ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ৫০)

আলাপ

সম্ভবতঃ ২০১১ সালে, ইন্ডো-অক্সিডেন্টাল সিমবায়োসিস বলে একটি সংস্থা, কলকাতায় কলামন্দিরে প্রায় এগারো দিন ব্যাপী একটি নৃত্য উৎসবের আয়োজন করেন। এমন বড় আকারে এবং এতজন ভারতবিখ্যাত নৃত্যশিল্পীর উপস্থিতিতে এমন একটি অনুষ্ঠান এর আগে কলকাতায় আয়োজিত হয়েছে কি না সন্দেহ। সেখানে বৈজয়ন্তীমালা বালি থেকে হেমা মালিনী ও তাঁর কন্যারা কে না ছিলেন! এদিকে বিরজু মহারাজ, সোনাল মানসিং, কত্থকে নীলিমা আজিম সবার নাচ দেখেছিলাম সেই সমারোহে। হলের বাইরের বিশাল কাটআউটগুলি দেখলেই মনে বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধার উদ্রেক হচ্ছিল। স্টেজের সজ্জাও ছিল সেরকম! নাটকের মত সেট সেটিং ব্যবহার করে ও নানা ধরণের আলোর প্রয়োগে যেন স্বর্গের ইন্দ্রসভায় পরিণত হয়েছিল স্টেজ! কখন বা কোন প্রাচীন মন্দির বা রাজপ্রাসাদের সেট ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি প্রদর্শনই ছিল অনন্য। তবু তার মধ্যে যে নৃত্য প্রদর্শন প্রথমবার দেখি এবং আজ অবধি ভুলতে পারিনি তা হল রাজা ও রাধা রেড্ডি এবং তাঁদের পরিবারের অসাধারণ কুচিপুরি নৃত্য!
রাজা ও রাধা রেড্ডির নাম তার আগে বহু শুনেছি, কিন্তু তাঁরা যে নৃত্যকে কোন কলার সুউচ্চ শৃঙ্গে নিয়ে গেছেন, তা সেদিন না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। প্রথমেই বলি অন্য প্রদর্শনগুলির মত, এঁরা কোনরকমের সেট সেটিং ব্যবহার করেননি। স্টেজ অন্ধকার। হালকা গোলাপি আলোর ধারায় ধীরে ধীরে কুচিপুরি নাচের ধারা অনুযায়ী পূর্বরঙ্গ পর্যায়ে একে একে স্টেজে এলেন রাজা রেড্ডি, রাধা রেড্ডি, তাঁদের দুই কন্যা যামিনী ও ভাবনা রেড্ডি এবং সবশেষে কৌশল্যা রেড্ডি। প্রত্যেকেই ছোট এক একটি প্রদর্শন করলেন। আমাকে প্রথমেই প্রবল আকর্ষণ ও মুগ্ধ করল রাজা রেড্ডির স্টেজে চলন ও শরীরী ভঙ্গিমা! কীভাবে বাহ্য রূপের উর্ধে উঠে এক নর্তক তাঁর কলা দিয়ে দর্শকের চোখে মায়াকাজল বুলিয়ে দিতে পারেন, তার এত বড় পরিচয় আগে পাইনি। তাঁর চওড়া স্কন্ধ, সবল দুই বাহু, কটিদেশ, ঘন নীল বস্ত্র পরিহিত নিম্নাঙ্গ , ঘুঙ্গুর পরিহিত পদযুগল যেন মন্দির ভাস্কর্যের মত! কজ্জল অঙ্কিত দুটি তীব্র চোখ ও ভ্রুর ভঙ্গী দর্শকাসন থেকেও পরিষ্কার। তেমনই সুন্দর রাধা রেড্ডি ও তাঁর দুই কন্যার এবং কৌশল্যা রেড্ডির অপূর্ব রঙের পছমপল্লি ও কাঞ্জিভরম পরিহিত সুললিত দেহভঙ্গিমা।
তাঁরা নৃত্যাংশে প্রথম পরিবেশন করলেন একটি গল্প। রাধা তাঁর বেশ কিছু সখীকে নিজ গৃহে নিমন্ত্রণ করেছেন আহারে এবং রাত্রে তাঁরা সেদিন সেখানেই থাকতেন। শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন রাধার সঙ্গে রাত্রিবাসের এমন সুযোগ আর হবে না। তিনি সখীদের সকাতর অনুরোধ করে, স্ত্রী রূপে লুকিয়ে গৃহে প্রবেশ করলেন এবং তারপর রাধার শয়নকক্ষে সখীরূপে দেখা দিলেন। তারপর কী হল সেই নিয়েই কাহিনী। রাজা রাজা রেড্ডি নারী রূপ ধারণ করে যখন স্টেজে এলেন, কোনভাবেই বোঝা সম্ভব ছিল না যে তিনি পুরুষ! তাঁর হাঁটাচলা, অঙ্গহেলন, মুখভঙ্গী, ভ্রুভঙ্গী সবই ছিল এক সুন্দরী রমনীসুলভ! সখীদের সঙ্গে ঠাট্টা হাসি গল্প, লুকিয়ে প্রবেশের ভয়, রাধার জন্য ব্যাকুলতা, রাধার শয়নকক্ষে প্রবেশের পর তাঁর হৃদয় দৌর্বল্য, রাধাকে এত নিবিড় ভাবে দেখে তাঁর মুগ্ধতা এবং অবশেষে তিনি যখন নিজেকে প্রকাশ করলেন এবং রাধাকে আদর করতে গেলেন তখন রাধার অবিশ্বাস ও চমক এবং নিজের মনের বিরূদ্ধে গিয়ে কৃষ্ণকে তাঁর শয়নকক্ষ থেকে নিষ্কাশন, এই সবকিছুই এত অপূর্ব নাটকীয় ভাবে দুজনে প্রকাশ করলেন যে মনে হল এঁরাই স্বয়ং রাধা কৃষ্ণ! তাঁদের বয়স তখন ষাটোর্ধ! কিন্তু দুজনেই যেন চঞ্চল দুই যুবক যুবতী! অতঃপর নৃত্ত অংশে বিশুদ্ধ কুচিপুরি নাচও তেমনই অসাধারণ! যেমন হস্ত পদ মুদ্রা, তেমনই চলন, নানা ধরণের যোগমুদ্রা ও শরীরী বিভঙ্গ রাজা ও রাধা রেড্ডির, তেমনই তাঁর কন্যাদের।
তবে রাজা রেড্ডিকে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী বলতে হল তাঁর শিবতান্ডব দেখে! কী শক্তিশালী দৃপ্ত ভঙ্গী, দেহের প্রতিটি পেশি সঞ্চালন, গোটা স্টেজ জুড়ে তান্ডব নাচলেন নটরাজ! কোথায় সেই নারীর সাজে কৃষ্ণ আর কোথায় এই পুরুষোত্তম শিব! দুইজন একই ব্যক্তি এ যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল! মনে মনে প্রণাম জানিয়েছিলাম সেদিন এই অসাধারণ শিল্পী পরিবারকে, যারা এই নাচকে জগতসভায় স্থান দিয়েছেন।
এবার এই শিল্পীদের জীবনের এবং নৃত্যের গল্প একটু বলি। রাজা রেড্ডির জন্ম ১৯৪৩ সালে তেলেঙ্গানার নারাসাপুরম গ্রামে। খুব ছোট্টবেলায় তাঁর গ্রামে আসতেন ভ্রাম্যমান লোকনৃত্যশিল্পীরা, যারা কুচিপুরি ‘ভাগবান্থম’ নাচ দেখাতেন। বালক মুগ্ধ হয়ে দেখত সেই নাচ। কিন্তু তিনি কুচিপুরি নাচ শিখবেনই
এই ভাবনা তাঁর মধ্যে দৃঢ় হয়, বৈজয়ন্তীমালার কুচিপুরির ওপরে ‘নাগিন’ নৃত্য দেখার পর।
খুব ছোটবেলায় বালবিবাহ হয় রাজা ও রাধা রেড্ডির। তখন রাজা রেড্ডির বয়স এগারো আর রাধা রেড্ডির মাত্র ছয়।
রাজা রেড্ডি উচ্চবর্ণের ধনী রেড্ডি পরিবারের ছেলে ছিলেন এবং নৃত্যকে পেশা করার কথা তাঁর পরিবারে ভাবে যেত না। তাই একটু বড় হওয়ার পর, তাঁরা দুজনে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। নানা স্থানে গুরুর সন্ধানে ঘোরেন দুজন, কিন্তু কেউই রাজা রেড্ডিকে কুচিপুরি শেখাতে রাজী হননি। সেই সময় কুচিপুরি নাচে মহিলা সাজতেন পুরুষেরাই। তাই যে সব পুরুষ গৌরবর্ণ, যাঁদের সরু কটিদেশ, তাঁদেরই এই নাচের উপযুক্ত মনে করা হত। অপরপক্ষে রাজা রেড্ডি ছিলেন কৃষ্ণবর্ণ এবং চওড়া পুরুষালী চেহারার। গুরুরা তাঁকে দেখলেই বলতেন “আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছো? তোমার কোমরের মাপ দেখেছ? তোমার দ্বারা এই নাচ হবে না”। অবশেষে তাঁরা হায়দ্রাবাদে এসে বসবাস শুরু করেন। হতাশ হয়ে কত্থক নাচ শিখতে শুরু করেন ও তাতেই ডিপ্লোমা করেন। অবশেষে বহুকষ্টে স্ত্রীকে নিয়ে গুরু প্রাণশিভা শাস্ত্রীর কাছে পৌঁছন এবং বলেন যে তাঁরা দুজন একসঙ্গে শিখতে চান। তাঁর স্ত্রী রাধাকে দেখেই অবশেষে গুরুজী তাঁদের শেখাতে রাজী হন এবং রাধা স্ত্রী চরিত্র এবং তিনি পুরুষ চরিত্রের পার্ট পেতে লাগলেন। এরপর তাঁরা এলুরুতে ভেদান্তম প্রহ্লাদ শর্মার কাছে কুচিপুরি শেখেন।
১৯৬৬ সালে সরকারী বৃত্তি লাভ করে রাজা ও রাধা রেড্ডি দিল্লিতে যান ও সেখানে বসবাস শুরু করেন। এরপর রাজা রেড্ডি নাট্য ব্যালে সেন্টারে মায়া রাওয়ের কাছে কোরিওগ্রাফি শিখতে শুরু করেন। মায়া রাও রাশিয়ান বলশয় ব্যালে গ্রুপ থেকে কোরিওগ্রাফি শিখে এসেছিলেন। এরপর রাজা রেড্ডি নিজেদের নাচের কোরিওগ্রাফি নিজেই করতেন এবং নৃত্যের বিষয়বস্তুতে নানা নতুনত্ব আনার প্রচেষ্টা সবসময়ে করতেন। দিল্লিতে তাঁদের বসার ঘর শাস্ত্রীয় নৃত্যের নানা বইতে পরিপূর্ণ এবং তা বেশীরভাগই তেলেগুতে। এ ছাড়াও নাট্যশাস্ত্রের নানা রূপান্তর তিনি সংগ্রহে রেখেছেন।
তাঁরা প্রথম বড় সুযোগ পান ১৯৭০ সালে, যখন থিয়েটার তামিলনাড়ুতে তাঁদের নাচ উচ্চ প্রশংসিত হয় এবং খুব ভাল রিভিউ পায়। এরপর ভারতীয় পর্যটন মন্ত্রক, ডঃ করণ সিং এবং প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের প্রদর্শন দেখেন।  নেহেরুজীর জন্মশতবর্ষে তাঁদের নাচ দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের দিল্লিতে বসবাসের জন্য জমি ও বাড়ি প্রদান করেন।
রাজা ও রাধা রেড্ডির নাচ ক্রমে ভারতবিখ্যাত ও পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে ওঠে। প্রায় সবসময়ে ঘুরে ঘুরে নৃত্যপ্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এই দম্পতি। রাজা রেড্ডির অসাধারণ নৃত্যের সঙ্গে সমান পারদর্শিতায় ও লালিত্যে অপরূপ রাধা রেড্ডির নৃত্যও। তাঁরা যেন হরগৌরির মত একে অপরের পরিপূরক।
১৯৭৬ সালে তাঁরা দিল্লীতে নৃত্যশিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় তৈরী করেন এবং তাঁর নাম দেন নাট্যতরঙ্গিনী স্কুল অফ ডান্স। এই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসাবে যোগ দেন রাধা রেড্ডির ছোট বোন কৌশল্যা। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। যেখানেই নৃত্যপ্রদর্শনে যেতেন রাজা ও রাধা রেড্ডি, তাঁদের সঙ্গে যেতেন কৌশল্যা। স্টেজে রাজা রেড্ডির পুরুষসুলভ চেহারা, ভঙ্গিমা এবং অপূর্ব নৃত্য দেখে বিস্ময়বিমুগ্ধ আত্মবিস্মৃত হন তিনি। অবশেষে একদিন আর না থাকতে পেরে রাজা রেড্ডিকে বলেন “আপনি আমায় বিবাহ করবেন?” অনেক ছোট কৌশল্যার কথা প্রথমে রাজা রেড্ডি হেসেই উড়িয়ে দেন। কিন্তু রাধা বুঝতে পেরেছিলেন কৌশল্যার ঐকান্তিক ভালবাসা। তাই একদিন তাঁকে ডেকে বলেন যে তিনি তাঁর সঙ্গে রাজা রেড্ডির বিবাহ দেবেন, কিন্তু একটি শর্তে। তিনি স্বামীর ভাগ কৌশল্যাকে দেবেন, তবে নৃত্যের ভাগ কখনোই নয়। তাই মঞ্চে রাজা রেড্ডির সঙ্গে নৃত্যের অধিকার একমাত্র তাঁরই থাকবে। কৌশল্যা রাজা রেড্ডিকে বিবাহ করে তাঁদের সঙ্গে থাকতে পারেন, কিন্তু নৃত্য করতে পারবেন না। সেই শর্ত মেনে নিয়েই রাজা রেড্ডির দ্বিতীয়া স্ত্রী হন কৌশল্যা। ততদিনে রাধা দুই কন্যার মাতা। বিবাহের পর নাট্য তরঙ্গিনীর প্রশাসনিক কাজকর্মের দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে নেন কৌশল্যা, যাতে রাজা ও রাধা রেড্ডি শুধু নাচে মন দিতে পারেন। ক্রমে নাট্যতরঙ্গিনী অনেক বড় হয় এবং এক বিশেষ কাজ হিসাবে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এখানে অন্ধ ছেলেমেয়েদেরও বিশেষ পদ্ধতিতে কুচিপুরি শেখানো হয়।
রাজা রেড্ডি হিন্দী, ইংরাজী এমনকি সুফিয়ানা গানের ওপরও কুচিপুরি নাচের কোরিওগ্রাফি করেন, নাচের ব্যাকরণ ও প্রদর্শনে কোন আঘাত না করে। একবার পন্ডিত রবিশংকর রাজা রেড্ডিকে একটি তারানা দেন। সেটির ওপরেই একটি সুন্দর নৃত্যভাবনা নিয়ে আসেন রাজা রেড্ডি। কখনো আবার বাইবেলের কবিতার ওপরে অথবা নুসরত ফতে আলি খানের সুফিয়ানা কলামের ওপর নৃত্যপ্রদর্শন করেন কুচিপুরি নৃত্যের এই গুরু। তিনি বলেছেন “নৃত্য হল নদীর মত। নদীতে যেমন নতুন স্রোত না প্রবেশ করলে জল তাজা থাকে না, তেমনই নৃত্যে নতুন ভাবনা না প্রবেশ করলে তা গতানুগতিক হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে নদীর দুই দৃঢ় পাড়ের মত হল নৃত্যের ব্যাকরণ। তা কখনোই ভাঙ্গা উচিৎ নয়।“
রাজাজী এও লক্ষ্য করেন যে
পরবর্তী প্রজন্ম কুচিপুরি নাচের প্রাচীন ও পৌরাণিক গল্পগুলিকে নানাভাবে সমালোচনা করে এবং বর্তমান কালে এর প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পায় না। তাই এই নতুন প্রজন্মের জন্যও নৃত্যে নানা পরিবর্তন আনা জরুরী বলে তাঁর মনে হয়। কিন্তু সবই নৃত্যের প্রকরণ ও সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখে। তিনি বলেন যে একবার শিব রামমূর্তি তাঁকে বলেছিলেন যে কিভাবে নাট্যশাস্ত্রের একটি বৃত্তিতে বলা আছে যে একজন নৃত্যের নতুন ভাষার সন্ধান সর্বদা করতে পারে, তার ব্যাকরণকে অক্ষুণ্ণ রেখে। তেমনই প্রচেষ্টা হল হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তারাণার প্রয়োগ, “ছাপ তিলক” নামে বিখ্যাত ভজনের ওপরে কোরিওগ্রাফি, কিংবা নুসরত ফতে আলির সাহেবের শাসুঁ কি মালা নামক সুফিয়ানা কলামে কুচিপুরির প্রয়োগ। এই প্রতিটি কোরিওগ্রাফিই অত্যন্ত সুন্দর ও জনপ্রিয় হয়। দিল্লির মানুষ এগুলি অনেক সহজে বুঝতে পারেন এবং প্রশংসা করেন। অন্যদিকে যখন দক্ষিণভারতে নৃত্যপ্রদর্শন করেন, তখন তাঁরা বিশুদ্ধ তেলেগু মার্গমের ওপর নৃত্যপ্রদর্শন করেন। স্টেজে আলোর ব্যবহারও রাজা রেড্ডির এক নতুন প্রচেষ্টা, এই নাচে নতুন মাত্রা যোগ করার। তাতে নৃত্য আরো রঙিন ও আবেদনময় হয়ে ওঠে।
একবার তাঁর কন্যা ছোট্ট ভাবনা বায়না ধরে যে ইংরাজীতে কোন কবিতার ওপর কেন কুচিপুরি নাচা যাবে না? তারা অনেক সহজে ইংরাজী বুঝতে পারে, কিন্তু সংস্কৃত কিংবা তেলেগু ভাষায় বদ্ধ সঙ্গীত তারা তত বোঝে না। অবশেষে রাজা রেড্ডি মেয়ের জন্য বাইবেলের ভার্সের ওপরে কোরিওগ্রাফি করেন যার মূল বিষয়বস্তু হল ঈশ্বর, আল্লা ও গড এক এবং অদ্বিতীয়। তাই সর্ব ধর্ম একই কথা বলে। প্রেসিডেন্ট আবদুল কালাম তাঁর কবিতার বই “ভিশন অফ লাইফ” এবং “লাইফ ট্রি” রাজা রেড্ডিকে দেন এবং রাজাজী তাঁর সেই কবিতার ওপরে কোরিওগ্রাফ করে কুচিপুরি নৃত্য প্রদর্শন করে চমকে দেন আবদুল কালামজীকে।
কৌশল্যা রেড্ডি রাজা রেড্ডিজী সম্পর্কে বলেছেন যে রাজাজী একেবারেই পারিবারিক কাজে সময় দিতে পারেন না। নাচের ব্যাপারে রিসার্চ, বই পড়া, নতুন কোরিওগ্রাফির চিন্তা করেই তাঁর সময় কাটে। তারপর সরল মানুষটি বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালবাসেন। সংসারের কাজ ও চিন্তা তাই পুরোপুরি কৌশল্যাজী ও কতকাংশে রাধাজীর ওপরে। কিন্তু তাঁরা রাজাজীকে গুরু মনে করেন ও তাঁদের আদরের স্বামীকে তাঁর মতই থাকতে দেন।
তাঁদের নিজেদের নৃত্যের সবচেয়ে বড় সমালোচক তাঁরাই। যে কোন একটি নতুন কোরিওগ্রাফি তৈরী হলে তা মঞ্চে প্রদর্শনের আগে তাঁরা নিজেই তার দোষগুণ কাটাছেঁড়া করেন। তাঁদের পছন্দ হলে তবেই তা প্রদর্শিত হয়। নাট্যতরঙ্গিনী সামলানোর পুরো দায়িত্বও কৌশল্যার। রাজা ও রাধা রেড্ডি সারা ভারত এবং বিদেশে ঘুরে বেড়ান যখন, তখন সেখানে পরিচালনা করা ও নৃত্য শেখানোর দায়িত্ব থাকে কৌশল্যাজীর ওপরে। তাই এত ব্যস্ত রুটিন সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠান আজ এত সফল। তিনি নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতে এবং তাঁর দিদি ও স্বামীকে এগিয়ে
এগিয়ে দিতে ভালবাসেন।
রাজা ও রাধা রেড্ডি প্রায় পাঁচ দশক তাঁদের নাচে মুগ্ধ করে রেখেছেন দর্শকদের। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফ্রান্সের অ্যাভিগ্ননে ডান্স ফেস্টিভ্যালে, অথবা আমেরিকায় “ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়া”তে তাঁরা নেচেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদা কালো ভেদাভেদ উঠে যাওয়ার পর যখন “প্লে হাউস থিয়েটার” নতুন করে খোলে, তখন তার উদবোধন করেন রাজা ও রাধা রেড্ডি। প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের স্মৃতিতে মিসিসিপি নদীর ওপরে বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তির উপস্থিতিতে তাঁরা নৃত্য প্রদর্শন করেন। দুজনেই পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কার এবং নৃত্য চূড়ামণি পুরস্কারে ভূষিত হন। দুজনকেই ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে ইউনিভার্সিটি অফ হায়দ্রাবাদ। শ্রদ্ধেয় আবদুল কালামজীর “ট্রি অফ নলেজ” এর ওপর কোরিওগ্রাফিটি ২০১০ সালে কমনওয়েলথ গেমসের উদবোধনে প্রদর্শিত হয়।
তাঁদের নৃত্য শিক্ষালয় নাট্যতরঙ্গিনীতে শাস্ত্রীয় নৃত্য, সঙ্গীত, যোগা এবং সংস্কৃত শেখানো হয়। সেখানে একটি অডিটোরিয়াম, আর্ট গ্যালারি এবং হোস্টেল ইত্যাদিও আছে। প্রতি বছর সেখানে ডান্স ও মিউসিক ফেস্টিভ্যাল হয়। গোটা বিশ্ব থেকে শিল্পীরা সেখানে প্রদর্শন করেন। পরিবারের দুই কন্যাও তাঁদের পিতা মাতার মতই এই নাচে উৎসাহী এবং একে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।