“টিকিটটা দেখি মা”,
বয়স্ক কন্টাকটার হাত বাড়ায় টিকিটের জন্য। বছর বাইশের তরুণী কানে হেডফোন গুঁজে বার্তালাপে মগ্ন। সঙ্গের বান্ধবীও কানে হেডফোন গুঁজে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে, গানটান শুনছে বোধহয় ।
কথা বলছিল যে মেয়েটি, সে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ায়,”মানে পরে দিচ্ছি”। অন্য জন চোখ খোলে না, শুনতে পায়নি বোধহয়। বৃদ্ধ ওদের ছেড়ে সামনে এগিয়ে যান ।
সকাল সাড়ে নটা, অফিস টাইম।যাদবপুর হাওড়াগামী মিনি। মেয়ে দুটো উঠেছে হাওড়া থেকে কোথায় নামবে কে জানে ?
এই সময় বাসে পা ফেলার জায়গা নেই। সব অফিস যাত্রীদের ভিড়ে গিজগিজ করছে। বৃদ্ধ ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে থাকেন, “টিকিট, টিকিট, টিকিট…
মৌলালির মোড়ের কাছে এসে বৃদ্ধ আবার টিকিট চান, “মা টিকিটটা..”
যে ফোনে কথা বলছিল সে হাতের ইশারা করে ,তার এখনো কথা শেষ হয়নি। কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা যায় মান-অভিমানের পালা চলছে, সহজে থামবে মনে হয় না। সঙ্গের মেয়েটির চোখ তখনো বোজা দেখে বৃদ্ধ ইতস্তত করে কাঁধে হাল্কা আঙুল ছোঁয়ান, ” মা,টিকিট..”,
মেয়েটির কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় তীব্র চেঁচিয়ে ওঠে, “গায়ে হাত দিলেন কেন, গায়ে হাত দিলেন কেন?”
বৃদ্ধ কাচুমাচু মুখে বলেন, “মা টিকিটটা”,
“টিকিট না দিয়ে কি আমি পালিয়ে যাব ? তখন থেকে টিকিট টিকিট , যতসব অসভ্যতা !”
সঙ্গের মেয়েটি তার মান-অভিমানের পালা মাঝপথে থামিয়ে গলা মেলায়, ” সেই প্রথম থেকে টিকিট টিকিট করে যাচ্ছে, আমরা কি টিকিট দেবো না নাকি?”
বৃদ্ধ কাঁচুমাচু মুখে একবার বলেন, “আসলে অনেকক্ষণ হয়েছে তোমরা উঠেছে তো ,তাই “,
“এই তুমি বলছেন কাকে? তুমি বলছেন কাকে? আমরা ভদ্রতা করছি বলে খুব তেল হয়েছে না? “
“ছোটলোকি করার জায়গা পান না ?”,সঙ্গের মেয়েটি তারস্বরে চেঁচায়।
“গায়ে হাত দিচ্ছেন মেয়েদের আবার তুমি তুমি করছেন! বুড়ো ভাম হতে চলল তবু ছোকছোকানি যায় না! “
সামনের সিটে একটি ছেলে কাঁধে প্লাস্টিকের বিরাট টি আকারের স্কেল ,বোঝাই যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র টাত্র হবে। সে অনেকক্ষণ থেকে মেয়েদুটোকে খেয়াল করছে।
এবার প্রতিবাদ করে, “নিজের বাবার বয়সী লোকের সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন আবার ওনাকে অসভ্য বলছেন? “,
মেয়ে দুটো ফুঁসে ওঠে, প্রায় সমস্বরে বলে,” সব ছেলেগুলো অসভ্য!দেখেছ এক শেয়ালের কথায় অন্য শিয়াল কেমন গলা মিলিয়েছে! আপনি কে হে ?আপনি এখানে কথা বলছেন কেন ?”,
প্রায় একটা হই হট্টগোল বেঁধে গেল । গান শোনা মেয়েটি এতক্ষণ এক কানের হেডফোন খুলে ঝগড়া করছিলো ,এবার দুটোই খুলে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিয়ে তেড়ে ওঠে ,
“আপনার কি মশাই? আপনার কি হয় ওই দাদু, যে আপনার এত ঝাল লাগছে? “
“উনি আমার বাবা হন”, একজন সুদর্শন স্যুটেড-বুটেড ছেলের মুখে কথাটা শুনে মেয়ে দুটো একটু হকচকিয়ে যায় ।বৃদ্ধ কন্ডাক্টরের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে তখন ভিজিয়ে দিচ্ছে তার খাঁকি মোটা কাপড়ের শার্টটা।