তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফটো ফিচার

আমেরিকার এক প্রত্যন্ত শহরে

নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি’র মতো গ্ল্যামারাস শরহগুলোতে মাত্র কয়েকদিন কাটিয়ে এবার চলে গেছিলাম আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে নিউ মেক্সিকো প্রদেশের লস আলামস শহরে। বছর তিনেক আগেও কোনোদিন নাম শুনিনি সেই জায়গাটার। নিউ মেক্সিকো নামে কোনও অঙ্গরাজ্য আছে আমেরিকার সেটাও জানতাম না তখন। এবার সেই শহরই যে এমন আপন করে নেবে আমাদের তা আগে থেকে ভাবতে পারিনি। আমরাও দীর্ঘ ছমাসের সহাবস্থানে তাকে যতটা সম্ভব চিনেছি আর ভালোবেসে ফেলেছি।

নিউ ইয়র্ক থেকে ফ্লাইটে চার ঘণ্টার জার্নিতে পৌঁছে যাওয়া যায় নিউ মেক্সিকোর সবচেয়ে বড় শহর তথা বাণিজ্য নগরী আলবুকার্কি(Albuquerque)। সেখান থেকে গাড়িতে ৯৭ মাইল উত্তরে লস আলামস। মাঝপথে রাজধানী শহর সান্তা ফে কে পাশ থেকে একটুখানি ছুঁয়ে যাওয়া। সেও এক সুন্দরী শহর। শিল্প ও শিল্পীর শহর। অসাধারণ সেখানকার স্থাপত্যশৈলী, যা আমেরিকার অন্যান্য বড় শহরের চাইতে একেবারেই আলাদা। সে আলোচনা যদিও এখানে নয়।

সাড়ে সাত হাজার ফুট উচ্চতায় পাহারিটো মালভূমির (Pajarito plateu) উপর লস আলামস শহরটা এমনই  সুন্দর সাজানো গোছানো যে ছবির মতো লাগে। প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে পার্শ্ববর্তী হেমেজ মাউন্টেনের আগ্নেয়গিরি থেকে এক ভয়ানক অগ্ন্যুৎপাতের ফলে লাভা আর ছাই থেকে তৈরি হয়েছিল এখানকার পাহাড়শ্রেণী। এমনিতে জায়গাটা মরু অঞ্চল। নিউ মেক্সিকো আর পাশের রাজ্য এরিজোনার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েই এরকম ভূপ্রকৃতি। তবে পাহাড়ের গায়ে জুনিপার আর পন্ডেরোসা পাইনের অপরূপ সৌন্দর্য রুক্ষ এই অঞ্চলকে সুন্দর করে রেখেছে। শহরের একপাশে রয়ে গেছে ক্যালডেরা ভ্যালি আর এক পাশে হোয়াইট রক ক্যানিয়ন। সেখানে বয়ে যাচ্ছে রিও গ্র্যান্ডে (Rio Grande) নদী। কলোরাডোর রকি মাউন্টেন থেকে বেরিয়ে সে নদী আপন খেয়ালে ১৯০০ মাইল আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে মিশেছে গিয়ে গালফ অফ মেক্সিকোতে।

যখন এ জায়গায় শহর ছিলনা, তখনও শহরের আশেপাশে এবং পুরো নিউ মেক্সিকো রাজ্যেই ছিল আমেরিকান ইন্ডিয়ান তথা নেটিভ আমেরিকানদের বেশ কিছু উপজাতির বসবাস। তাদের প্রথম বসতি গড়ে ওঠে দশম শতকে। তারপর ষোড়শ শতকে ইউরোপিয়ানরা আসে সোনা ও রূপোর খোঁজে। দখল করে নেয় তাদের রাজ্যপাট। চলে আক্রমণ, অত্যাচার, ধর্মান্তরকরণ, লড়াই, যুদ্ধ। ভূমিপুত্রদের নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়া সে এক অন্য রক্তাক্ত ইতিহাস। কিন্তু দীর্ঘকাল স্প্যানিশ অধ্যুষিত থাকার ফলে সাউথ-ওয়েস্ট আমেরিকার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায়, ভাষায় ও সংস্কৃতিতে এখনো তার ছাপ আছে।

শহরের একটা গর্ব আছে এখানকার ল্যাবরেটরি নিয়ে। তার নাম লস আলামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি(LANL)। পৃথিবীর বৃহত্তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি। নিরন্তর গবেষণা চলছে সেখানে মানব-কল্যাণে। কেমন একটা অনুভূতি হয়েছিল যখন শুনেছিলাম এই ল্যাবরেটরি থেকেই তৈরি হয়েছিল প্রথম পরমাণু বোমা আর তা ফেলা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে। সেও এক অন্য ইতিহাস যা অন্যত্র লিখেছি। যে বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে বানানো হয়েছিল সেই পরমাণু বোমা, তাঁর নাম জে. রবার্ট ওপেনহাইমার (J.Robert Oppenheimer)। তার নামে একটি রাস্তা আছে শহরে – ওপেনহাইমার ড্রাইভ(Oppenheimer Drive)। সেটাই ছিল আমাদের এবারের ঠিকানা।

এই ল্যাবরেটরির কারণেই এই শহরে নিউ মেক্সিকোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত মানুষের বাস। সেটা শহরটাকে ভিতর থেকে ভালভাবে দেখলেও বোঝা যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে সবই যেন খুব শান্ত, সুন্দর আর ছিমছাম। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলে খুব নিরাপদ শহর। যেকোনো সময় একা একা হেঁটে যাওয়ায় কোনও ভয় নেই। এরকম নিরাপদ শহর খুব বেশি নেই আমেরিকায়। আগেরবার যখন নর্থ ক্যারোলিনার ডারহামে ছিলাম, সেখানটা কিন্তু এরকম নিরাপদ শহর ছিলনা। এবারেও প্রথমদিকে কিছুদিন আমেরিকার রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডি সি তে ছিলাম। সেখানেও নিরাপত্তার কারণেই সন্ধ্যার পর সব জায়গায় হেঁটে বেড়ানো চলেনা। যদিও সে শহর আয়তনে অনেক বড়ো। লস আলামসের আশেপাশের শহরগুলিও এতোটা নিরাপদ নয়। কিন্তু এই শহর এক অদ্ভুত ব্যতিক্রম। নিশ্চিন্তে বেরনো যায় যেকোনো সময় যেকোনো দিকে।

প্রকৃতি আর মানুষের অপূর্ব সহাবস্থানে সমৃদ্ধ এ শহর। বছরের বেশির ভাগ সময়টাই ঠাণ্ডা থাকে, চামড়ায়  টান ধরে। তাই জল খেতে হয় বেশি বেশি। ক্রিম ময়েশ্চারাইজার ইত্যাদি তো ব্যবহার করতেই হয়। একটু বেশি কাজকর্ম করলে অনেকে হাঁপিয়ে যান। উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও সেরকম হতে পারে। কখনো সেরকম রাস্তার পাশ থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সামনে এসে যায় দিঘল চোখের কোন হরিণ। কিছু কিছু জায়গায় বাড়ির খুব কাছেও চলে আসে তারা।

একদিন সময় এসে গেল আমাদের ফিরে আসার। তখন গ্রীষ্মকাল পড়ছে। রোদের তেজ বাড়ছে প্রতিদিন একটু একটু করে। ততদিনে সমস্ত বরফ ঝেড়ে গাছগুলি সেজে উঠেছে উজ্জ্বল সবুজে। শহরের প্রকৃতিকে সাজিয়ে দিচ্ছে নানারঙের ফুল। আর শীত-ঘুম ভেঙে জঙ্গলের রাস্তায় বেরিয়ে আসছে কিছু নিরীহ ভালুক আর সাপ(Rattlesnake)। শুনেছি, তারা নাকি মানুষের আওয়াজ পেলে সরে যায়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।