।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় শর্মিষ্ঠা সেন

ঝানুর মানরক্ষা

আর একটু হলেই গেছিল আর কি! ঠিকঠাকই নামছিল গাছ থেকে হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কে যেন ফোঁত করে শ্বাস ছাড়ল একটা৷ অথচ ঝানু কাউকেই দেখতে পেলনা! আগেও পায়নি৷ দিনেমানে যেমন তেমন, ভোররাতে কাজে নামলেই আজকাল কে যেন সাথে সাথে থাকে আর পুটুস পাটুস মন্তব্য করে৷ মহাজ্বালায় পড়েছে যাহোক৷ খেঁজুর রসের হাঁড়িগুলো দুহাতে তুলে চম্পট দিল ঝানু চোর৷
ঝানুরা সাতপুরুষ ধরে চোর৷ ঝানুর বড় ঠাকুদ্দা অর্থাৎ কিনা ঝানুর বাবার ঠাকুদ্দা তখনকার জমিদারের থেকে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন৷ তাঁর নামও ছিল ঝানু৷ তা সেই ঝানু ওস্তাদ অতি বড় নমস্য ব্যক্তি ছিলেন, আর পাঁচ গাঁয়ের চোরেরা তাঁর নাম মুখে নিলে জিভ কেটে কানে হাত দিত৷ জমিদার বাবুর সামনে থেকে রুপোর গড়গড়া চুরি করা তো চাট্টিখানি কথা নয়! যখন নায়েব, গোমস্তা, বাজার সরকার টের পেত তখন নজর করে দেখা যেত জমিদার বাবুর হাতে কোলবালিশের দড়িখানা, মৌজ আসছে না দেখে জমিদার তাকিয়ে দেখেন দড়ি চিবিয়ে ছিবড়ে করে ফেলেছেন! এমন ছিল সেই ঝানুর হাতের কাজ৷ তবে চোর, ডাকাত, লিখিয়ে, গাইয়ে, বাজিয়ে যেই হোক না কেন আগের দিনে লোকে গুণীর সম্মান দিতে জানত৷ ঝানুওস্তাদকে রীতিমতো নেমন্তন্ন করে ভরপেট খাইয়ে, পাঁচশো কাঁচাটাকা নগদ, দুটো দুধেল গাই আর শাল দোশালা দিয়ে বিদেয় দেওয়া হয়েছিল৷
সেই সব দিন আর কোথায়! এখন গাঁ গঞ্জেও বাতির আলো৷ রাতদুপুর পর্যন্ত ছেলেছোকরারা কেবল টিভি আর মোবাইল খুটখুট করে৷
ঝানুর বাবা বলে, “আমাদের ঝানু হল বংশের কলঙ্ক৷ চোরের হাতযশ থাকলে মোবাইল হাতিয়ে চশমার খাপ ধরাতে কতক্ষণ? লাইটের পোলের থেকে তার কেটে তামা বার করে গলিয়ে বেচতে কতক্ষণ?”
আসলে ঝানুর চেহারা হল ওর সবথেকে বড় শত্তুর৷ সে যেমন লম্বা তেমন চওড়া৷ কালো কুচকুচে ঘন কোঁকড়া চুল, মাথাও তেমনি মোটা! জন্মের সময় সেই যে বুদ্ধিশুদ্ধি মাথায় সেঁধিয়েছিল তা আর বেরোতে পারল কই! চোরের মাথা হবে ছোট্ট বেলের মতো, চুল থাকবে অল্প, চেহারা হবে যেমন পাতলা তেমন হালকা, খানিকটা ওই পালকের মতো৷ যেন থেকেও নেই! যেন না থেকেও আছে! গায়ের রং হবে ছায়ার মতো, এই আছে এই নেই । লোকের ভীড়ে মিশে থাকলে মনে হবে যেন খিচুড়িতে নারকেলকুচি, যেন চাটনিতে আমস্বত্ব, যেন পাপড়েতে গোলমরিচ, যেন জিলিপিতে রস! ঝানুর বাপ ঠাকুদ্দারা ছিল অমন ধারার৷ ঝানু তার খান্ডারনী মায়ের ধারা পেয়েছে৷ মামাবাড়ি ডাকাতের বংশ৷ স্থূল ব্যাপার স্যাপার তাদের৷ মারামারি, কাটাকাটি, রক্তারক্তি! একেবারে ল্যাটাপ্যাটা কান্ড! চুরিবিদ্যের শিল্প তাদের নেই৷ ঝানু বাপের বাড়ির সকলের দেহের ঘাটতি মামারবাড়ির ধারা পেয়ে যেন এজন্মে পুষিয়ে দিয়েছে৷ তবে বাপের বা মায়ের, কারোর বাড়ির গুণপনা সে পায়নি৷ বউ ঠেলে গুঁতিয়ে পাঠালে তবে সে চুরি করতে বেরোয়, তাও চুরি করে হজম করতে পারেনা!
ঝানুর হাতের কাজও মোটা৷ এই যেমন গত হপ্তায় শ্যামাপদর বাড়ী থেকে বারোটা লাউ, একবস্তা শিম আর দুই পোঁটলা গয়না বড়ি চুরি করে এল কিন্তু রাখবি তো রাখ লাউএর মাচায় কাস্তে রেখে এল! সকালে শ্যামাপদর মা কাস্তে হাতে সটান ঝানুর বাড়িতে হাজির৷ নাতজামাই আসবে, বুড়ি জামাইকে বড়ি দিয়ে লাউঘন্ট আর শিম চচ্চড়ি খাওয়াবে বলে নিজে হাতে গোবর জল দিয়ে ফসল ফলিয়েছে, এখন চুরি করে নিলেই হল? জামাই বাবাজী শান্তশিষ্ট বোষ্টম, নিরামিষ ভোজী, তবে শ্যামাপদর মা তেজী মানুষ, বুড়ীর শাপ শাপান্তির চোটে ঝানু নিজেই চুরির মাল বার করে দিল শেষমেষ! এই তো রোজগারের অবস্হা!
বুড়ী অবশ্য দুটো লাউ ঝানুর বউকে দিয়ে এসেছিল৷ ছেলেপুলের ঘর৷ অমন সবটুকু চেঁছেপুঁছে আনা যায় নাকি! সে যতই নিজের জিনিস হোক৷ এখনও অতটা খারাপ হয়নি মানুষ৷ দয়া ধম্ম, ইহকাল পরকাল বলে কিছু আছে তো, নাকি? গাঁ দেশে দু একজন চোর ছ্যাঁচড় না থাকলে হয়না৷ মানুষ সজাগ থাকলেই হল! চোর তো নেবেই, আরে বাবা যতই দারোগা পুলিশ করো, সাতপুরুষের পেশা তো আর দুম করে ছেড়ে দিলে হ’ল না! অভ্যাস বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। রাত হলে রক্তে নেশা জাগবে না? দুটো একটা চুরি হবে, জীপগাড়ি চড়ে দারোগা বাবু আসবেন, জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, পঞ্চজনেরা তাঁদের সন্দেহের কথা বলবেন, আশেপাশের চার পাঁচ গ্রাম জানবে, আলোচনা হবে, তবে না গ্রামের নামডাক হবে৷ তা বাপু, চুরির বদনাম ছড়ালেও ‘নাম’ হয় বৈকি !
তবে এসব লোকের কথা৷ ঝানুর নিজের মনের কথা সে-ই জানে৷ মুখ চুন করে উঠোনের এক কোনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিল সে ৷ আসলে সেদিনও কে যেন ঘাড়ের ওপর ফোঁত করে নিশ্বাস ফেলেছিল আর পুটুস পাটুস মন্তব্য করছিল, তারপর থেকে হয়েই চলেছে৷
বেলার দিকে ঘুম থেকে উঠে ঝানু আর তার বুড়ো বাপ কানু ঝোলা খেজুরের গুড় দিয়ে সরুচাকলী খাচ্ছিল, হঠাৎ কানের কাছে কে যেন পিনপিন করে বলে উঠল , “বাবা ঝানু! নাম যে আর রাখা যাচ্চেনাকো ! বাপ পিতেমোর এমন অপমান আর সহ্য হচ্ছেনি৷ কিছু করা লাগে এইবেলা!” একসাথে এতকথা শুনে ঝানু চমকে হাত থেকে থালা ফেলে দিচ্ছিল আর কি৷ তবে বোকা হওয়ারও সুবিধে আছে৷ ঝানু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আওয়াজ টা বলল, ” বেজায় গতর খানা বাপু তোমার! এট্টু খাটাইলেই তো হয়৷ লোকের বাড়ির কলাডা, মূলোডা কি তোমার চুরি করা সাজে! কত বড় বাড়ির পোলা তুমি!”
ঝানু আন্দাজ করে এ তার বড় ঠাকুদ্দা না হয়েই যায় না৷ সে এঁটো হাতেই উপুড় হয়ে পেন্নাম ঠেকায়৷ ব্যাপার দেখে কানুর চোখ ছানাবড়া! সেও খাওয়া থামিয়ে ঝানুর কান্ডকারখানা দেখতে থাকে৷
এদিকে ঝানুর বউ চা দিতে এসে দেখে ঝানু একা একা বকবক করছে আর মুচকি মুচকি হাসছে৷ বেচারী বউটা ঘোমটা টেনে চোখের জল মুছে আবার রান্নাঘরে সেঁদিয়ে গেল৷ কী সুন্দর কুঁদুলে শাশুড়ীটা ছিল তার! না হয় ছেলেকে নিয়ে একটু আদিখ্যেতা করত কিন্তু পাড়ার লোকের ক্ষমতা ছিলনা চুরির মাল ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়! এখন ঝানুর মাথা খারাপ হলে ঝানুর ছেলে পানুর কি হবে ভেবে ঝানুর বউ বুক চাপড়ে কেঁদে ভাসাল! সেদিন আর ঘরে হাঁড়ি চড়লনা!
কয়েকদিন পর ছিদাম মুদীর বাড়ি থেকে এক মণ জ্বালানী কাঠ কে যেন হাপিশ করে দিল৷ অনেক দিন পর গাঁয়ে বেশ একটা হইচই পড়ে গেল৷ সবাই এককথায় বলল , “হ্যাঁ, চুরি হতে হয় এমন! ঘরের দুয়োর থেকে একমণ কাঠ হাপিস করা চাট্টিখানি কথা নয়!” এদিকে ঝানুর বউ খুঁজে পেতে ঝানু কিছু আনেনি দেখে সেই ছিদাম মুদীর দোকান থেকেই ধার বাকীতে সওদা আনতে ছুটল আর ভাবল এমনিতেই ঝানু চুরি করতে যায় না, তার উপর এখন আবার নতুন এক প্রতিযোগী জুটল! কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কি!
ক্রমে দেখা গেল গাঁয়ে এক নতুন চোরের আমদানী হয়েছে যে কিনা গোরু সমেত গরুর গাড়ী হাওয়া করে দিচ্ছে, একপুকুর মাছ রাতারাতি হাপিস করে দিচ্ছে, মাচা সমেত লাউ কুমড়ো,পটল সাফা করে দিচ্ছে যেন কস্মিনকালেও সেখানে কোন গাছ গাছালি ছিল না৷ মায় রাস্তার খাম্বা সমেত বাতিগুলো পর্যন্ত হাওয়া! শেষমেষ যেদিন শোয়েব আলীর নতুন ট্রাকটর গায়েব হয়ে গেল সেদিন লোকেরা বলল, “নাহ্! এইবার এর বিহিত হওয়া প্রয়োজন৷”
গ্রামের লোকজন রীতিমতো দলবেঁধে দশমাইল দূরের থানায় গেল খবর দিতে৷ দারোগা এসে প্রথমেই ঝানুর বাড়ি খানা তল্লাসী করলেন৷ কিন্তু করলে কি হবে? ঝানুর বাড়ি থেকে বরং বেরোলো মাত্র বারোটাকা পঁচাত্তর পয়সা, সাতপুরোনো বাসনপত্তর আর কাস্তে, খন্তা, সিঁদকাঠি! লোকজন মায় দারোগা পর্যন্ত ঝানুর এমন অধঃপতনে দুঃখিত হলেন৷ গ্রামের সবাই একমত হলো এমন পুকুরচুরি বোকা সোকা ঝানুর পক্ষে সম্ভবই নয়, তার ওপর সে এখন খ্যাপা গোছের হয়েছে সকাল বিকেল শুধু শরীর চর্চা করে আর বিড়বিড় করে আপন মনে বকতে থাকে৷ দারোগাবাবু দুজন রোগা সোগা সেপাইকে গ্রামের পাহারায় বসিয়ে গেলেন৷ তারা সাইকেল চড়ে বাঁশী বাজিয়ে রাতে ঘুরে বেড়াবে৷
কিন্তু দুদিন পর সেপাই দুজনারই সাইকেল চুরি হয়ে গেল৷ সারারাত পাহারার পর তারা বিড়ি মুখে ঝোপের আড়ালে হালকা হতে গিয়েছিল, ফিরে এসে দ্যাখে সাইকেল হাওয়া! সাথে সাইকেলে ঝোলানো ব্যাগ, বারো ব্যাটারির বড় টর্চ, হাতের লাঠি বেবাক হাওয়া! সেপাই দুজন অপমানের একশেষ হয়ে হাঁটা দিয়েছিল৷ খবর পেয়ে ফচকে ছোঁড়ারা মহা উৎসাহে তাদের গাঁয়ের সীমানা পার করে দিয়ে এল৷ বুড়োরা, যারা এ যাবৎ কিছু করার না পেয়ে ঘরে বসে ঝিমোচ্ছিলো তারাও বটতলায় বসে দুনিয়ার চুরি ডাকাতির গল্প শুরু করে দিল৷ ধীরে ধীরে তাদের জিভের আড় ভাঙতে লাগল, শরীর মন মেজাজ চনমনে হয়ে উঠল আবার৷ তারা সবাই মিলে নতুন এক সমিতি গড়ে ফেলল অল্প দিনে৷ নাম দিল “প্রবীণজন বৈঠক।” সেখানে ঠিক করা হল ঝানুকে গিয়ে অনুরোধ করা হবে গাঁয়ের চুরির দায়িত্ব সে ই যেন নেয়৷ যা চুরি করবে সব তার৷ কেউ যাতে গিয়ে ঝগড়া করে চুরির দ্রব্য ফেরত না আনে সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হল৷ বাইরের চোর এসে এমন লুটপাট করে নিয়ে যাবে ঝানু থাকতে এ আর সহ্য হচ্ছেনা! ব্যাপার শুনে ঝানু মলিন হেসে একমনে বিড়ি টানতে লাগল। তার আর এসব চুরি টুরিতে কোন উৎসাহ নেই৷
তবে বছরখানেক পর থেকে চুরিচামারি বন্ধ হয়ে এল৷ একেবারে বন্ধ হয়নি যদিও তবে চুরির ধরন দেখে লোকে পরের চুরির অপেক্ষায় থাকে৷ শেষ চুরি হয়েছিল নিতাই সাহার ইঁট ভাঁটায়৷ পাঁচহাজার ইঁট একরাতে হাওয়া! অথচ একটু দূরেই সেদিন নিতাই সাহার উদ্যোগে কলকাতার বিখ্যাত ঝালাপালা নাট্যসমিতির ‘শচী মায়ের চোখের মণি, মা রে থুয়ে কোথায় গেলি’ যাত্রাপালা হচ্ছিল সারারাত, লোকজন ছিল মেলাই৷ ভোর রাতে পালা শেষ হওয়ার পর সবাই নজর করল ইঁটের পাঁজাও ফর্সা হয়েছে! আহা! চুরি তো নয়, ভানুমতীর খেল! নাকের ডগা থেকে নিয়ে গেল গো! এ যেন নাকের নীচে থেকে আলগোছে গোঁফ চুরি! লোকজন বাহবা দিল প্রাণ ভরে৷
এদিকে আর কোনো উপায় না দেখে ঝানুর বুড়ো বাপ কানু গঞ্জে দোকান দিয়েছে একখান, “হরহরি রকমারী ভান্ডার”, যদিও ব্যবস্হা সব ঝানুরই করা, তবে তাতেই সংসারটা টিঁকে আছে আর কি৷ ঝানুর বউ আর ধারবাকীতে সওদা করতে যায়না, সে বিকেলবেলা গা ধুয়ে পান চিবোতে চিবোতে ঝানুর সাথে সুখ দুঃখের গল্প করে আর সন্ধ্যায় শ্বশুর ফিরলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে টিভিতে রাণী রাসমণি দ্যাখে৷ পানু এখন গাঁয়ের ইস্কুলে ক্লাশ সিক্স এ পড়ে৷ রোজ মাছভাত খেয়ে সে ইস্কুল যায়৷ পানু ওরফে প্রানহরি বড় হয়ে শহরে যাবে, মস্ত চাকরী করবে নয়তো ব্যাবসা করবে, বুড়ো ঠাকুদ্দার সাথে এ ব্যাপারে ঝানুর কথা হয়ে গেছে৷৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।