ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || আফ্রিকার ডায়েরি- ২ – সুব্রত সরকার

আফ্রিকা!..
আমাদের আফ্রিকান সাফারি কলকাতার কোনও ট্রাভেল সংস্থার সঙ্গে যেহেতু যাওয়া নয় , তাই ধীরে ধীরে সব নিজেদেরই করতে হয়েছে। গোছাতে হয়েছে।
আমেরিকা থেকে ডুলুং-সোহম (মেয়ে-জামাই) কলকাতায় ফিরে এসেছে ৭ মে, ২০২৫। তারপর আমাদের পরিকল্পনা পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। শুধু মাথায় রাখতে হয়েছিল ওদের দুজনের পেপার প্রেজেন্টেশনের তারিখ দুটো। যথাক্রমে ২৬ ও ২৮ জুন। কেনিয়ার নাইরোবি ইউনিভার্সিটিতে।
আমরা যাত্রা শুরুর দিন ঠিক করলাম ১৯ জুন, বৃহস্পতিবার। ফেরা ৩০ জুন, সোমবার।
কলকাতা থেকে সরাসরি নয়, মুম্বাই হয়ে নাইরোবির উড়ান ঠিক করে টিকিট কাটলাম প্রায় পঞ্চাশ দিন আগে। টিকিটের দাম পড়ল এক একজনের চল্লিশ হাজার দুশো টাকা। যাতায়াত সব ধরে। বিমান সংস্থা ইন্ডিগো।
আফ্রিকার ভিসার জন্য খুব ঝামেলা নেই। আমাদের দুটো দেশের ভিসা করতে হলো- কেনিয়া ও তানজানিয়া। অনলাইনেই করা হলো। কেনিয়ার ভিসা চটজলদিই হয়ে গেল। তানজানিয়ার ভিসা কিঞ্চিৎ দেরী হয়েছে। দুটো দেশের ভিসার খরচ সব মিলিয়ে এক একজনের পড়ল প্রায় সাড়ে ছ’হাজার টাকার মত।
এরপর এলো ইয়োলো ফিভার ইনজেকশন নেওয়ার পরিকল্পনা। আফ্রিকার জন্য এই ইনজেকশন নিতেই হবে। তাই জানতাম। কিন্তু নিতে গিয়ে দেখলাম, ওখানে একটা সুন্দর ম্যাপ সহ লেখা আছে আফ্রিকা মহাদেশের সব জায়গার জন্য জরুরী নয় ইয়োলো ফিভার ভ্যাকশিন। যেমন তানজানিয়া, জিম্বাবুয়ে, বোতসোয়ানা, মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, নামিবিয়া গেলে দরকার নেই। কিন্তু আমরা কেনিয়ায় যাব। তাই নেওয়াটা জরুরী। এছাড়া কঙ্গো, সাউথ সুদান, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, রাওয়ান্ডা, বুরুন্ডি, অ্যাঙ্গোলা, ক্যামারন গেলেও জরুরি ইয়োলো ফিভার ইনজেকশন। এই ইনজেকশন একবার নিলে নাকি জীবনে দ্বিতীয়বার আর নিতে হয় না!..
ইয়োলো ফিভার ইনজেকশন কোথায় নেওয়া যায়, খোঁজ খবর করে অনলাইনে ডেট বুকিং করলাম। ঠিক দশ দিন আগে ইনজেকশন নিতে হাজির হলাম খিদিরপুর মেরিন হাউসে। খুব সুন্দর ব্যবস্থা। জায়গাটাও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। নিতে কোনও অসুবিধা হলো না। এক একজনের তিনশো টাকা করে পড়ল। ইনজেকশন নেওয়ার আধঘন্টা পরে ইয়োলো কার্ড হাতে পেলাম। এটা খুব জরুরী, এয়ারপোর্টে দেখতে চাইবে। কার্ড হাতে পেয়ে আনন্দে তিনজনে একটা সেলফিও তুলে ফেললাম! আফ্রিকা যাওয়ার প্রথম ছাড়পত্র!..
ইয়োলো ফিভার ইনজেকশন নিলে কারও কারও সামান্য জ্বর, গা ব্যথা হয়। আমাদের তিনজনের সেরকম কিছু হয় নি।
মেরিন হাউসে সেদিন আমরা উপস্থিত ছিলাম মোটামুটি কুড়িজন। তারমধ্যে ট্যুরিস্ট হিসেবে ইনজেকশন নিতে এসেছিলাম আট- দশজন। একজন মহিলা ছিলেন তাঁর স্বামী কর্মসূত্রে মোজাম্বিকে আছেন, এবার তিনি যাবেন সে দেশে। মোজাম্বিকে যাচ্ছেন, না নিলেও হয়। কিন্তু তাঁর স্বামীর বদলির চাকরি। কখন আফ্রিকার কোন দেশে যেতে হবে, সে কারণে উনি নিয়ে নিতে এসেছেন। আর বাকিরা কাজের জন্য আফ্রিকায় যাচ্ছে। এই কাজের জন্য আফ্রিকায় যাচ্ছে এমন কয়েকজনকে দেখলাম খুব সাধারণ খেটে খাওয়া চেহারার যুবক। নিশ্চয়ই সেখানেও কোনও খেটে খাওয়া জীবন যাপনের কাজই করবে!.. জানি না কি কাজ? কত মজুরী বা বেতন! আফ্রিকা তো একটা গরীব মহাদেশ। তুলনামূলক ভাবে আমাদের থেকে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল। সেখানেও আমাদের দেশের যুবকরা যাচ্ছে কাজের জন্য!..
African Literature Association (ALA) থেকে সেমিনারে আসা সকলকে একটা নাইরোবির ট্যুর অপারেটরদের লিস্ট দেওয়া হয়েছিল। আফ্রিকায় ঘুরে বেড়াতে চাইলে এই সব ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো। যেহেতু আফ্রিকান লিটারেচার অ্যাসোসিয়েশন থেকে পাওয়া, তাই এর বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি। নচেৎ শুনেছি আফ্রিকায় অনেক ভুয়ো এজেন্সি আছে, যেখানে বুক করে বহু মানুষ ঠকেছেন। এয়ারপোর্টে নেমে দেখেছেন ওদের কোনও প্রতিনিধি দাঁড়িয়ে নেই!.. তাই আমরা এই ALA এর লিস্ট থেকে এক ট্রাভেল এজেন্সির ( Nylak Africa Safaris, Latifa Kadzo) সঙ্গে কথা শুরু করলাম। যাবতীয় কথাবার্তা ডুলুং-সোহমই করেছে। আমি আপডেটগুলো নিয়মিত পেতাম। অনেক কথাবার্তা ও আলোচনার পর একটা ভ্রমণসূচী তৈরী হল। যাওয়া-আসা নিয়ে মোট বারোদিনের সফর। শুরু হবে নাইরোবি থেকে, শেষও হবে নাইরোবি দিয়ে।
প্রথমদিন বিকেলে কলকাতা থেকে মুম্বাই হয়ে পরেরদিন ভোরে নামব নাইরোবির Jomo Kenyatta International Airport- এ । তারপর নাইরোবি থেকে সোজা মাসাইমারা। মাসাইমারায় দুদিন ভ্রমণ করে চলে যাব পড়শী দেশ তানজানিয়ায়। সেখানে প্রথম রাত থাকব মুসোমায় ভিক্টোরিয়া লেকের ধারে।
তার পরের দিন চলে যাব সেরেংগেটি। দু’রাত সেরেংগেটিতে থেকে চলে যাব গোরোংগোরো ঘুরে কারাটু। একরাত কারাটুতে কাটিয়ে পরেরদিন আরুষা, নামাঙ্গা বর্ডার পেরিয়ে ঢুকে যাব আবার কেনিয়ায়। তারপর পর পর তিনরাত নাইরোবিতে। ডুলুং-সোহমের আন্তর্জাতিক সেমিনার। এরপর আবার শুরু হবে কেনিয়া ভ্রমণ। একে একে দেখব লেক নাকুরু, লেক নাইভাসা ও অ্যাম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক দেখে শেষ হবে আমাদের বারোদিনের আফ্রিকান সাফারি। এই বারোদিনের সাফারিতে এক একজনের মোটামুটি খরচ পড়বে সব মিলিয়ে ৪০০০( চার হাজার)আমেরিকান ডলার। ভারতীয় টাকায় কমবেশি ৩,৫০,০০০/( সাড়ে তিন লাখ) টাকা।
এবার সব কিছু গুছিয়ে যাওয়ার দিন যত এগিয়ে আসছে, উত্তেজনা ও আনন্দ তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আফ্রিকা যাওয়ার একটা অন্যরকম আনন্দ উত্তেজনা মনের মধ্যে টের পাচ্ছি। বেশ ভালোও লাগছে। এমন এক সময়েই ঘটল বিরাট এক বিমান দুর্ঘটনা। আমাদের যাত্রা শুরু ১৯ জুন। দুর্ঘটনাটা ঘটল ১২ জুন। আমদাবাদ থেকে লন্ডনগামী এয়ারইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৭ ড্রিমলাইনার ফ্লাইটটা রানওয়ে থেকে টেক অফ করেই মুখ থুবড়ে পড়ল। ভয়ংকর দুর্ঘটনা। একজন ছাড়া বাকী সবাই ২৪২ জন যাত্রী নিহত হলেন। এত বড় বিমান দুর্ঘটনার খবরটা শুনে প্রাথমিক ভাবে খুব মন খারাপ তো হলোই, পরক্ষণেই মনের ভেতর কেমন গোপন ভয় এসে থাবা বসাল- আর কদিন পর আমরাও তো এমন বিমানে চড়ে উড়ে যাব কতদূরে!.. কি জানি কি হয়! কেমন এক ভয়!..
১৯ জুন বৃহস্পতিবার বিকেল চারটে দশে আমাদের প্রথম বিমান কলকাতা থেকে মুম্বাই। সময় মত পৌঁছে গেলাম নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে। তারপর বোর্ডিং পাস, লাগেজ চেক ইন, সিকিউরিটি চেকিং করে গিয়ে লাউঞ্জে বসলাম। বিমানযাত্রার এই পর্বটা সবচেয়ে বিরক্তিকর। কিন্তু মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়। কেমন অপরাধীর মত মনে হয় নিজেকে!
বিমান নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ল না। প্রায় পঁচিশ মিনিট দেরীতে ছাড়ল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে রানওয়ে ধরে ছুটতে ছুটতে টেক অফ করে আকাশে উড়ে গেল আমাদের ইন্ডিগো। এবার একটু শান্ত হলাম। আকাশে বিমান ভাসছে, মেঘের দেশে ছুটছে, আপাতত আড়াইঘন্টা আমরা ভেসে থাকব, ছুটে বেড়াব। এই সময়টুকু বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য খুব ভালো। ইন্ডিগোর বসার জায়গায় সামনে কোনও মনিটর নেই। তাই সিনেমা দেখা, রুট ম্যাপ দেখা যায় না। বিমানের মধ্যে বসে রুট ম্যাপ ফলো করা আমার এক প্রিয় নেশা। এর আগে মিশর, আমেরিকা, জাপান ভ্রমণে বিমানে বসে রুট ম্যাপ দেখতে দেখতে মহানন্দে দীর্ঘ প্লেন সফরগুলো করেছি। এবার তা না পেয়ে একটু মন খারাপ। অগত্যা মোবাইল ফ্লাইট মোডে রেখে শান্ত হয়ে বসে থাকা। আমার সিট জানলার ধারে। ডুলুংরা সিটটা আমাকে উপহার দিয়েছে। ছোট্ট জানলাটা দিয়ে মেঘের রাজ্যের কত মেঘবালিকা, মেঘকন্যা, মেঘদূতদের দেখতে দেখতে চললাম! এভাবে পৌঁছেও গেলাম মুম্বাই। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের রানওয়েতে প্লেন যখন ল্যান্ড করছে ছোট্ট জানলাটা দিয়ে দেখলাম তুমুল বৃষ্টি বাইরে। ঝাপসা চারপাশ। মুম্বাই ভেসে যাচ্ছে। সেই বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছোট্টবেলার ছড়াটা গুন গুন করে উঠল বুকের পাঁজরে…’ আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে!..’ কতকাল পরে এমন শিশুমনের আনন্দ এসে হৃদয় উতল করে দিল!..
মুম্বাই এয়ারপোর্টে এবার অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে, যাকে বলে লেওভার। প্রায় ছ’ঘন্টার অপেক্ষা।
এখানে আবার লাগেজ চেক ইন, বোর্ডিং পাস, সিকিউরিটি চেক, ইমিগ্রেশন সব করিয়ে একটু শান্ত হয়ে বসে ম্যাকডোনাল্ডে ডিনার করলাম। এয়ারপোর্টে খাওয়া মানেই টাকার শ্রাদ্ধ!.. তবু খেতে তো হয়!..
রাত দুটো দশের ইন্ডিগোতে উঠে বসলাম। মুম্বাই-নাইরোবি সাড়ে পাঁচ ঘন্টার সফর। কাল ভোরে নামব নাইরোবি। এবার টাইমজোনের তফাৎ ঘটে যাবে মাঝ আকাশেই। কেনিয়ার সঙ্গে আমাদের সময়ের ব্যবধান আড়াই ঘন্টার। আমরা কাল ভোর ৫.৪০ এ নামব নাইরোবিতে। কলকাতায় তখন হবে সকাল ৮ ১০। এয়ারপোর্টে নেমেই হয়তো আকাশে রবির দেখা পেয়ে যাব। তখন হেসে বলব, ‘রবির দেখা পেলাম নাইরোবিতে নেমেই!..’
ইন্ডিগোতে সফর এখন খানিকটা “এসো, বসো, নেমে যাও!..” নূন্যতম চা- কফি একটা কুকিজও দেয় না!… সব আলাদা করে কড়ি ফেলে কিনে খাও!.. এবং তা মহামূল্য। টিকিটের যা মূল্য নেয় তাতে এই সামান্য চা- কফির পরিষেবাটুকু একবার দিতেও এত কার্পন্য কেন বুঝতে পারি না!…
নাইরোবির ভোরের আকাশ দেখতে দেখতে মহাশূন্য থেকে নামছি..রানওয়ের কাছাকাছি যখন চলে এসেছি ভোরের অস্ফুট আলোয় আমার এতদিনের স্বপ্নের আফ্রিকাকে ঘুম ভাঙ্গা চোখে মুগ্ধ হয়ে দেখছি। আহা! সে কি আনন্দ!.. কি মুগ্ধতা! আমি চলে এসেছি আফ্রিকা!..
অবশেষে এলাম তোমার কাছে হে আফ্রিকা!..
“জাম্বো!.. জাম্বো!.. কারিবু!…”বাতাসে ফিস ফিস করে ভেসে এলো কথাগুলো!..
ক্রমশ..