• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় শম্পা সাহা

লাল দাগ

আজকাল বেশ লিখছি টিখছি।মানে ওই আর কি!দিস্তেদিস্তে কাগজ আর কলম নিয়ে কলেজ লাইফে প্রথম প্রেম বিনীতা ছেড়ে যাবার পর হা হুতাশ মার্কা কতশত চিঠি লিখেছি।তা কে জানতো? যে ওইসব নাকি বিরাট সাহিত্য সম্পদ।ইয়ে যাকে বাংলা করলে বোঝায় লিটারারি অ্যাটম বম!
প্রথম জীবনে তো,এই বছর কুড়ি আগে যখন সবে দাড়ি গোঁফ গজাচ্ছে মানে ওই আর কি একটু ফে‍ঁসো মানে বুঝলেন না ,যাকে বলে সুতো বা কালো চাউমিনও বলতে পারেন মার্কা সদ‍্য গজানো গোঁফ নিয়ে বাংলা অনার্স পড়তে গেলাম আর এক ঢাল কালো চুলের বিনীতা কে দেখে মন বিনীত ভাবেই ওই “বিদিশার নিশা”য় হারিয়ে গেল কবে, জানিনি।
এরপর বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, বেশ ভিক্টোরিয়া, কফি হাউস আর বসন্ত কেবিন,মাঝেসাঝে দিশাহারা ট্রাম ভ্রমণ!দিব‍্যি চললো সব।কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারের শেষাশেষি বিনীতা হঠাৎই কোনো এক সরকারি চাকুরের পরিনীতা হয়ে আমায় কলা দেখালো!
ধুত্তোর,প্রেমের ক‍্যাতায় আগুন।আমি অগ্নিবর্ষণ শুরু করে দিলাম।যা যা বাছা বাছা ধিক্কার আমার দেওয়া উচিত, অথচ বিনা নোটিসে চলে গিয়ে আমাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে গেছে বিনীতা সেই হলাহল,সে উদগ্ৰ বিষ ঝরাতে লাগলাম খাতার পাতায়।
আমার এক পাবলিশার বন্ধু একদিন চায়ের আড্ডায় টা সহযোগে চা খেতে খেতে একখানা বাঁধানো খাতা দেখে কুপোকাৎ।বলে,”একি জলভাত,এই লেখা!দে আমায়,তারপর যাবে দেখা!”
আমি আর কি বলি?বাংলা অনার্স করে সকাল বিকেল মাছি মারি,আর কলম ঘষি কাগজে।আর দাদা,বাবা,বৌদি, মা মায় বোন পর্যন্ত অকম্মার ঢেঁকি নামে প্রায় প্রখ‍্যাত করে ফেলেছে।
তারপর?তারপর,”গ্ৰামে গ্ৰামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে!”আমি ক্ষীণেশ খাসনবিশ বিখ‍্যাত “জলদ্গম্ভীর জয়ডঙ্কা”র লেখক হিসেবে বিখ‍্যাত হয়ে গেলাম।দুটো চারটে নো-বেল না হোক প্রবাবল পুরুস্কার পেয়ে টেয়ে বেশ লেজ মোটা করে ফেললাম।
টুপাইসও আসতে লাগলো,সাহিত্য সভা টভা তে বেশ ডাক টাক ও পেতে লাগলাম।পাজামা, পাঞ্জাবি পড়ে কবিসুলভ ফিল নিয়ে, ঘাড়ে মোটা পাউডার লাগিয় চললাম প্রায় বিকেলেই বাংলা সাহিত‍্যকে তুলোধোনা থুড়ি সমৃদ্ধ করতে।
আমার ওই ফুরফুরে গোঁফ এখন সরু। ভাইপোর জ‍্যামিতি বক্সের স্কেল বের করে দুদিক মেপে কাটি ।মাপের এদিক ওদিক যেন না হয়।আর বাংলা অভিধান, বাংলাতে আর যা যা কঠিন, কঠিনতর,তম শব্দ হতে পারে তা খুঁজতে লাগলাম।ভেরি সিম্পল!
প্রথমে আমি সাধারণ ভাষায় একটা কবিতা লিখতাম, তারপর বাংলা অভিধান দেখে ওই সহজ বাংলার কঠিনতম প্রতিশব্দ বসিয়ে দিতাম।ব‍্যস কেল্লাফতে!এক রোমহর্ষক, মর্মান্তিক, মর্মন্তুদ কবিতা হয়ে দাঁড়াতো!যাকে বলে পারফেক্ট মডার্ন আর্ট।আর আমি খ‍্যাতির চুড়ান্ত শিখরে,তুরীয় আনন্দে ভাসছি!তারপর?তারপর এক ঝড়ের রাত আমার সব,সব কেড়ে নিয়ে গেল!
সেদিন হবে বৈশাখের আঠারো কুড়িটুরি! সামনেই পঁচিশে বৈশাখ।প্রকাশকদের ব‍্যাপক চাপ।অন্তত সতেরোটা পত্রিকা থেকে অ্যাডভান্স নেওয়া।মোটে নটা হয়েছে আরো ঢের বাকি।
সেদিন আবার ঝড় বৃষ্টিতে কলকাতা শহরেও কারেন্ট যাচ্ছে আসছে।আমি চার্জার জ্বেলে সবে “রবীন্দ্রনাথ ও আমি” বিষয়ক এক প্রবন্ধ লিখছি।গোটা ছয়েক লাইন সবে নেমেছে।সেই বোমবার্স্টিং ভাষায়, যাতে সবটা পাবলিকের মাথার উপর দিয়ে যায়।আরে বুঝলে তো আলোচনা সমালোচনা করবে!না বুঝলে প্রশংসা!কে আর জনসমক্ষে বলবে,”বুঝিনি!”,তাহলে তো সেই হ‍্যাটা হয়ে যাবে।
গরমা গরম খিচুড়ি আর ডিমভাজা খেয়ে টিমটিমে আলোয় বেশ ফিল ও নিয়ে এসেছি,যাকে বলে একেবারে লোমহর্ষক প্ল‍্যানচেট মার্কা ফিলিং! হঠাৎই চার্জারের লাইটটা এক ধাক্কায় অনেকটা ডিম হয়ে গেল,”কি ব‍্যাপার, চার্জ নেই না কি?”হতেই পারে,এ তো আজকাল আর কাজে লাগে না।হয়তো চার্জ শেষ,কিছুক্ষণ পর হঠাৎই একটা দমকা জোলো হাওয়া পেছনের জানালা দিয়ে পর্দা উড়িয়ে ঢুকে আমার মাথা ছুঁয়ে গেল!
একি ? কি হল এটা?স্পষ্ট বুঝলাম কেউ একজন হাত বুলিয়ে গেলো আমার মাথায়।চুল আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই সবই প্রায় নিকেশ তাই তালুতে তিন আঙ্গুলের স্পর্শ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।
হঠাৎ যেমন কমে গিয়েছিল তেমনি হঠাৎই চার্জার আবার স্বমহিমায়!আর সামনে যা দেখলাম তা দেখে এই ঠান্ডা ভেজা ওয়েদারেও ঘামতে লাগলাম কুলকুল করে!এ কাকে দেখছি?ইনি কে?না এ চেহারা তো ভুল হবার কথা নয়! সেই লম্বা কাঁধ ছোঁয়া পাকা চুল,সেই লম্বা দাড়ি ,সেই লম্বা জোব্বা আর স্বর্গীয় আশপাশের ছোঁয়াচ এড়ানো দৃষ্টিখানা!
প্রথমে তো কথাই সরছিলো না।কিন্তু ওনার অত্যন্ত বিমর্ষ মুখ আর চোখে পড়ার মত শীর্ণ চেহারা বড় যন্ত্রনা দিল।বুকটা অজানা কষ্টে মোচড় দিয়ে উঠল।আমি বহুক্ষণ পর গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,”ইয়ে গুরুদেব,আপনি?”
সেই দেবোপম মুখ তার বিষণ্ণ চোখ তুলে আবার নামিয়ে নিল।তারপর আবার চুপ।বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি যেন পরিবেশ রহস‍্যঘন করে তুলেছে!আমাদের আপামর বাঙালির পুজ‍্য, বাংলা সাহিত্যের দেবতা স্বয়ং আমার সামনে।আমি কি খিচুড়ি খেয়ে ভরাপেটে ঘুমিয়ে পড়লাম।নিজের হাঁটুতে একটা চিমটি দিলাম।”উহুহু ..”,বেশ লাগছে!তাহলে?
আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম,”গুরুদেব, আপনি এখানে?আর এ আপনার কি চেহারা হয়েছে?চোখের নিচে কালি,গাল বসে গেছে,সেই স্বর্গীয় আভা লুপ্ত!কি হয়েছে গুরুদেব?” মলিন মুখ তুলে তিনি তাঁর সেই সুরেলা গলায় অনেকখানি যন্ত্রনা মিশিয়ে বললেন,”তোরা এসব কি শুরু করেছিস?”
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম!আমি আবার কি করলাম?কিছুটা ঘাবড়েও গেলাম!কি বলতে কি বলে ফেলি,অতবড় কিংবদন্তী আমার সামনে!আমতা আমতা করে শুধোলাম,”কেন গুরুদেব, আমি আবার কি করলাম?”আমার ছুঁচোর মত আমসি মার্কা মুখ আর ঝুলে যাওয়া গোঁফ দেখে বোধহয় ওনার মায়া হলো।উনি বোঝাবার ভঙ্গিতে বললেন,”আচ্ছা বলতো,তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে যদি থান ইট দিয়ে মারি কেমন হবে?”
এ আবার গুরুদেবের কেমন কথা!শুনেই যেন মাথা টনটন করে উঠলো!আমি ভয়েময়ে আগেভাগেই মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,”আজ্ঞে, বড়,লাগবে গুরুদেব!”,”তাহলে তোরা ,তোরা কবিতা লেখার নামে কি করছিস?”
হঠাৎ উত্তেজনায় গুরুদেব আমার চৌকি ছেড়ে সটান দাঁড়ালেন।হাত দুটো পেছনে নিয়ে যেমন ভাবে একের পর এক দেশপ্রেমী,জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে যেতেন সেই ভঙ্গিতেই বলে উঠলেন,”মানুষ কবিতা পড়ে প্রেমের পরশ পেতে,দুঃখ ভুলতে,বিরহ যন্ত্রনায় স্নেহের প্রলেপ পেতে।কবিতা হলো মানুষের মনের আরাম!আর তোরা সেটাকে করে ফেলেছিস ভাষার দখল দেখানোর কুস্তির আখড়া!কে কত বেশি ভিরমি খাওয়ানো ভাষা লিখে জনগন কে ভরকে দিতে পারিস?জনগনের কবিতার অর্থ বুঝতে মাথার চুল ছিঁড়তে হয়, এই কবিতা লিখছিস তোরা?মানুষ কবিতার রসাস্বাদন করবে না জবরজং ভাষার ঘূর্ণিপাকে ঘুরবে বল?তোরা কবিতাকে যান্ত্রিক করে ফেলেছিস,মানুষের হৃদয় থেকে টেনে এনে পুরেছিস অভিধানে!এতে মানুষেরও কষ্ট আর কবিতারও”!
বলতে বলতে স্পষ্ট দেখলাম সেই মহান পুরুষের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।তিনি আবারো বলে উঠলেন,”এ সব বন্ধ কর না হলে এক দিন সব রবীন্দ্র সাহিত্য আমি ভ‍্যানিশ করে দেবো সারা বিশ্ব থেকে!থাকিস তখন তোদের ওই ইটকাঠের কবিতা নিয়ে!যা বললাম মনে থাকে যেন!”
হঠাৎ ঘরের টিউবটা জ্বলে উঠল।অনেকক্ষণ পরের তীব্র আলোয় চোখে ধাঁধা লেগে গেল।কয়েক নিমেষ বাদে চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট হলে দেখি নাঃ!কেউ কোত্থাও নেই!তাহলে কি আমার মনের ভুল?
সামনের টেবিলে রাখা খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি, খাতার ওই ছয় লাইন লেখার উপর কে যেন আড়াআড়ি মোটা লাল পেনসিল দিয়ে দাগ দিয়ে কেটে রেখে গেছে আর নিচে নাম লেখা।এই সই যে বড় চেনা, সঞ্চয়িতার পাতায় পাতায় তো এ সইই দেখেছি বহু বার!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।