গল্পেরা জোনাকি তে শম্পা সাহা

কড়া দিদিমণি

“ওই মেয়েছেলে নিয়ে আমি আর সংসার করতে পারবো না বাবু! তোরা বরং আলাদা হয়ে যা।”

“মা,অবুঝের মত কথা বোলোনা তো! আমি আলাদা হলে তোমাকে কে দেখবে?”

“আমি ওসব জানি না।এ সংসারে হয় ও থাকবে নয় আমি! তখনই পই পই করে বারণ করেছিলুম।বিয়ে করিস না, করিস না।শুনলি না।ডিভোর্সি মেয়েছেলে কি আর সংসার করতে পারে রে..”

“মা,তুমি চুপ করো। কি যা তা বলছো!”

“ঠিকই বলছি।ওসব ঘর জ্বালানি, পর ভালানি মেয়েছেলে যদি অতই ভালো হতো তো ওই বর কি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করে দিতো?”

“মা,ও নিজে চলে এসেছে ওখান থেকে।তুমি সবটাই জানো।জেনে এসব বলছো কেন?”

“জানলে কি বলতুম রে..।ওর মুখে বিষ! আমি ওর সঙ্গে ঘর করবো না,এই বলে দিলুম!”

বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঋতজার বর আর শ্বাশুড়ির মধ‍্যে কথাকাটাকাটি চলছে।কারণটা ঋতজা নিজে।যদিও তাতে ঋতজার মোটেই কোনো লজ্জা বা আক্ষেপ নেই।

আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে দুটো অল্পবয়স্ক মেয়ে ,নেহাতই কলেজ ছাত্রী তারা ঋতজার সঙ্গে একসাথেই বাস থেকে নামে।নামার সময় বাস কন্ডাক্টর ইচ্ছে ক‍রে একটি মেয়ের বুকে হাত দেয়।

মেয়েটি প্রতিবাদ করায় কন্ডাক্টর দোষ তো স্বীকার করেই না উল্টে মেয়ে দুটো অসভ‍্যের মত গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল বলে উল্টো দোষারোপ করে।

ব‍্যস ! ঋতজা কয়েক পা এগিয়ে এসেছিল,ফিরে গিয়ে দু চড় সপাটে কন্ডাক্টর এর গালে।যদিও সে লোকটি,আমি গরীব,টরীব বলে সহানুভূতি কুরানোর চেষ্টা করে।কিন্তু ঋতজা চিৎকার করে,”প্রায় দিনই বাসে আপনি এরকম করেন বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে।কেউ প্রতিবাদ করেনি, তাই আমিও কিছু বলিনি।কিন্তু আজ হাতেনাতে ধরা পড়েছেন।এই চড় দুটো ওই বাচ্চা মেয়েগুলোর হয়ে আমার প্রতিবাদ!”

গণ ধোলাই হয়তো হতো,কিন্তু ঋতজা পুলিশে ফোন করে ,সেই লোককে পুলিশের হাতে তুলে দেবার ব‍্যবস্থা করে।

এই খবর লতায় পাতায় এ কান সে কান হয়ে যখন শ‍্যামলী দেবীর কানে পৌঁছায় ততক্ষণে সেটা তিল থেকে তাল হয়ে গেছে।লোকে ফোন করে করে জানছে! ছি,ছি লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে শ‍্যামলী দেবীর।

সেই নিয়ে দু কথা শোনাতে গেছিলেন বৌমাকে,”ঘরের বৌ,ও সব কি? একবার ঘর ভেঙেছে, এবার তো একটু সমঝে চলা উচিৎ!”

ও বাবা,কার কি? কথায় বলে না, চোরায় না শোনে ধর্মের কথা! উল্টে ঋতজা সাফ জানিয়ে দিয়েছ,”এরকম আবার দেখলে,আবার চড় কষাবো!”

শ‍্যামলী দেবী মোটেই এই বৌ নিয়ে সংসার করতে পারবেন না।একে তো ডিভোর্সি।বাবু যে কি দেখলো ওই বুড়িটার মধ‍্যে কে জানে? ভেবে পান না শ‍্যামলী দেবী। ও কি বৌ না আগুনের খাপড়া! একে ডিভোর্সি, আমার বাবু দয়া করে বিয়ে করেছে, কোথায় মাথা নিচু করে থাকবি!ওর দয়াতেই তো আবার মাথায় সিঁদুর পরতে পারছিস! তা নয়! বাবা গো বাবা! কি মুখ!

ভয়ংকর বিদ্রোহী শ‍্যামলী দেবী।হয় এসপার নয় ওসপার!

সেই দিনের ঘটনার পর থেকে আর শাশুড়ি বৌমাতে কথা নেই।শ‍্যামলী দেবী যদিও ঠারেঠোরে অনেক কথাই শোনান তা বৌমার কান পর্যন্ত পৌঁছায় কিনা শাশুড়ির সন্দেহ কারণ ঋতজার কোনো হেলদোল নেই।সে যেন এক অন‍্য রকম মানুষ।

প্রথম বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ডিভোর্স।প্রথম স্বামী চায়নি ঋতজা তার বাবা মাকে তার মাইনের অর্ধেকটা দিক।কিন্তু ঋতজার এক কথা,”বাবা মা আমাকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন।এটা আমার কর্তব্য”!

এই নিয়ে রোজকার অশান্তি শেষে ডিভোর্স।অরিন্দম কে বিয়ে করতে ঋতজা মোটেই রাজী ছিল না।কিন্তু অরিন্দম ঋতজার মধ্যে দেখতো এমন একজন কে, যে শুধু একজন মেয়ে নন,একজন সম্পূর্ণ মানুষ।ঋতজার এই অনমনীয় মনোভাবই অরিন্দমকে আকর্ষণ করে ওর প্রতি।

ঋতজাকে বোঝাতে না পেরে শেষে ওদের বাড়িতে হানা দেয় অরিন্দম।ওর বাবা মা মেয়ের জন্য যথেষ্ট চিন্তিত তাছাড়া মেয়ের ডিভোর্সের জন্য ওনারা মনে মনে নিজেদেরই দায়ী করতেন।

তাই অরিন্দমকে পেয়ে ওনারা যেন হাতে স্বর্গ পেলেন।ব‍্যস ওদের বিয়েটা হয়ে গেল।

অরিন্দম কখনো ঋতজার রোজগার, মাইনে নিয়ে কিছু বলতো না।কিন্তু ঋতজা নিজে থেকেই সংসার চালানোর জন্য দশ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে অরিন্দমের হাতে দিত।অরিন্দম বার দুয়েক না করেছিল,কিন্তু ও শোনেনি।ওর সাফ কথা,”আমি চাকরি করি,আমার খরচ তুমি কেন চালাবে?”

ওরা দুজনেই সংসারে সমান খরচ দিত।উপহার বাদে আর কখনো ঋতজা অরিন্দমের থেকে কিছু চাইতো না।আবার নানা উৎসব উপলক্ষে শ‍্যামলীদেবী বা অরিন্দমের জন্য নিজে থেকেই কেনাকাটা করে আনতো।

কিন্তু যতই করুক,শ‍্যামলীদেবী কিছুতেই ঋতজাকে মেনে নিতে পারেননি।ডিভোর্সি ভাবলেই মনটা জ্বলে পুড়ে যেত শ‍্যামলীদেবীর।আইবুড়ো ছেলে কেন এক এঁটো মেয়েমানুষ বিয়ে করবে? এই মত থেকে শ‍্যামলীদেবী কোনোদিন সরে আসেননি।

সেই ঘটনার দিন পনেরো পরে,অরিন্দম অফিসের কাজে ব‍্যাঙ্গালোরে।ঋতজা নিজের কাজে ব‍্যস্ত।শাশুড়ির সঙ্গে তার কথাবার্তা বন্ধ থাকলেও দায়িত্বে কোনো ত্রুটি নেই আবার মন পাবার বাড়তি আদিখ্যেতাও না।

হঠাৎই মাঝরাতে টয়লেট যেতে গিয়ে শাশুড়ির ঘর থেকে একটা শব্দ পেয়ে ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে উঁকি মারে ঋতজা।একি শ‍্যামলীদেবী ওরকম করছেন কেন?

ঋতজা ছুটে যায় ঘরে,”মা আপনার কি হয়েছে, শরীর খারাপ করছে?” শ‍্যামলীদেবীর ততক্ষণে কথা আটকে এসেছে, উনি কিছু একটা বলতে চান কিন্তু পারেন না, তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন বিছানায়।

ঋতজা তাড়াতাড়ি একটা উবের বুক করে,কোনোরকমে পোশাক পাল্টে, ড্রাইভারকে সঙ্গে করে শ‍্যামলীদেবীকে গাড়িতে তুলে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে নিয়ে যায়।

আ্যাম্বুলেন্সেও ফোন করেছিল ,কিন্তু পায়নি।গাড়িতে যেতে যেতে অরিন্দম, পরিচিত বন্ধু যাদের দরকার লাগতে পারে সবাইকে ফোন করে।

হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে পৌঁছলে, সঙ্গে সঙ্গেই চেকাপ করে ভর্তি করা হয়।যদিও ওরা যখন হাসপাতালে পৌঁছায় তখন ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার কেউ ছিল না।

ঋতজা রীতিমতো চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেয়।সেই হই হট্টগোলের মধ্যেই দুয়েকজন বন্ধু চলে আসেন।ফলে শ‍্যামলীদেবীর চিকিৎসা প্রায় সময় মতোই শুরু হয়।

পরদিন সকালের ফ্লাইটেই অরিন্দম ফিরে আসে।দুদিন সেন্সলেস থাকার পর জ্ঞান ফেরে শ‍্যামলীদেবীর।ম‍্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন।সময় মতো চিকিৎসা শুরু না হলে কি হতো বলা মুশকিল!

জ্ঞান ফিরেই শ‍্যামলীদেবী ছেলেকে দেখতে পান কিন্তু ঋতজা, সে কোথায়?

ঋতজা কে খোঁজ করতে দেখেন বৌমা এসে আয়াকে বকা ঝকা করছে, কেন ওনার টেবিলটা এতো নোংরা ,পরিস্কার করা হয়নি?পেশেন্টের এটুকু যত্ন না রাখলে ওদের কাজ কি?

শ‍্যামলীদেবী অস্ফুটে বৌমাকে কাছে ডাকেন।ঋতজার বিশ্বাস হয় না।সে ভাবে মনের ভুল ।কিন্তু আবার ডাকেন,”বৌমা”,অরিন্দম মায়ের কথা বুঝতে পেরে বলেন,”মা তোমাকে ডাকছে”।

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ঋতজা গুটি গুটি পায়ে শাশুড়ির কাছে আসলে,শ‍্যামলীদেবী ছলছল চোখে বলেন,”তুই এরকমই থাকবি কড়া দিদিমণি, কেমন?”

ঋতজা ধমকে ওঠে,” থামুন,একদম কথা বলবেন না।ডাক্তার আপনাকে কথা বলতে বারণ করেছে!”।

বৌমার কথা শুনে এই প্রথমবার শাশুড়ি,শ‍্যামলীদেবী চুপ করে যান।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।