বংশধরেরা প্রায় সবাই বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে প্রতিপন্ন হন। ১৭৫০ সালের পর জয় সিং জয়পুর শহরের পত্তন করেন। কালক্রমে জগগু ও মক্কু খানের বংশধরেরা ক্রমে বেনারস থেকে জয়পুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং সেনিয়া-জয়পুর ঘরানার সূচনা করেন। এই ঘরানার বিখ্যাত শিল্পীরা হলেন সাদিক আলি খান, ওয়ারাস আলি খান, আশিক আলি খান, বড়ে মোহাম্মদ খান, আশিক আলি খান, উস্তাদ বরকতুল্লা খান এবং মুশতাক আলি খান। এঁরা প্রায় সবাই সুরবাহার এবং সেতার বাজাতেন ধ্রুপদ অঙ্গে।
এই সেতার বাজনাটির জন্ম কিন্তু আমীর খসরুর সময়। কথিত আছে এই সময় সেতার ছিলো তিনটি তারের বাজনা। আমীর খসরু ছিলেনও ছিলেন তানসেনের জামাই নৌবত খানের পঞ্চদশ পিঁড়ির বংশধর। তবে সেতার যন্ত্রটির সত্যিকারের বিকাশ ঘটান তাঁর পৌত্র মসিত খান, যিনি মসিত সেন নামেও পরিচিত ছিলেন। সেতারে অতিরিক্ত তারের প্রয়োগ ইত্যাদি সবই তাঁর সময় থেকে শুরু। তিনি সেতারের অসংখ্য গৎ তৈরী করেন। তাই তাঁর তৈরী বাজকেই মসিত সেনী বা মসিত খানী বাজ বলা হয়। তিনি দিল্লীর বাসিন্দা ছিলেন। তাই একে দিল্লীওয়ালী বাজও বলা হয়। সেনিয়া জয়পুরের ওস্তাদেরা এই মসিতসেনী বাজই বাজাতেন।  
হয়তো এই পর্বটিকে একটু নীরস ইতিহাস মনে হতে পারে। তবে এই কুয়াশাচ্ছন্ন ইতিহাসের পাতাতেই লুকিয়ে আছে বিখ্যাত সব যন্ত্রশিল্পীদের গড়ে ওঠার কথা।
সব শেষে বলবো সেনিয়া-বাঙ্গাশ ঘরানার কথা এবং এর পরের পর্বে এই ঘরানার বিখ্যাত ও আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় যন্ত্রশিল্পী উস্তাদ আমজাদ আলি খানের কথা।
গুলাম বন্দেগী খান বাঙ্গাশ আফগানিস্থান থেকে ভারতে আসেন। তিনি বিশ্বনাথ সিং মহারাজার অশ্বসেবক হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন। এই বিশ্বনাথ সিং মহারাজা ছিলেন বুন্দেলখন্ডের ছত্তারপুরের মহারাজা। তিনি ১৮৬৬ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত করদ রাজা হিসাবে রাজত্ব করেন। বিশ্বনাথ সিং মহারাজা রেওয়ার রাজা কামাখ্যাপ্রসাদের কাছে রবাব ও বীণা শিক্ষা করেন। তাঁর মার্গসঙ্গীতের জ্ঞান ছিলো অসাধারণ! গুলাম বন্দেগী খানের ছেলে গুলাম আলি খান বিশ্বনাথ সিং মহারাজের কাছে রবাব ও বীণা শিক্ষা শুরু করেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তার পিতা মারা যান কিন্তু তিনি অচিরেই অসাধারণ রবাব বাজাতে লাগলেন। অত্যন্ত সুললিত ছিলো তার বাজনার হাত। বিশ্বনাথ মহারাজ তখন, তাঁকে গোটা ভারত ঘুরে বিভিন্ন সভায় বাজাতে বলেন। ক্রমে গোয়ালিয়রের মহারাজা তাঁর সভায় সভাবাদক হিসাবে গুলাম আলিকে স্থান দেন এবং গোয়ালিয়র শহরের মধ্যস্থলে তাঁকে বসবাসের জন্য বাসস্থান ও জমি দেন। গুলাম আলি খানের পুত্র ছিলেন নানহে খান। তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে একজন হলেন উস্তাদ হাফিজ আলি খান। হাফিজ আলি তাঁর পিতা এবং তাঁর কাকা মুরাদ আলির কাছে বাজনা শিখতে লাগলেন। ততদিনে রবাব থেকে সরোদের জন্ম হয়েছে। হাফিজ আলি খান এই সময় রামপুরের ওস্তাদ ওয়াজির আলি খানের কাছেও সরোদ শিক্ষা শুরু করলেন এবং সেনিয়া ঘরানার সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র স্থাপিত হলো। কালক্রমে তাঁর তৈরী বাজই গোয়ালিয়র ঘরানার বাজ বা সেনিয়া-বাঙ্গাশ ঘরানার বাজ হিসাবে পরিচিতি পেলো। তিনি মথুরার গণেশীলালজীর কাছে ধ্রুপদ শিক্ষা এবং ভায়া গণপত রাওয়ের কাছে ঠুংরী শিক্ষাও করেন। তিনি গোয়ালিয়রের সভাবাদক হিসাবে অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ক্রমে ১৯৫২ সালে তিনি সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কার ও ১৯৬০ সালে পদ্মভূষণ উপাধী পান। তিনি ধ্রুপদ স্টাইল থেকে সরে এসে খেয়াল স্টাইলে বাদনরীতি তৈরী করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র বিখ্যাত ওস্তাদ আমজাদ আলি খান ও তাঁর সুযোগ্য পুত্রদ্বয় আমান ও আয়ান আলি বাঙ্গাশ এই ঘরানাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। পরবর্তী পর্বে আমজাদ আলি খানকে নিয়ে থাকবে কিছু কথা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।