সাপ্তাহিক অণু উপন্যাসে সুব্রত সরকার (পর্ব – ৮)

বনবাসের বর্ণমালা

আট

আজ খুব ঝলমলে রোদ উঠেছে পাহাড়ে। গ্রীন ভ্যালি হোম স্টের বারান্দা থেকে এই রোদ ঝলমলে পাহাড়-জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে শুভ্র ভাবছে, দেখতে দেখতে কতদিন হয়ে গেল ও এই পাহাড়ে-জঙ্গলে রয়েছে। কেমন মায়া, ভালোবাসা জন্মে গেছে বুকের ভেতর। একদিন ছেড়ে চলে যেতে হবে! খুব কষ্ট হবে সে সময়।
সকালের চা খাওয়া হয়ে গেছে। শুভ্র এইসময় রোজই দু’চার পাতা করে ডাইরি লেখে। একটু একটু করে লিখতে লিখতে বেশ বড় হয়ে গেছে লেখাটা। অনেক ছোট ছোট ঘটনার কথা, অনেক অভিজ্ঞতার কথা ডাইরিতে লিখে রেখেছে। এই লেখাটার একটা নামকরণও করেছে, ‘বনবাসের বর্ণমালা’।
আজ ডাইরি লিখতে ইচ্ছে করছে না। একটু অলস আনন্দে চুপ করে বসে থাকতে ভালো লাগছে। বসে বসে কত কথাই না ভাবছে।
বরুণ প্রতিদিন নিয়ম করে দুটো কাগজের লিঙ্ক পাঠিয়ে দেয়। শুভ্র সময়মত মোবাইল থেকে পড়ে নেয়। বরুণ বাড়িতেই বন্দী। অফিস বন্ধ। ওদের এখন ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করে দিয়েছে। শুভ্রর অফিসও বন্ধ। ও যে এই পাহাড়ে এমন আটকে পড়েছে সে কথা অফিসকে জানাতে পেরেছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর শুভ্র মোবাইল হাতে নিয়ে কাগজের লিঙ্ক খুলে পড়তে শুরু করল। কাগজ জুড়ে শুধু করোনা আর লকডাউনের খবর। লকডাউন ওয়ান শেষ হতে চলল, কিন্তু সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে করোনার আতঙ্ক মানুষের স্বাভাবিক ছন্দকে তছনছ করে দিয়েছে। ইতালির মত দেশ কোভিড সংক্রমণে একদম পর্যুদস্ত। আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। ওদের প্রেসিডেন্ট আবার বলতে শুরু করেছেন, এটা নাকি চিনা ভাইরাস! চিন থেকেই এই ভাইরাস সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। একথা শুনে চিনের খুব গোসা হয়েছে!
আমাদের দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্র, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোরে খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। কলকাতার খবরও ভালো নয়। স্কুল, কলেজ, অফিস, শপিং মল, সিনেমা হল সব বন্ধ।
মায়ের সাথে শুভ্রর কাল অনেক কথা হল। মার খুব মন খারাপ। দাদার ব্যবসা বন্ধ। দাদা একদম ঘরে বসে। অর্থে টান পড়তে শুরু করেছে। তারমধ্যে আবার দাদা নেশার খপ্পরে পড়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে মদ কিনে আনছে। ঘরে বসে মায়ের সামনেই খাচ্ছে। মা এটা একদমই মেনে নিতে পারছে না। কিছু বললে, দাদা খুব বাজে ভাষায় কথা বলছে। যা আগে কোনওদিন বলত না!
আর ক’দিন পরই পয়লা বৈশাখ। বাংলা নতুন বছর ১৪২৭। মা প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের দিনে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে যায়। এবারই প্রথম যেতে পারবে না। ঠাকুরকে নতুন শাড়ি দিতে পারবে না। লকডাউন নাকি আরও বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। তাই স্কুল, কলেজ, মন্দির, মসজিদ, গির্জা সব বন্ধ থাকবে আরও অনেকদিন। সরকার ‘লকডাউন টু’ এর কথা ভাবছে।
পাহাড়ের এই নির্জনতায়, সবুজের সান্নিধ্যে, শান্ত সুন্দর রাইবস্তিতে শুভ্রর দিন রাত্রিগুলো যেন স্বপ্নের মত কাটছে। এত বড় এক মহামারির ভয়, আতঙ্কর প্রভাব এখানে সে ভাবে বোঝা যাচ্ছে না। সামান্য কটা বাড়ি-ঘর, হাতে গোনা কয়েকটা পরিবার নিয়ে এই রাইবস্তি। এখানে এমনিতেই সোশ্যাল ডিস্টেন্স রয়েছে। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে মাস্ক, গ্লাভস ও স্যানিটাইজার এর ব্যবহার প্রয়োজন। কিন্তু কি ভাবে সে সব যোগাড় করা যায়, তা নিয়ে আরাধনা ও হরিশংকরের সাথে শুভ্রর একটু কথা হয়েছে। সদর থেকে আনানোর একটা চিন্তাভাবনা চলছে।
মোবাইলে কাগজ পড়ার মধ্যে শুভ্র যখন ডুবে আছে, সে সময় ওর কানে ভেসে এল কিছু মানুষের কোলাহল ও কথাবার্তা। মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওদিকে তাকাতেই দেখতে পেল, অচেনা চার পাঁচজন যুবক হাতে একটা ব্যানার ও কাঁধে ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে চড়াই ভেঙ্গে উঠতে উঠতে বলছে, “হরি ভাইয়া, কাঁহা হ্যায়?”
হরিশংকর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বেশ খুশি মনে ওদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, “আরে আইয়ে আইয়ে লিটুন দা। মোস্ট ওয়েলকাম।”
চার-পাঁচজনের ছোট্ট দলটা উঠে এসে দূরত্ব রেখে হরিকে ঘিরে দাঁড়াল। ওদের সবার মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস। মাল বোঝাই করা ব্যাগদুটো একপাশে রেখে হাতের ব্যানারটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিল। শুভ্র বারান্দায় বসে ওদের দেখছে। কথাবার্তা শুনছে। বুঝতে অসুবিধা হল না যে ওরা এসেছে সমতলের কোনও ক্লাব বা এনজিও থেকে। ওরা নিশ্চয়ই এখানে কোনও ক্যাম্প করে কিছু জিনিসপত্র দেবে সাধারণ মানুষজনকে।
ব্যানারটা বেশ উজ্জ্বল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাতে লেখা, ‘গ্রীন লাইফ নেচার লাভার্স অ্যাসোশিয়েশন, মদনপুর’। একটা লোগো করা রয়েছে। তাতে ঠোঁট বাঁকানো সুন্দর একটা পাখি, নিশ্চয়ই এটা হর্নবিল। এই পাহাড়ে জঙ্গলে হর্নবিল বা ধনেশ পাখি দেখা যায় অনেক। এই জঙ্গলের সেরা পাখি হল হর্নবিল।
হরিশংকর এবার হাঁক দিলেন, “দাদা, ও দাদা, নীচে এসো।”
শুভ্র নীচে যাওয়ার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাকে-মুখে রুমালটা বেঁধে চলে এল নীচে। আলাপ করিয়ে দিল হরি। ওরা সবাই কমবেশি শুভ্রর বয়সী। লিটুনদাই একটু বড় এবং দলের নেতা।
শুভ্র লকডাউনে এখানে বন্দী হয়ে পড়েছে জেনে প্রথমে ওরা বেশ অবাক হল। জানতে চাইল কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো! কোনও রকম অসুবিধা থাকলে জানাতে। শুভ্র খুব খুশি হয়েই বলল, “কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। খুব ভালো আছি। এমন সুন্দর পাহাড়-জঙ্গলে এই সব পাহাড়ি মানুজনদের মধ্যে দিনগুলো সুন্দর কাটছে।”
নেচার লাভার্স ক্লাবের তরফ থেকে আজ এখানকার পাহাড়ি মানুষজনদের মাস্ক, গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া হবে। একটা বড় অর্জুন গাছের ছায়ায় ওরা সব জিনিসপত্র সাজিয়ে নিয়ে বসল। শুভ্রকেও সাথে নিয়ে নিল। শুভ্রর বেশ লাগছে হঠাৎ এরকম একটা উদ্যোগের সাথে জড়িয়ে গিয়ে। হরিদা ও লিটুনদা চলে গেল সব বাড়ি বাড়ি খবরটা পৌঁছে দিতে যে আজ ক্লাবের তরফ থেকে ক্যাম্প হয়েছে।
খবর পৌঁছে গেছে। লোকজন আসা শুরু করেছে। তাঁদেরকে কোভিড নাইনটিন এর কথা ওরা প্রথমে বুঝিয়ে দিচ্ছে। সাবধান করে দিচ্ছে। কেন এখন মাস্ক, গ্লাভস পড়তে হবে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে বলে বলে দিচ্ছে।
আরাধনাও চলে এসেছে। ক্লাবের ছেলেগুলো আরাধনাকে চেনে। ওরা খুব খুশি হয়ে বলল, “ওয়েলকাম, ওয়েলকাম ম্যাডাম।”
আরাধনা হাসলে খুব মিষ্টি লাগে। ও হাসতে হাসতে বলল, “রিয়েলি ইট ইস অ্যা নোবেল ইনিশিয়েটিভ। আই অ্যাপ্রিশিয়েট ইট। থ্যাঙ্কস অ্যা লট!”
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।” ক্লাবের ছেলেরা একসাথে বলল।
আরাধনা শুভ্রর পাশে এসে দাঁড়াল। গত তিন-চার দিন ওদের দেখা হয় নি। এ’কদিন পাহাড়ে সারা দিনই টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। শুভ্র আর ঘর থেকে বের হয়নি। অনেকগুলো স্কেচ করেছে। ডাইরি লিখেছে বেশ কয়েক পাতা। গানও শুনেছে অনেক।
আরাধনাই খবরটা কনর্ফাম করল যে দেশজোড়া ‘লকডাউন টু’ শুরু হচ্ছে। এই পর্বে আবার সব বন্ধ থাকবে ১৫ ই এপ্রিল থেকে ৩রা মে। টানা ১৯ দিন চলবে দ্বিতীয় পর্যায়ের এই লকডাউন। শুভ্র খবরটা সঠিক বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে শুরু করেছে, এই উনিশ দিন কি করবে? বাড়িতে মা তো অস্থির হয়েই আছে। এবার আরও দুশ্চিন্তায় মা মন খারাপ করে থাকবে সারাক্ষণ। দাদার সাথে দু’দিন আগে অল্প কথা হল। দাদাকে খুব মনমরা মনে হল। বিষাদে আক্রান্ত। বেশি কথা বলতে চাইছিল না। সব কথার উত্তরও দিচ্ছিল না। নিজের জীবনটাকে নিজেই গোলমেলে করে ফেলল।
লিটুন দা শুভ্রর হাতে মাস্ক, গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার এক বোতল তুলে দিয়ে বললেন, “এগুলো রাখুন। আমরা সামনের সপ্তাহে আবার আসব। পাহাড়ের ওপরে সোনাখাঁয় যাব। তখন কিছু দরকার লাগলে বলবেন।” তারপর নিজের ফোন নাম্বারটাও দিয়ে দিলেন।
হরিশংকর চা-মোমোর ব্যবস্থা করেছে ওদের জন্য। গ্রিন ভ্যালির বাগানে বাহারি ছাতার নীচে দূরত্ব রেখে সবাই গোল হয়ে বসে চা-মোমো খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিল। আরাধনা, টিনা ভাবী খাবার পরিবেশন করছে। সবাই গল্পে জমে গেছে। শুভ্রর বেশ লাগছে এই আড্ডাটা। মনে হল কতদিন পর যেন এমন ফুরফুরে এক আড্ডায় বসেছে। লিটুন দা হঠাৎ বললেন, “অমিত, একটা গান ধর…”
নিতাই বলল, “কর। কর। ক্যাম্পের একটা গান কর।”
লিটুন দা শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, “অমিত খুব ভালো গান গায়। নিজের লেখা, নিজের সুর। ক্যাম্পের এই সব গান আমাদের কাছে খুব প্রিয়। ক্লাব থেকে আমরা বছরে তিনটে ক্যাম্প করি। পারলে একবার আসবেন আমাদের ক্যাম্পের কোনও প্রোগ্রামে।”
“নিশ্চয়ই আসব।” শুভ্র হেসে বলল, “আমার তো ভীষণ ভালো লাগে ক্যাম্পে যেতে। আমিও কিছু ক্যাম্পে গেছি। আপনাদের ক্যাম্পগুলো কখন হয়?”
“ডিসেম্বরে হয় নেচার স্টাডি ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে সাধারণত ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা যায়। ফেব্রুয়ারিতে হয় বার্ড ওয়াচিং ক্যাম্প। আর মার্চে বাটারফ্লাই স্টাডি ক্যাম্প। আমাদের এই পাহাড়ে জঙ্গলে অনেক প্রজাতির প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায়। খুব রেয়ার দারুণ সুন্দর সুন্দর সব প্রজাপতি আছে এই পাহাড়ে।”
“তাই!” শুভ্র বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “তাহলে আমি একবার আসব প্রজাপতি দেখতে।”
লিটুন দা হাসতে হাসতে বললেন, “অবশ্যই আসবেন। তিন দিনের এই ক্যাম্প সবাই খুব এঞ্জয় করে। ক্যামেরা ভরে নিয়ে যায় প্রজাপতির কত ছবি!”
“একবার আসতেই হবে আমাকে।”

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।