ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২৫)
তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম
বীরভূমের অন্যতম শক্তি ক্ষেত্র তারাপীঠের মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে ফুল পাথরের অলংকরণ দেখা যায়। রামায়ণ, মহাভারত ও বহু পৌরাণিক ঘটনাবলী থেকে গৃহীত কাহিনীগুলি অনবদ্য শিল্প সুষমায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুন দক্ষতায়। এগুলির মধ্যে আছে রাম রাবণের যুদ্ধ, ভীষ্মের শরশয্যা, যোদ্ধা অর্জুনের শর নিক্ষেপ করে পাতাল থেকে পিতামহের জন্য পানীয় জল উত্তোলন, মহিষাসুর বধে দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা মায়ের অপূর্ব রূপ, রাধা কৃষ্ণ লীলা ইত্যাদি।
নানুরের বাসুলি মন্দির সংলগ্ন দুটি আটচালার শিব মন্দির, লাভপুরের ফুল্লরাতলায় একটি মন্দির, সুরুলের মন্দির রাজি, ইলামবাজারের লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির, ইলামবাজার হাট তলায় অষ্ট কোণাকৃতি গৌরাঙ্গ মন্দির, ইলামবাজারে বামুনপাড়ার শিবমন্দির, ঘুড়িষার রঘুনাথজী মন্দির প্রভৃতি মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে ফুল পাথরের কাজ দেখা যায়।
মন্দিরের ফলক গুলির চিত্র থেকে এই ধারণা জন্মায় যে, মন্দির স্থপতি, শিল্পী ,স্থানীয় জনসাধারণ বা মন্দিরের দর্শনার্থীরা মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ দৃশ্যাবলীর সঙ্গে কমবেশি পরিচিত ছিলেন।
সাধারণ দর্শনার্থীরা তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও গ্রামের চন্ডী মন্ডপে কথকতা, রামায়ণ গান, কৃষ্ণ লীলা, ভাগবত পাঠ যাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে পৌরাণিক কাহিনীগুলি সম্পর্কে পরিচিত ছিলেন বলে শিল্পকর্ম গুলি বুঝতে তাদের কোন অসুবিধা হতো না বলেই মনে হয়।
আগে বৌদ্ধস্তূপের চারিপাশে অলংকরণের মাধ্যমে বুদ্ধদেবের জীবন কথা ব্যক্ত করার চেষ্টা করা হতো।
গ্রামাঞ্চলে দীঘল পটের উপর চিত্রিত রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, মনসামঙ্গল কাহিনী,যমপট ইত্যাদি চিত্রবিদ্য দর্শন, পটুয়াদের গলায় পটের গান শ্রবণ ইত্যাদির মাধ্যমে জনসাধারণ পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত হত।
মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ দেব-দেবী এবং নর নারীদের বেশভূষা অঙ্গসজ্জা ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নির্দেশ করে, নির্দেশ করে ইতিহাস ও সমাজের ধারা।
মন্দিরের দেওয়ালের চিত্রশিল্পীরা মূলত ছিলেন সূত্রধর সম্প্রদায় ভুক্ত।তাঁরা কাঠ, পাথর, মাটি ও চিত্র এই সমস্ত মাধ্যমেই পটু ছিলেন।
সূত্রধর সমাজের চিত্রবিদ্যা চর্চার কথা কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে উল্লেখিত আছে।
এই সূত্রধর সমাজ চিত্রশিল্পের প্রাচীন ধারাটিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন।
মন্দিরের প্রবেশদ্বারের কাঠের চৌকাঠে ও কপাটের পাল্লায় এই সমস্ত সূত্রধর শিল্পীরা উৎকীর্ণ করতেন ফুল লতাপাতা ,বিভিন্ন পশু পাখির নকশা, দেবদেবীর মূর্তি ইত্যাদি। মন্দিরের মূল দরজার কপাট নির্মিত হতো প্রবেশ পথ অনুযায়ী। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশপথের উপরে
অর্ধগোলাকৃতি খিলান থাকলে, উপরের অংশ অর্ধ বৃত্তাকার হোত। এই সমস্ত দরজার গায়ে ফুটিয়ে তোলা শিল্পকর্ম গুলির
সঙ্গে মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা বা ফুল পাথরের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা চিত্র গুলির অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়।
এই সমস্ত দরজাগুলির কপাটে ফুল লতা পাতার নকশা, দশাবতার মূর্তি, কৃষ্ণ লীলা, মহিষ মর্দিনী দুর্গা, মকর পৃষ্ঠে গঙ্গা, ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ, ব্রহ্মা-বিষ্ণু প্রভৃতি ফুটিয়ে তোলা হতো কাঠ খোদাই করে।
পৌরাণিক দেবদেবীর মতো লৌকিক দেবদেবী যথা শীতলা ,ষষ্ঠী ,মনসা, পঞ্চানন্দ প্রভৃতি মূর্তি ও ফুটিয়ে তোলা হত।
বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে স্থাপত্যে ইউরোপীয় প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে, একথা আমরা আগেই জেনেছি।
চলবে