অণুগল্পে সুব্রত সরকার

গোবর

জঙ্গলের অদূরে এক বনবস্তি। এই বনবস্তিতে জনজাতি-আদিবাসী মানুষজনদের ঘরবাড়ি। মেচ, রাভা, ওঁরাও, মুন্ডা, খেড়িয়াদের নিয়ে কেমন নিঝুম শান্ত বস্তিটা।

পায়ে হেঁটে বনবস্তিটা ঘুরে দেখতে এসেছে সুপ্রকাশ। একলাই এসেছে। হোম স্টের আয়েশে মেয়ে বউ ভাতঘুম দিয়ে উঠে বলল, “তুমি যাও গ্রাম বেড়াতে। আমরা একটু ব্যালকনিতে বসে জঙ্গল দেখি।”

এই জঙ্গলে বুনোহাতির খুব আনাগোনা আছে। হাতিরা বনবস্তিতে মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়ে অনেক ক্ষতি করে যায়। সেই সব গল্প কথা বলছে হরি রাভা। অল্পবয়সী যুবক হরি সুপ্রকাশের গাইড। হরিকে সঙ্গে নিয়ে সুপ্রকাশ গ্রাম বেড়াতে বেড়াতে অনেক কিছু দেখল। জানল। শুনল অনেক নতুন নতুন কথা হরির মুখে। যেমন হরি একটু আগেই বলল, “ইখন আর চাষ করতে মন লাগে না। বাইরে কাজকাম করতে যেতে ভালো লাগে। কত ছেলে বাইরে আছে । কেরালায় চলে গেছে।”

এই গ্রামে পানীয় জলের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে বোরিং করা জলের সঙ্গে বড় এক জলের ড্রাম বসিয়ে দিয়েছে। সোলার সিস্টেমে এটা চলে। চব্বিশ ঘন্টা জল পাওয়া যায়। জল পেয়ে সবাই খুশি। রাস্তাগুলো শানবাঁধানো হয়েছে। রাস্তায় সোলার লাইটও আছে।

হরি দুঃখ করে শুধু একটা কথাই বলল, “ই গেরামে সবোই ঠিক ছেল, ভুল হল্য শাল্লা গোবর গ্যাসটো!..”

সুপ্রকাশ কৌতূহলী হয়ে বলল, “গোবর গ্যাসের কি হল?”

“হল্য আবার কি!.. পঞ্চাতের মেমবার শাম্লা একটা গোবর গ্যাসের পোজেট বাগায় নিল্য নিজ বাড়ির উঠোনে। গামের সব্বাইকে মিষ্টিও খাওয়াল্য। কিন্তু গোবর আর পেল্য না। গ্যাসও হল্য না!..”

“তার মানে?” সুপ্রকাশ জানতে চায়।

“শুধু মেশিন বসালেই হব্যে? গোবর চাই তো অনেক। তোকে কে দিবে রে গোবর পঞ্চাতের পো শাল্লা!”

হরির কথাগুলোর মধ্যে রাগ, জ্বালা যন্ত্রণা রয়েছে। সুপ্রকাশ আরেকটু জানার ইচ্ছে নিয়ে বলল, “এই গোবর গ্যাসের প্রজেক্টটা ও পেল কি করে? কে দিল ওকে?”

“বললুম না, উ শাল্লা তো পঞ্চাতের মেম্বার। সরকারকে টুপি দিয়ে ভুল বুঝিয়ে নিজের উঠোনে বসা করাল্য।”

“এখন কি হবে তাহলে?”

“কি আর হোবে! কেউ ওকে গোবর দিবে না। ও কি আগে শলা করেছে গায়ের লোকদের লিয়ে?”

“প্রজেক্টটা পুরো ফ্লপ!… ইশ সরকারের কত ক্ষতি।”

“শুনলাম বিশ – তিরিশ লাখ টাকার পোজেট।”

“তাই!..”

মনটা বিষন্ন হয়ে যায় সুপ্রকাশের। গ্রাম ভ্রমণে এমন বাস্তবের গল্প জানতে পারবে ভাবে নি।

নয়ছয় এর কত গল্প শোনা যায় টিভিতে, জানা যায় খবরের কাগজে। কিন্তু নিজে ঘুরতে এসে এসব জানতে পেরে অবাক হয়।

গোবর গ্যাসের প্ল্যান্ট গোবরের যোগান নিয়ে  চিন্তাভাবনা না করে, আগেই প্রজেক্ট নেমে গেল বেনিফিশিয়ারির বাড়ির উঠোনে।  বেনিফিশিয়ারি কে? না সে পার্টির লোক। পঞ্চায়েতের মেম্বার। এই যোগ্যতাই ওকে পাইয়ে দিয়েছে কত লাখো টাকার প্রজেক্ট।

গ্রাম ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসছে দুজনে।

সূর্য ডুববে ডুববে করছে। পশ্চিম আকাশ দিন শেষের আলোয় কেমন মায়াবী। হরি সুপ্রকাশকে বলল, “গোবর গ্যাসের পোজেট ঠিক লোককেই সরকার দিয়েছে, উ শালার মাথা ভরতি গোবর যে!..”

সুপ্রকাশের একথা শুনে হাসি পেল। কিন্তু হাসতে না পেরে বিষন্ন মনেই বলল, “তাহলে এবার কি হবে হরি?”

“কি আবার হোবে… চুরি হয়ে যাবে উসব মেশিন!..”

“চুরি!.. “

“চোর কি আর গায়ের বাইরে থিকে আসবে? চোর আর মালিক একই লুক হলে মাল লুট হতি কি বেশি দিন লাগ্গে? বুঝলেন নি কি বুললাম!..”

হরি মুচকি মুচকি হাসছে কথা শেষ করে।

সুপ্রকাশ হরির দুষ্টু হাসিভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়েই থাকে!..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *